সুনামগঞ্জে পলিথিনের কারণে হুমকির মুখে জীববৈচিত্র্য
পলিথিন ও প্লাস্টিক বর্জ্যে সয়লাব হাওরের জেলা সুনামগঞ্জের চারপাশ। পলিথিন নিষিদ্ধের পরও দিন দিন বেড়েই চলছে । পলিথিনের ভয়ঙ্কর দূষণ জনস্বাস্থ্য ও প্রকৃতি-পরিবেশকে হুমকির মুখে ঠেলে দিচ্ছে। আইনি দুর্বলতার সুযোগে পরিবেশ বিপর্যয়ের এই পলিথিন সুনামগঞ্জে এখন সহজলভ্য। মাটির নিচে যে পলিথিন ৫০০ বছরেও পঁচে না, তারই দাপট বাড়ছে জলাশয় আর স্থলভাগে। অপচনশীল পলিথিনের যত্রতত্র ব্যবহারের ফলে ভরাট হচ্ছে সুনামগঞ্জের নদী-নালা, খাল-বিল। দূষিত হচ্ছে পানি। বিষ ছড়াচ্ছে বাতাসে। ভেঙে পড়ছে ড্রেনেজ ব্যবস্থা। শুধু তাই নয় পলিথিন বর্জ্যের কারণে উর্বরতা হারাচ্ছে মাটি। খাবারের সঙ্গে প্লাস্টিকের অতি ক্ষুদ্র কণা মানুষের দেহে ঢুকে ক্যান্সারসহ জটিল রোগ তৈরির কারণ হয়ে উঠছে।
এক সময়ের অপার সৌন্দর্যের সুরমা নদীর রূপ হারিয়েছে নিষিদ্ধ পলিথিন ও প্লাস্টিক জাতীয় বর্জ্যের কারণে। বাতাসের সঙ্গে নদীর পানি থেকে ভেসে আসছে ভয়বহ দুর্গন্ধ। চারপাশজুড়ে ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে নোঙরা পলিথিন। নদীর তীরে পা রাখা মাত্রই গা ঘিন ঘিন করে উঠে-এমন সব দৃশ্য।
সারাদিন ভ্যান গাড়ি চালিয়ে ক্লান্ত শরীরে সুরমা নদীতে গোসল করতে এসছিলেন পৌর শহরের ভ্যান গাড়ি চালক আব্দুল মজিদ। কিন্তু নদীর দুর্গন্ধ যুক্ত পানি আর নোঙরা অবস্থা দেখে কেবল হাত-পা ধুয়ে চলে যেত হয় তাকে। এ সময় তার সঙ্গে কথা হলে তিনি বলেন, ‘এই সুনামগঞ্জের ( শহর ) বুকে একটা মাত্র নদী। এই নদীর মাঝে ময়লা-আবর্জনা ফালাইন, গন্ধ করে তাও হাত পা ধুই-গোসল করি। এই নদী ছাড়া আর তো পানি নেই । এখন একমাত্র সরকার প্রশাসনের লোক পাটাইয়া দিলে তো এটা আটকিবো। নইলে পাবলিকে কইয়া এটা আটাইতে পারতো না।’
ভ্যানচালকের মতো বিপাকে পড়েছেন হাওর পারের শত শত মানুষ। আব্দুল জলিলও অভিযোগ করে বলেন, ‘পলিথিনের ব্যাগে করে নদীতে যে ময়লা ফেলায়, এটা পচেও না গলেও না, বরং নদীর পানির ক্ষতি করে। এই নদীর ময়লা পানি খেলে বা থালা বাসন ধোলে অনেক ক্ষতি হয়। এ ছাড়াও নদীতে মাছ মারতে আসলে পলিথিলের কারণে গন্ধ লাগে। কিন্তু আমরা আর কি করব আমাদের নদীতে থাকতে থাকতে অভ্যাস হয়ে গেছে।’
সুনামগঞ্জ শহরের ষোলঘর এলাকার স্থানীয় বালু পাথর ব্যবসায়ী জয়নাল আবেদীন ঢাকাপ্রকাশ-কে বলেন, আমাদের শহরে দ্রুত বৃদ্ধি পাচ্ছে পলিথিন, যে কারণে নদী-নালা খাল-বিল, রাস্তাঘাটে অতিরিক্ত পলিথিনের আবর্জনা। দুর্গন্ধের কারণে আমরা নদীর পাড়ে এসে মুক্ত বাতাস খেতে পারি না। নদীর পারে এসে অনেক কষ্ট হচ্ছে। নদীর পাড়ে শুধু পলথিন আর পলিথিন। এ ব্যাপারে সুনামগঞ্জ পৌর মেয়রসহ যারা দায়িত্বে আছেন সবার দৃষ্টি আকর্ষণ করছি।
নিষিদ্ধ হওয়ার পরও প্রশাসনের চোখের সামনেই প্রকাশ্যে চলছে নিষিদ্ধ পলিথিনের রমরমা ব্যবসা। সরেজমিনে সুনামগঞ্জের বাজারগুলো ঘুরে দেখা যায়, পলিথিনের ব্যাপক ব্যবহার বেড়েছে। ক্ষুদ্র একটি জিনিস থেকে শুরু করে প্রতিটি পন্যই এখন পলিথিনের ব্যাগে করে ক্রেতাদের হাতে তুলে দেন দোকানিরা। আর এটা দেখার যেন কেউ নেই।
