দারুশিল্পী লুকাসের শরীরে বাসা বেঁধেছে কঠিন ব্যাধি
কাঠ খোদাই করে ভাস্কর্য তৈরি করা পঞ্চগড়ের নিভৃত পল্লীর এক দারুশিল্পী লুকাস দাস (৫০)। বাঁশ দিয়েও তৈরি করেন দৃষ্টিনন্দন সব আসবাবপত্র। ফাঁকে ফাঁকে চলে সাহিত্য চর্চাও। অর্থাভাবে তার কবিতা ও উপন্যাসের একটি পাণ্ডুলিপিও ছাপা অক্ষরের রূপ আর দেখতে পারেনি। ভ্যান টেনে চলত তার সংসারের চাকা। কঠিন দারিদ্র্যতা আর না পাওয়ার যন্ত্রণায় পুড়ে অঙ্গার হওয়া লুকাসের জীবনে আসেনি কখনো বসন্ত। জীবনে একটি বসন্তের বড়ই সাধ ছিল তার। কিন্তু তা তার কাছে এখন কেবলই স্বপ্ন।
ধীরে ধীরে কঠিন অসুখ বাসা বেঁধেছে লুকাস দাসের শরীরে। পরিবারের ঘানি টানতে টানতে কখন যে কঠিন অসুখ বাসা বেঁধেছে টেরই পাননি তিনি। তিনি এখন হেপাটাইটিস বি ও যক্ষা রোগে আক্রান্ত। ঢাকা, চট্টগ্রাম পরে দিনাজপুরের পার্বতীপুর খ্রিস্টান মিশনারিজ হাসপাতালসহ বিভিন্ন জায়গায় চিকিৎসকদের অধীনে নিয়েছেন চিকিৎসা। নেই কোনো উন্নতির লক্ষণ। উল্টো তার শারীরিক অবস্থা দিন দিন আরও অবনতি হচ্ছে। জীবন এখন তার কঠিন সংকটে। থমকে গেছে তার ৪ সদস্যের সংসারের চাকাও।
একমাত্র ছেলে অপু দাস ঢাকার সাভারে বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের একটি শাখায় চাকরি করলেও ওই প্রতিষ্ঠান বন্ধ হয়ে যাওয়ায় এখন বেকার হয়ে পড়েছেন। আর একমাত্র মেয়ে অর্পিতা দাস আটোয়ারী পাইলট বালিকা উচ্চ বিদ্যালয় থেকে এবারের এসএসসি পরীক্ষার্থী। তার লেখাপড়াও বন্ধের উপক্রম। চিকিৎসা করাতে গিয়ে জীবিকার প্রধান অবলম্বন ভ্যানটিও বিক্রি করে দিতে বাধ্য হন লুকাস। এখন পর্যন্ত প্রায় দুই লাখ খরচ হয়েছে তার চিকিৎসার পেছনে। ধারদেনাও হয়ে গেছে অনেক। কাজ করতে না পাড়ায় চরম মানবেতর জীবনযাপন করছে পরিবারটি। প্রায়শ খেয়ে না খেয়ে কাটছে তাদের দিন।
চিকিৎসকদের পরামর্শ অনুযায়ী এবার ভারতে গিয়ে জীবনের শেষ চিকিৎসা করাতে চান লুকাস। কিন্তু সেখানে খরচ হবে প্রায় ৫ লাখ টাকা। যে পরিবারটিতে দুমুঠো ভাতের জোগান ঠিকমতো হয় না সেই পরিবারে এত টাকা জোগাড় করা ঠিক খাড়া পাহাড়ে উঠার মতোই কঠিন কাজ। তাই সহযোগিতার চেয়ে সরকারি-বেসরকারি বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে আবেদন করলেও কোনো সাড়া মিলেনি এখনো। একটু ভালোবাসা ও সহানুভূতির আশায় চাতক পাখির মতো অপেক্ষায় লুকাসের পরিবার।
লুকাস দাসের বাড়ি জেলার আটোয়ারী উপজেলার মির্জাপুর ইউনিয়নের কালিকাপুর খ্রিস্টানপাড়ায়। পেশায় একজন ভ্যানচালক। ১২ বছর বয়সেই বাবা-মাকে হারানোর পর সংসারের হাল ধরতে হয় তাকে। লেখালেখির পাশাপাশি কোনো প্রশিক্ষণ ছাড়াই নিজে নিজে চিত্রকর্ম তৈরি ও বাঁশ দিয়ে নানা সব দুর্লভ আসবাবপত্র তৈরি করতেন। এমনকি কাঠ দিয়ে অসাধারণ সব ভাস্কর্য তৈরি করতে পারতেন নিভৃত পল্লীর এই ভ্যানচালক। বাড়ি ভিটের দেড় শতক জমিই তার সম্পদ। সারাদিন ভ্যান চালিয়ে স্ত্রী-সন্তানদের আহার আর লেখাপড়ার খরচ জোগাড় করতেন। এর ফাঁকে