পানি ধারণ ক্ষমতা হারাচ্ছে কাপ্তাই হ্রদ!
রাঙামটির সুপেয় পানির সবচেয়ে বড় উৎস কাপ্তাই হ্রদ। একই সঙ্গে এই হ্রদের পানি দিয়েই বিদ্যুৎ উৎপাদন করছে কর্ণফুলি জল বিদ্যুৎ কেন্দ্র। জলবায়ু পরিবর্তন ও কাপ্তাই হ্রদ বেদখল হওয়ায় কমে এসেছে পানির ধারণ ক্ষমতা। অন্যদিকে শুস্ক মৌসুমে তীব্র পানি সংকটে বিদ্যুৎ উৎপাদনও ব্যহত হয়।
ষাটের দশকে জলবিদ্যুৎ কেন্দ্র গড়ে তোলার লক্ষ্যে খরস্রোতা কর্ণফুলী নদীতে বাঁধ দেওয়ার কারণে গড়ে ওঠে বিস্তৃীর্ণ কৃত্রিম কাপ্তাই হ্রদ। পরবর্তীতে ১৯৬২ সালে রাঙামাটির কাপ্তাই উপজেলার কর্ণফুলী নদীতে বাঁধ দেওয়া অংশে চালু করা হয় একমাত্র জলবিদ্যুৎ কেন্দ্র কর্ণফুলী পানি বিদ্যুৎ কেন্দ্র।
শুরুর দিকে বিদ্যুৎ কেন্দ্রটির উৎপাদন সক্ষমতা ছিল ৮০ মেগাওয়াট। পরবর্তীতে ধাপে ধাপে স্থাপনাটির বিদ্যুৎ উৎপাদন সক্ষমতা বৃদ্ধি করে মোট ২৪২ মেগাওয়াটে উন্নীত করা হয়েছে। এই উৎপাদনের পুরোটাই যোগ হচ্ছে জাতীয় গ্রীডে। কাপ্তাই বাঁধের মধ্যে ১২ দশমিক ২ মিটার দৈর্ঘ্য ও ১১ দশমিক ৩ মিটার প্রস্থ আয়তনে ১৬টি জলকপাট রয়েছে। এই ১৬টি জলকপাট দিয়ে একত্রে প্রতি সেকেন্ডে ৫ লাখ ২৫ হাজার কিউসেক পানি নিগর্মণ করতে পারে।
বর্তমানে কাপ্তাই হ্রদ ভরাট ও বেদখল হওয়ায় কমেছে হ্রদের পানির ধারণ ক্ষমতা। ফলে বর্ষাকালে উপচেপড়া পানি দেখা গেললেও শুস্ক মৌসুমে থাকে তীব্র পানি সংকট। পানি সল্পতার কারণে বন্ধ হয়ে যায় শহরের সঙ্গে বিভিন্ন উপজেলার লঞ্চ চলাচল। চলতি শুষ্ক মৌসুমে পানি কমে যাওয়ায় কর্ণফুলী পানি বিদ্যুৎ কেন্দ্রের একটি মাত্র ইউনিট চালু রয়েছে। পানি সংকটের কারণে ব্যহত হচ্ছে মৎস্য আহরণও। এই হ্রদের উপর নির্ভর করেই কয়েক লাখ মানুষে জীবিকা নির্বাহ করে থাকে।
বিদ্যুৎ কেন্দ্র সংশ্লিষ্ট সূত্রগুলো জানিয়েছে, নির্মাণকালে কাপ্তাই হ্রদের পানির গড় সর্বোচ্চ লেভেল থাকত ১২০ ফুট এমএসএলেরও (সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে উচ্চতা) বেশি। ১৯৭০ সালে জাইকার এক সমীক্ষায় পানির সর্বোচ্চ স্তর ১১৮ ফুট এমএসএল পাওয়া যায়। তবে পাঁচ দশক ধরে জমতে থাকা পলি, দখল-ভরাটের কারণে পানির সর্বোচ্চ গড় ১১০ ফুট এমএসএলের নিচে নেমে এসেছে।
