উখিয়া-টেকনাফের রোহিঙ্গা ক্যাম্পে সক্রিয় ১০ সশস্ত্র গোষ্ঠী
কক্সবাজারের উখিয়া ও টেকনাফের ৩৩টি রোহিঙ্গা ক্যাম্পে আধিপত্য বিস্তারে মরিয়া হয়ে উঠেছে সক্রিয় ১০টি সশস্ত্র গোষ্ঠী। ক্যাম্পভিত্তিক মাদক চোরাচালান, মানব পাচার, হাট-বাজারে চাঁদাবাজি, অপহরণ-মুক্তিপণ আদায়-এসব নিয়ন্ত্রণে হামলা, খুন, অগ্নিসন্ত্রাস মিলে অস্থির হয়ে উঠেছে ক্যাম্প। এ কারণে চলতি বছরের জানুয়ারি থেকে মঙ্গলবার (২১ মার্চ) পর্যন্ত ক্যাম্পে হত্যাকাণ্ডের ঘটনা ঘটেছে ১৮টি। আর মঙ্গলবারের (২১ মার্চ) দুইজন নিয়ে চলতি মাসে এখন পর্যন্ত খুন হয়েছেন ৯ জন।
মঙ্গলবার দুপুরে উখিয়ার তাজনিমারখোলা এলাকার ১৩ নম্বর রোহিঙ্গা ক্যাম্পে দুষ্কৃতিকারীদের গুলিতে দুই রোহিঙ্গা যুবক মারা যান। তারা হলেন, ক্যাম্পের জি-৪ ব্লকের বেসা আলির ছেলে মো. রফিক ও মাহমুদ হাসানের ছেলে রফিক উল্যাহ। আহত হয়েছেন একই ক্যাম্পের মোহাম্মদ হোসেনের ছেলে মো. ইয়াছিন।
উখিয়া থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) শেখ মোহাম্মদ আলী জানিয়েছেন, গতকাল দুপুরে ৫-৬ জন অজ্ঞাত সশস্ত্র দুষ্কৃতিকারী ১৩ নম্বর ক্যাম্পে হামলা চালায়। এ সময় রফিক নামের দুইজন এবং ইয়াছিনকে লক্ষ্য করে গুলি করে তারা। এতে মো. রফিকের বুকের বাম পাশে গুলি লাগে। তাকে পাশের এনজিও হাসপাতালে নেওয়া হলে চিকিৎসক মৃত ঘোষণা করেন। আর রফিক উল্যাহর ডান চোখের উপরে গুলি লেগে মাথার পেছন দিয়ে বের হয়ে যায়। এতে ঘটনাস্থলেই মারা যান তিনি। গুলিবিদ্ধ ইয়াছিনকে উন্নত চিকিৎসার জন্য কক্সবাজার সদর হাসপাতালে ভর্তি করা হয়েছে।
কক্সবাজার জেলা পুলিশের তথ্যমতে, ২০১৭ সালের ২৫ আগস্ট থেকে ২০২২ সালের ডিসেম্বর পর্যন্ত রোহিঙ্গা ক্যাম্পে ১২৯টি হত্যাকাণ্ডের ঘটনা ঘটেছে। আর চলতি বছরের জানুয়ারি থেকে এখন পর্যন্ত ১৮টি হত্যাকাণ্ড সংঘটিত হয়েছে। এ ছাড়াও চলতি মাসের (মার্চ) ২১ দিনে খুন হয়েছেন ৯ জন। এসব ঘটনায় নিহতদের বেশিরভাগ রোহিঙ্গা ক্যাম্পের কমিউনিটি নেতা ও স্বেচ্ছাসেবক।
সম্প্রতি প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত সংসদীয় স্থায়ী কমিটির এক প্রতিবেদনে রোহিঙ্গা ক্যাম্পের অস্থিরতার জন্য আরাকান রোহিঙ্গা স্যালভেশন আর্মিসহ (আরসা) ৩টি সন্ত্রাসী গ্রুপ ও ৭টি ডাকাত দল রোহিঙ্গা ক্যাম্প এলাকায় সক্রিয় রয়েছে বলে বলা হয়েছে। এসব সশস্ত্র গোষ্ঠী দ্বারা আধিপত্য বিস্তারকে কেন্দ্র করে হত্যাসহ নানা অপরাধ সংঘটিত হচ্ছে।