যে সময় মিলে বসে পড়তেন সাহিত্য চর্চা, চিত্রকর্ম তৈরি ও ভাস্কর্য তৈরিতে। গভীর রাত জেগেও চলত এই শিল্পীর রচনাশৈলী। তবে আধুনিক প্রযুক্তির উন্নত যন্ত্রপাতিতে আসবাবপত্র তৈরির দিকে ঝুঁকছেন মানুষজন। আর হাতে তৈরি জিনিসপত্রের কদর যেন দিন দিন হারিয়েই যাচ্ছে। ফলে অনেক সময় আসবাবপত্র ও হস্তশিল্পের বিভিন্ন কাজ পেলেও সময়মতো তা ক্রেতাদের বুঝিয়ে দিতে পারেন না। এতে অনেকে তার কাজ থেকে মুখ ফিরিয়ে নিচ্ছেন। কাজের অভাবে অবহেলিত হয়ে পড়েন লুকাস। এখন থমকে গেছে তার জীবনের চাকা, থেমে গেছে সব কলরব।
মেয়ে অর্পিতা দাস বলেন, বাবাই আমাদের মাথার উপরে একমাত্র ছাতা। বড়ভাই আমাদের সংসারে কিছু টাকা দিয়ে সহযোগিতা করলেও তার চাকরিও এখন আর নেই। বাবা বর্তমানে হেপাটাইটিস বি ও যক্ষা রোগে আক্রান্ত। ঠিকমতো খেতে পারেন না। কোনো কাজও করতে পারেন না। দীর্ঘদিন ধরে বিছানায় শুয়ে-বসে কেটে যাচ্ছে তার দিনকাল। আমার বাবার চিকিৎসার জন্য অনেক টাকা দরকার। কোনো স্বহৃদয়বান ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠান যদি আমার বাবার চিকিৎসায় এগিয়ে আসতেন তাহলে আমার বাবা আগের মতো সংসারের হাল ধরতে পারতেন।
স্ত্রী তারা রায় বলেন, আগে যখন উনার (লুকাস দাসের) শরীর ভালো ছিল তখন আমাদের সংসার মোটামুটিভাবে ভালোই চলত। একদিকে তিনি এখন বিছানায় অন্যদিকে ছেলেরও চাকরি নেই। খুবই দুর্বিষহ দিন কাটাচ্ছি আমরা। আমি একটু-আধটু মানুষের কাজ, পাথর ভাঙ্গার কাজ করি। কোনো দিন কাজও পাই না। এভাবে কোনোমতে চলি। অনেক সময় না খেয়েই দিন কাটাই। কী করব? এক-দুইদিন না হয় মানুষ আমাদের সাহায্য করল। প্রতিদিনতো আর করবে না।
লুকাস দাস বলেন, আধুনিক প্রযুক্তির কাছে হার মানতে হয়েছে আমাকে। সময়মতো কাজ বুঝিয়ে দিতে না পারায় মানুষ এখন আর কাজ দেয় না। আমারও যদি উন্নত যন্ত্রপাতি থাকত কোনোমতে কাজ করে চলতে পারতাম। এদিকে আমার শারীরিক অবস্থা দিন দিন অবনতি হচ্ছে। বেশিরভাগ সময় বিছানায় শুয়ে কাটাই। আমি জীবনের শেষ চিকিৎসার জন্য ভারতে যেতে চাই। সেখানে চিকিৎসা নিলে হয়তো আমি জীবনের বাকি দিনগুলো ভালো থাকতে পারব। কিন্তু তার জন্য প্রয়োজন ৫ লাখের মতো টাকা। এত টাকা আমার পক্ষে জোগাড় করা সম্ভব নয়। তাই সবার কাছে একটু ভালোবাসার মিনতি করছি।
আটোয়ারী উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) মুসফিকুল আলম হালিম বলেন, আমরা উপজেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে লুকাস দাসের জন্য যতটুকু সম্ভব সহযোগিতা করব। সমাজের বিত্তবান মানুষদেরও এগিয়ে আসার আহ্বান করছি। যাতে করে তিনি আগের মতো স্বাভাবিক জীবনে ফিরতে পারেন। সংসারের হাল ধরতে পারেন।
লুকাস দাসকে সহযোগিতার জন্য যোগাযোগের ঠিকানা: লুকাস দাস, কালিকাপুর খ্রিস্টানপাড়া, মির্জাপুর, আটোয়ারী, পঞ্চগড়। মোবাইল নম্বর: ০১৭৮০৯১৬৮৭৭ (লুকাস দাস)। সোনালী ব্যাংক আটোয়ারী শাখায় তার হিসাব নম্বর: লুকাস দাস-১৯০২৬০১০১০৭৩৫।
এসজি