পলিথিন ব্যবহারে আইনি নিষেধাজ্ঞা সত্ত্বেও সব প্রয়োজনে পলিথিন ব্যবহার করছেন কেন? এই প্রশ্নের উত্তরে সুনামগঞ্জ সবজি বাজারের এক বিক্রেতা বলেন, আমরা বিকল্প কোনো ব্যাগ না পাওয়াতে এই পলিথিনের ব্যাগ ক্রেতাকে দিতে হয়। আমরা পলিথিনের বিকল্প কিছু পেলে এটা আর ব্যবহার করব না।
আইনজীবীরা মনে করেন,পলিথিন বন্ধে কঠোরভাবে আইন বাস্তবায়ন করতে হবে। আইন শুধু কাগজে-কলমে থাকলেই হবে না। অবৈধ এই পলিথিন বিরোধী ব্যাপক অভিযান পরিচালনা করতে হবে।
সুনামগঞ্জ জজকোর্টের সাবেক সভাপতি অ্যাডভোকেট মোহাম্মদ নজরুর ইসলাম শেফু ঢাকাপ্রকাশ-কে বলেন, আমরা জানি পরিবেশকে দূষণের কারণে পলিথিনকে সরকার নিষিদ্ধ করেছিল। কিন্তু ইদানিং আমরা পলিথিন বন্ধের ব্যাপারে সরকার বা আইনপ্রয়োগকারী সংস্থার পক্ষ থেকে কোনো ধরনের মোবাইল কোর্ট পরিচালনা করতে দেখছি না। মোবাইল কোর্ট পরিচালনা করা একান্তভাবে জরুরি। আমি একজন আইনজীবী হিসেবে মনে করি যেকোনো আইন হলে এই আইনকে প্রয়োগ করতে হবে। আইন শুধু কাগজে-কলমে থাকলে হয় না।
তিনি আরও বলেন, পলিথিন নিষিদ্ধ করা হয়েছে। আইন করা হয়েছে। তার শাস্তিও আছে কিন্তু মোবাইল কোর্ট পরিচালনা না করে যদি আইন বাস্তবায়ন করা না হয় তাহলে দেখা যাবে আমাদের দেশের পলি মাটির উর্বরতা শক্তি দিন দিন কমে যাবে এবং ফসল উৎপাদন কম হবে। এতে আমাদের দেশ উন্নয়নের চরম শিখরে পৌঁছাতে এই পলিথিন বাধা হয়ে দাঁড়াবে।
শহর নগর ছাড়িয়ে এখন হাওরের ফসলি জমি পর্যন্ত পৌঁছে গেছে নিষিদ্ধ পলিথিন। এখন হাওর পারের ফসল ফলানো কৃষকদের কাছে আতঙ্কের নাম পলিথিন ও প্লাস্টিক বর্জ্য।
হাওরপারের কৃষক সালাম মিয়া ঢাকাপ্রকাশ-কে বলেন, ‘এই যে পলিথিন আমাদের বহু ক্ষতি করে। এই পলিথিন আমাদের জমিনের নিচে পড়লে ধানের গুছাটা লাল হইয়া যায়। ধানে পানি পাইলেও জেতা হয় না। এ ছাড়া আমরা যে গাছ লাগাই এইগুলোও লাল হইয়া টেন্ডাইয়া থাকে। যদি এইগুলো এদেশে বন্ধ করিলাইন তাইলে আমদের কৃষকের জমি করতে অনেক সুবিধা হইবো।’
এ প্রসঙ্গে হাওর বিশেষজ্ঞ শামস শামীম ঢাকাপ্রকাশ-কে বলেন, হাওর এলাকা একটি বৈচিত্র্যময় এলাকা। বাংলাদেশের জীববৈচিত্র্য সমৃদ্ধ জল এবং মাছসহ জীব-বৈচিত্র্যের আধার বলা হয় এই হাওরকে। এখন এই হাওরের অস্তিত্ব নানা কারণে প্রতিনিয়ত হুকির মুখে পড়ছে। বিশেষ করে গত বন্যায় সুনামগঞ্জে যে বন্যা দেখা দিয়েছিল সেই সময় দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে মানুষজন পলিথিনে মোড়ানো ত্রাণ নিয়ে আসছিল এই হাওর অঞ্চলে এবং লাখ লাখ ত্রাণের পলিথিনের প্যাকেট হাওরে ও নদীতে ফেলা হয়েছিল। সেই বন্যার সময় নদী-নালা ও হাওরে ফেলানো লাখ লাখ পলিথিন স্তুপ আকারে দেখা দিয়েছে। এ ছাড়াও দৈনন্দিন জীবনে হাওরবাসী যে পলিথিন ব্যবহার করেন সেগুলোও অপরিকল্পিতভাবে ফেলে দেওয়া হয়। এটা জীববৈচিত্র্যের পাশাপাশি ভূ-প্রকৃতির জন্যও ক্ষতিকর। বিশেষ করে নাব্যতার কারণে যখন বন্যা হয় তখন পানি সহজেই লোকালয়ে এসে আঘাত করে এবং পানি ছাপিয়ে মানুষের দুর্ভোগের কারণ হয়ে দাঁড়ায়। পলিথিনও এই অঞ্চলের ভূ-প্রকৃতি বদলে দেওয়ায় বড় ভূমিকা রাখে।
