১৬ বছরে পাহাড় ধসে ৩৫০ জনের মৃত্যু
চট্টগ্রাম নগরী ও আশপাশের পাহাড় ধসে মৃত্যুর মিছিল ঠেকানো যাচ্ছে না। পরিসংখ্যান অনুযায়ী গত ১৬ বছরে পাহাড় ধসে মারা গেছেন ৩৫০ জন। এভাবে একের পর এক মৃত্যুর ঘটনা ঘটলেও প্রশাসনের তৎপরতা তেমন নেই। প্রতি বছর বৃষ্টির আগে পাহাড়ের পাদদেশে ঝুঁকিপূর্ণভাবে বসবাসকারীদের উচ্ছেদ অভিযান চালায় প্রশাসন। এরপর বাকি ১০ মাস সেই তৎপরতা দৃশ্যমান থাকে না। এরপর পাহাড় কাটা শুরু হয়। এতে ঘটে প্রাণহানির ঘটনা।
২০০৭ সালে পাহাড় ধসে ১২৭ জনের মৃত্যুর পর একটি পাহাড় ব্যবস্থাপনা কমিটি গঠন করা হয়েছিল। ওই কমিটি পাহাড় ধসের ২৮টি কারণ উল্লেখ করেছিল। এর মধ্যে পাহাড় ধস প্রতিরোধে পাহাড় দস্যুদের চিহ্নিত করা, পাহাড়ে বসতি উচ্ছেদ করে বিকল্প ব্যবস্থা নেওয়া, পাহাড় কাটা বন্ধ করাসহ ৩৬ দফার একটি খসড়া সুপারিশ প্রতিবেদন তৈরি করে। যদিও এর বাস্তবায়নে কোন পদক্ষেপ নেয়নি প্রশাসন। এ বিষয়ে নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক পরিবেশবিদ বলেন, ২০০৭ সালে মর্মান্তিক পাহাড় ধসের পর একটি পাহাড় ব্যবস্থাপনা কমিটি গঠন করা হয়। গত ১৬ বছরে এই কমিটি উল্লেখযোগ্য কোনও কাজই করেনি। ১৬ বছরে ২১টির মতো সভা করেছে। ওইসব সভায় নেওয়া কোনও সিদ্ধান্ত বাস্তবায়নে তেমন অগ্রগতি নেই।
তার মতে, পাহাড় কাটা ও দখলে জড়িতরা চিহ্নিত হওয়ার পর কঠোর ব্যবস্থা নেওয়া উচিত প্রশাসনের। কিন্তু প্রশাসন তাদের বিরুদ্ধে দৃশ্যমান কঠোর ব্যবস্থা কখনো নেয়নি। এরপর আবার বর্ষা মৌসুম আসে। আবার পাহাড় ধসের ঘটনা ঘটে। সেই সঙ্গে পাহাড়ের পাদদেশে বসবাসকারী লোকজন হতাহত হয়। এসব ঘটনা এখন অনেকটা স্বাভাবিক ঘটনায় পরিণত হয়েছে।
জানা গেছে, ২০০৭ সালের ১১ জুন চট্টগ্রামে ভয়াবহ পাহাড় ধসের ঘটনা ১০০ বছরেও ঘটেনি। ওই দিন ২৪ ঘণ্টায় ৪২৫ মিলিমিটার বৃষ্টিপাত রেকর্ড করে আবহাওয়া অফিস। ওই বৃষ্টিতে চট্টগ্রামের সেনানিবাস এলাকা, লেডিস ক্লাব, কাছিয়াঘোনা, ওয়ার্কশপ ঘোনা, শহরের কুসুমবাগ, মতিঝর্ণা, বিশ্ববিদ্যালয় এলাকাসহ প্রায় ৭টি এলাকায় পাহাড় ধসের ঘটনা ঘটে। ওইদিন ভোরবেলা অল্প সময়ের মধ্যে এসব পাহাড় ধসে নারী, শিশুসহ ১২৭ জনের মৃত্যু হয়। এরপর ১৫ বছরে পাহাড় ধসে মারা গেছেন আরও ২২৩ জন। এর মধ্যে ২০০৮ সালের ১৮ আগস্ট চট্টগ্রামের লালখানবাজার মতিঝর্ণা এলাকায় পাহাড় ধসে চার পরিবারের ১২ জনের মৃত্যু হয়। ২০১১ সালের ১ জুলাই চট্টগ্রামের টাইগার পাস এলাকার বাটালি হিলের ঢালে পাহাড় ও প্রতিরক্ষা দেয়াল ধসে ১৭ জনের মৃত্যু হয়। ২০১২ সালের ২৬-২৭ জুন পাহাড় ধসে চট্টগ্রামে ২৪ জনের মৃত্যু হয়। ২০১৩ সালে মতিঝর্ণায় দেয়াল ধসে ২ জন মারা যান। ২০১৫ সালের ১৮ জুলাই বায়েজিদ এলাকার আমিন কলোনিতে পাহাড় ধসে ৩ জন ও ২১ সেপ্টেম্বর বায়েজিদ থানার মাঝিরঘোনা এলাকায় পাহাড় ধসে মা-মেয়ের মৃত্যু হয়।