উখিয়ার ১৪ আর্মড পুলিশ ব্যাটালিয়নের (এপিবিএন) অধিনায়ক অতিরিক্ত উপমহাপরিদর্শক ছৈয়দ হারুন অর রশিদ বলেন, ‘রোহিঙ্গা শিবিরে কয়েকটি দুষ্কৃতিকারী দল সক্রিয় রয়েছে। আধিপত্য বিস্তারকে কেন্দ্র করে একের পর এক হত্যাকাণ্ড ঘটছে। মিয়ানমারের সশস্ত্র গোষ্ঠী আরসার সন্ত্রাসীরা এ ঘটনার নেপথ্যে রয়েছে বলে দাবি করে আসছে সাধারণ রোহিঙ্গারা। এ বিষয়টি নিয়ে তৎপর রয়েছে এপিবিএন। এ ঘটনায় জড়িতদের চিহ্নিত করে গ্রেপ্তারে অভিযান চালানো হচ্ছে।’
এদিকে রোহিঙ্গা নেতাদের দাবি, এসব ঘটনার পেছনে কথিত সন্ত্রাসী সংগঠনগুলো জড়িত। আরাকান রোহিঙ্গা সোসাইটি ফর পিস অ্যান্ড হিউম্যান রাইটসের চেয়ারম্যান মোহাম্মদ জোবায়ের বলেন, দুটি কারণে রোহিঙ্গা ক্যাম্পে কমিউনিটি নেতাদের খুন করছে সন্ত্রাসী সংগঠনগুলো। প্রথমত, কথিত সন্ত্রাসী সংগঠনগুলোর ব্যাপারে কেউ তথ্য দিলে সেটি তারা জেনে যায়। তারপর নির্দিষ্ট সময়ে গিয়ে তথ্যদাতাকে ধরে গুলি ও কুপিয়ে হত্যা করছে। কারণ ক্যাম্পে তাদের অসংখ্য নেটওয়ার্ক রয়েছে। দ্বিতীয়ত, আগে অনেক কমিউনিটি নেতা কথিত সন্ত্রাসী সংগঠনগুলোকে সহযোগিতা করত। কিন্তু এখন না করাতে ‘মুনাফিক’ হয়ে গেছে বলে টার্গেট করে হত্যা করছে।
শরণার্থী ত্রাণ ও প্রত্যাবাসন কমিশনার মো. মিজানুর রহমান বলেন, ক্যাম্পে আইনশৃঙ্খলার অবনতি হলে তো আমরা অবশ্যই চিন্তিত। তবে ক্যাম্পে তিন ব্যাটালিয়ন এপিবিএন রয়েছে। সিনিয়র পুলিশ কর্মকর্তা রয়েছে। তারা প্রতিনিয়ত কাজ করছেন। আমরা তাদের সঙ্গে সমন্বয় করছি। এ ছাড়াও বিভিন্ন গোয়েন্দা সংস্থাগুলো কাজ করছে। তারপরও কিছু ঘটনা ঘটছে। এসব ঘটনা নিয়ে আমরা কিছুটা চিন্তিত। আমরা সবাই চেষ্টা করছি, কিভাবে ক্যাম্পে অপরাধ নিয়ন্ত্রণ করা যায়।
রোহিঙ্গা ক্যাম্পে দায়িত্বে থাকা ৮ এপিবিএনের অধিনায়ক (অতিরিক্ত ডিআইজি) মো. আমির জাফর বলেন, ক্যাম্পে বেশ কিছু গ্রুপ কাজ করে। যাদের কাজ হচ্ছে মাদক ব্যবসা, চাঁদাবাজি, অপহরণসহ নানা অপরাধ নিয়ন্ত্রণ। এসব নিয়ন্ত্রণ করতে গেলে আধিপত্য বিস্তার একটা বিষয় থাকে। এরা নিজেদের আধিপত্য বিস্তার করতে এসব অপরাধের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট হচ্ছে।
তিনি আরও বলেন, আমরা প্রতিনিয়ত অভিযান পরিচালনা করছি। কখনও এপিবিএন পুলিশ একা করছে, কখনও জেলা পুলিশ বা র্যাবকে সঙ্গে নিয়ে কাজ করছে। তবে সবার সমন্বিত প্রচেষ্টায় আশা করি ক্যাম্পের এই অপরাধ নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব হবে।
এসআইএইচ