গত কয়েক মাসে দেশে বিদ্যুৎ সংকট দেখা দিলে সস্তায় উৎপাদন সক্ষম কেন্দ্রটি থেকে সর্বোচ্চ পরিমাণ বিদ্যুৎ উৎপাদন করা হয়। এতে পানির স্তর কমে ৭৮ দশমিক ৮ ফুট এমএসএলে নেমে আসে। যদিও রুলকার্ভ অনুযায়ী পানির লেভেল থাকার কথা ছিল ৯১-এর বেশি। পানির স্তর ৭০-এর নিচে নেমে গেলে উৎপাদন বন্ধ করে দেওয়া ছাড়া উপায় থাকবে না বলে জানিয়েছেন প্রকৌশলীরা।
কর্ণফুলী পানি বিদ্যুৎ কেন্দ্রের ব্যবস্থাপক এটিএম আব্দুজ্জাহের বলেন, কাপ্তাই হ্রদের পানির স্তর সর্বনিম্ন পর্যায়ের কাছাকাছি নেমে এসেছে। বর্তমানে ন্যূনতম একটি টারবাইন চালু রেখে বিদ্যুৎ উৎপাদন করা হচ্ছে। শিগগিরই বৃষ্টিপাতের মাধ্যমে পানির স্তর না বাড়লে অন্তত একটি ইউনিট চালু রাখাও সম্ভব হবে না। এ বিষয়ে বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ডের কিছু করারও নেই।
কাপ্তাই হ্রদ ভরাট হয়ে যাওয়ার বিষয়টি স্বীকার করে হ্রদ ব্যবস্থাপনা কমিটির চেয়ারম্যান ও রাঙামাটি জেলা প্রশাসক মোহাম্মদ মিজানুর রহমান বলেন, 'কাপ্তাই হ্রদে ড্রেজিংয়ের ব্যাপারে নৌ-পরিবহন মন্ত্রণালয় সমীক্ষার মাধ্যমে একটি ডিপিপি তৈরির কার্যক্রম চলমান রয়েছে'।
সরকারি হিসাবে রাঙামাটির কাপ্তাই হ্রদের আয়তন প্রায় ৬৮ হাজার ৮০০ হেক্টর। তবে ক্রমান্বয়ে বেদখল এবং হ্রদের পানি ময়লা-আবর্জনা ও শৌচাগারের বর্জ্যে সংকুচিত হয়ে আসছে বৃহৎ এ জলাধারটি। সম্প্রতি এক রিটের পরিপ্রেক্ষিতে কাপ্তাই হ্রদের অবৈধ দখল উচ্ছেদ ও দখলদারদের তালিকা তৈরির নির্দেশনা দিয়েছেন আদালত। এরপর প্রশাসন কিছুটা নড়েচড়ে বসলেও দখলদারদের বাধার মুখে পণ্ড হয়ে যায় জেলা প্রশাসনের উচ্ছেদ অভিযান।
সুশাসনের জন্য নাগরিক, সুজন রাঙামাটির সাধারণ সম্পাদক এম জিসান বখতেয়ার বলেন, রাঙামাটিজুড়ে কাপ্তাই হ্রদ দখলের প্রতিযোগিতা চলছে। এ কারণে প্রাকৃতিক হ্রদটি ভরাট হয়ে পানির বৃহত্তম এ সংরক্ষণাগার সংকুচিত হয়ে আসছে। এতে জীববৈচিত্র্য বিনষ্ট হওয়ার পাশাপাশি হ্রদকে কেন্দ্র করে গড়ে ওঠা জলবিদ্যুৎ কেন্দ্র কিংবা পার্বত্যাঞ্চলে মৎস্য আহরণের পরিমাণ দিন দিন কমছে। দুর্গম পার্বত্য এলাকাগুলোয় যাতায়াতের অন্যতম মাধ্যমে হ্রদ দখলমুক্ত করার পাশাপাশি ড্রেজিং কার্যক্রম পরিচালনা না করলে ক্রমশ ভরাটের মাধ্যমে নতুন সংকটের মধ্যে পড়বে কাপ্তাই হ্রদ।
এএজেড