চিকিৎসকদের মতে, পলিথিন ব্যাগ ব্যবহারে চর্মরোগ ও ক্যান্সারসহ বিভিন্ন জটিল রোগে আক্রান্ত হতে পারেন। এ ছাড়া পলিথিনে মাছ, মাংস মুড়িয়ে রাখলে এতে রেডিয়েশন তৈরি হয়ে খাবার বিষাক্ত হয়। পরিবেশ ও জনস্বাস্থ্য রক্ষার বিষয়টিকে সর্বোচ্চ গুরুত্ব দিতে হবে। এ ছাড়াও বর্তমানে ডেঙ্গু রোগের জন্যও পলিথিনকে দায়ি করলেন তারা।
এ বিষয়ে সুনামগঞ্জ সিভিল সার্জন ডা. আহম্মদ হোসেন ঢাকাপ্রকাশ-কে বলেন, পলিথিনে বর্জ্য আমরা যত্রতত্র ফেলাচ্ছি, এটা আমাদের স্বাস্থ্যের জন্য খুবই ক্ষতিকর। প্রথমত আমাদের নর্দমাগুলোতে পলিথিন আটকে থাকে। এতে পানি জমে থাকে। আর পানি জমে থাকায় মশার বংশ বৃদ্ধি পায়। বর্তমানে বাংলাদেশে ডেঙ্গু একটা হুমকির মতো হয়ে দাঁড়িয়েছে। পূর্বে শুধু ঢাকা শহরে দেখা মিললেও বর্তমানে গ্রামে-গঞ্জেও আমরা ডেঙ্গু পাচ্ছি। এই ডেঙ্গুর বংশ বৃদ্ধির জন্য এডিস মশা দায়ী, আর এই এডিস মশা বংশ বৃদ্ধি করে জমে থাকা পানিতে। আর এই পানিকে ধরে রাখছে পলিথিন। এ ছাড়া কিছু মানুষকে দেখা যায় বর্জ্য পদার্থ আগুনে পুড়াচ্ছে। পলিথিন পুড়ালে এর প্রভাব পরে মানবদেহ। এমনকি মানব শরীরে বাসা বাঁধতে পারে প্রাণঘাতী ক্যান্সারসহ বিভিন্ন মারাত্মক রোগ। এ বিষয়ে সর্বস্তরের মানুষের মধ্যে জনসচেতনতা সৃষ্টি করতে হবে বলে জানান তিনি।
বর্ষায় সৃষ্ট জলাবদ্ধতায় পৌরবাসীর ভোগান্তির জন্য পলিথিন-প্লাস্টিককে দায়ী করলেন সুনামগঞ্জ পৌর মেয়র নাদের বখত। তিনি ঢাকাপ্রকাশ-কে বলেন, আমাদের ড্রেনের মধ্যে প্লাস্টিকের বোতল ও পলিথিনের ব্যাগ নিজেরাই ফেলে দেই। এটা ফেলার পরে ওই জায়গাটা (ড্রেনেজ ব্যবস্থা) ব্লক হয়ে যায়। তাতে আমাদের ছোট ছোট খালগুলোও বিলপ্তির পথে।
পৌর মেয়র আরও বলেন, ভারতের মেঘালয়ের পাশেই সুনামগঞ্জ জেলার অবস্থান। তাই প্রচুর পরিমাণে বৃষ্টি হওয়ায় আমাদের ড্রেন ও খাল দিয়ে পানি নিষ্কাশন হয় না। বিধায় দ্রুত জলাবদ্ধতায় নিমজ্জিত হয়ে যায়। তাই শহরটাকে রক্ষা করতে সবাইকে সচেতন হতে হবে।
অবৈধ পলিথিন ব্যবহার ঠেকাতে পলিথিন বিরোধী অভিযান পরিচালনা করা হবে বলে জানালেন সুনামগঞ্জের অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক (সার্বিক) মোহাম্মদ জাকির হোসেন। তিনি ঢাকাপ্রকাশ-কে বলেন, পলিথিনের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার জন্য দুটি প্রচলিত আইন আছে। এই দুটি আইনের আওতায় মোবাইল কোর্ট পরিচালনা করা হয় এবং পরিবেশ অধিদপ্তরের কর্মকর্তাদের সমন্বয়েও করা হয়ে থাকে। এ ছাড়াও জেলা প্রশাসক সুনামগঞ্জ সব সময় সচেষ্ট আছে ও ভবিষ্যতেও এ ধরনের অভিযান চলমান থাকবে।