এরপর ২০১৭ সালের ১২ ও ১৩ জুন রাঙামাটিসহ চট্টগ্রামের পাঁচ জেলায় পাহাড় ধসে প্রাণ হারান ১৫৮ জন। ২০১৮ সালের ১৪ অক্টোবর নগরীর আকবরশাহ থানাধীন ফিরোজশাহ কলোনিতে পাহাড় ধসে মারা যান ৪ জন। ২০১৯ সালে কুসুমবাগ এলাকা পাহাড় ধসে এক শিশুর মৃত্যু হয়। বিচ্ছিন্ন দুই-এক বছর বাদ দিয়ে সর্বশেষ ২০২২ সালে ৭ এপ্রিল নগরীর আকবর শাহ থানা এলাকায় পাহাড় ধসে একজনের মৃত্যু হয়। এভাবে প্রতিবছরই বর্ষায় পাহাড় ধসে প্রাণহানির ঘটনা ঘটছে।
এসব ঘটনায় প্রশাসনের কেন কার্যকর পদক্ষেপ নেই তা নিয়ে বিস্তর সমালোচনা আছে। বিভিন্ন পরিবেশবাদী সংগঠন পাহাড় ধসে মৃত্যুর পেছনে নানা কারণ চিহ্নিত করেছেন। এর মধ্যে আছে প্রশাসনের উদাসীনতা, রাজনৈতিক দলের শীর্ষ নেতাদের লেজুড়বৃত্তি, তদন্ত কমিটির সুপারিশ বাস্তবায়ন না করা।
তবে এ ব্যাপারে চট্টগ্রাম জেলা প্রশাসনের দায়িত্বশীল এক কর্মকর্তা বলেন, প্রশাসন আসলে সব সময় তৎপর ভূমিকা পালন করে। আর প্রশাসনিক এই তৎপরতার সুফল দ্রুত পেতে চাইলে রাজনৈতিক দলের নেতা, সরকারের বিভিন্ন সংস্থা ও স্থানীয় জনগণের সমন্বিত উদ্যোগ প্রয়োজন। কিন্তু এভাবে আসলে কাজ করা হয় না। জেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে প্রতি বছর বর্ষা মৌসুমের আগে উচ্ছেদ অভিযান পরিচালনা করা হয়। জেলা প্রশাসনের পাশাপাশি অন্যরাও যদি নিজেদের জায়গা থেকে সঠিক ভূমিকা পালন করে তবেই কেবল এটি রোধ করা যাবে।
এদিকে আকবর শাহ এলাকায় শুক্রবার বিকালে পাহাড় ধসের ঘটনার আগেও প্রশাসনিক তৎপরতা চালানো হয় বলে জানা গেছে। সেখানে ঠিক দুই মাস মাস আগেও পাহাড় কাটার সময় ভ্রাম্যমাণ আদালত চালিয়ে এক্সক্যাভেটরসহ একজনকে আটক করা হয়েছিল।
এ প্রসঙ্গে জেলা প্রশাসনের ওই কর্মকর্তা জানান, গত ১১ ফেব্রুয়ারি ওই এলাকায় পাহাড় কাটার ঘটনায় চট্টগ্রাম জেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে ভ্রাম্যমাণ আদালত পরিচালনা করা হয়। কাট্টলী সার্কেলের সহকারী কমিশনার (ভূমি) মো. ওমর ফারুক সেই অভিযানে মো. শাহজাহান নামে এক ব্যক্তিকে এক্সক্যাভেটরসহ আটক করেছিলেন। পরে ভ্রাম্যমাণ আদালত তাকে সাত দিনের বিনাশ্রম কারাদণ্ড দেয়।
এসআইএইচ