সীমান্তে আশ্রয় নেওয়া দেড় হাজার রোহিঙ্গার খোঁজ নেই
শূন্যরেখায় আটকে পড়া ৫৫৮টি পরিবারের প্রায় সাড়ে চার হাজার রোহিঙ্গার মধ্যে দেড় হাজারের বেশি রোহিঙ্গার কোনো খোঁজ পাওয়া যাচ্ছে না। সাড়ে চার হাজার রোহিঙ্গার দেখভাল করত আন্তর্জাতিক রেডক্রস ও রেড ক্রিসেন্ট কমিটি (আইআরসিআরসি)। এই সংস্থার দেওয়া রেশনেই চলত তাদের জীবন।
সম্প্রতি মিয়ানমারের নাগরিক রোহিঙ্গাদের সংগঠন 'আরসা ও আরএসও'র সংঘাতের জেরে শূন্য রেখার ক্যাম্প থেকে পালিয়ে বাংলাদেশে এসেছে প্রায় তিন হাজার রোহিঙ্গা।
জরিপ ও অনুসন্ধান চালিয়ে দেখা যাচ্ছে, এদের প্রায় দুই হাজার রোহিঙ্গা আগে থেকেই বিভিন্ন শরণার্থী শিবিরে নিবন্ধিত ছিলেন। কিন্তু নানা কারণে তারা শরণার্থী শিবির ছেড়ে শূন্য রেখার ক্যাম্পে গিয়ে আশ্রয় নিয়েছিলেন।
প্রসঙ্গত, মিয়ানমার সীমান্তে ধারাবাহিক সংঘাতের এক পর্যায়ে গত ১৮ জানুয়ারি নাইক্ষ্যংছড়ি উপজেলার কোনারপাড়া শূন্যরেখা ক্যাম্পে আরাকান রোহিঙ্গা স্যালভেশন আর্মি (আরসা) এবং আরাকান রোহিঙ্গা সলিডারিটি অরগানাইজেশনের (আরএসও) মধ্যে ব্যাপক গোলাগুলির ঘটনা ঘটে। এতে একজন নিহত এবং এক শিশুসহ দুই রোহিঙ্গা আহত হন। ওইদিন পুরো ক্যাম্পটিতে আগুন ধরিয়ে দেওয়া হয়। তখন প্রাণে বাঁচতে ক্যাম্প ছাড়তে বাধ্য হন সেখানকার রোহিঙ্গারা। তাদের একটি অংশ বান্দরবানের নাইক্ষ্যংছড়ি উপজেলার তুমব্রু সীমান্তে এসে আশ্রয় নেয়। পরে সেখানেই খোলা আকাশের নীচে অস্থায়ী সামিয়ানা টাঙ্গিয়ে গত দুই সপ্তাহ ধরে তারা জীবন কাটাচ্ছেন।
অনুসন্ধানে আরও জানা যায়, এসব রোহিঙ্গার বিষয়ে পদক্ষেপ নিতে প্রশাসন, আরআরআরসি, আইনশৃঙ্খলা বাহিনী ও আন্তর্জাতিক সংস্থার প্রতিনিধিদের নিয়ে একটি জাতীয় টাস্কফোর্স কমিটি গঠিত হয়। সেই কমিটি গত রবিবার ও সোমবার দুই দিনে তাদের গণনার কাজ শেষ করে। এরপর মঙ্গলবার জরিপের ফলাফল ঘোষণা করে শরণার্থী, ত্রাণ ও প্রত্যাবাসন কমিশন (আরআরআরসি)।
ঘোষিত জরিপের ফলাফলে জানানো হয়, শূন্য রেখা থেকে পালিয়ে তুমব্রু সীমান্তে আশ্রয় নিয়েছে ৫৫৮টি রোহিঙ্গা পরিবারের ২ হাজার ৯৭০ জন সদস্য। তাদের উখিয়া ও টেকনাফের বিভিন্ন ক্যাম্পে স্থানান্তরের জন্য সিদ্ধান্ত নিয়েছে টাস্কফোর্স।
জানা গেছে, পালিয়ে আসা রোহিঙ্গার বিষয়ে ব্যবস্থা নিতে একটি জাতীয় টাস্কফোর্স কমিটি গঠন করা হয়েছে। এরই অংশ হিসেবে এসব রোহিঙ্গা আগে থেকে কোনো ক্যাম্পে নিবন্ধিত কি-না সেটাও যাচাই-বাছাই করা হয়। যাচাই-বাছাই শেষে জানানো হয়, এদের মধ্যে দুই-তৃতীয়াংশ রোহিঙ্গা আগে থেকেই কক্সবাজারের বিভিন্ন ক্যাম্পের নিবন্ধিত বাসিন্দা। পরে কোনো সময় তারা সেখান থেকে শূন্য রেখায় গিয়েছেন। বাকি এক-তৃতীয়াংশ অনিবন্ধিত। তারা আগে থেকেই শূন্য রেখার ক্যাম্পে বসবাস করছিলেন।
তাহলে প্রায় দুই হাজার রোহিঙ্গা কেন শিবির ছেড়ে সেখানে গিয়েছিলেন- এর জবাবে শরণার্থী, ত্রাণ ও প্রত্যাবাসন কমিশনার মো. মিজানুর রহমান চৌধুরী বলেন, ‘অনেকগুলো কারণ থাকতে পারে। দুটি স্থানের ক্যাম্পের ব্যবস্থাপনা সম্পূর্ণ আলাদা। দুটি জায়গায় দুটি তরফ থেকে রেশন ও অন্যান্য সুবিধা পেয়ে থাকেন রোহিঙ্গারা। তখন ডবল রেশনের লোভেও তারা সেখানে যেতে পারেন।’
তিনি বলেন, ‘শূন্য রেখায় বাংলাদেশ বা মিয়ানমারের প্রশাসন, আইনশৃঙ্খলা বাহিনী কারও কোনো প্রভাব নেই। অনেক সময় দেখা যায়, এখানে শিবিরে রোহিঙ্গারা অপরাধ করে। তাদের নামে মামলা ও গ্রেপ্তারি পরোয়ানা হয়। সেই মামলা থেকে বাঁচতে তারা সেখানে চলে যায়। ফলে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী তাদের নাগাল পায় না। ফলে অপরাধ করে পার পেতে সেখানে চলে যেতে পারেন। সেটাও হতে পারে।’
নিষেধাজ্ঞার পরেও তারা ক্যাম্প ছেড়ে বেরিয়ে শূন্য রেখায় কীভাবে গেল- এমন প্রশ্নের জবাবে মিজানুর রহমান আরও বলেন, ‘এখানে আমাদের আইনশৃঙ্খলা বাহিনী নিরাপত্তার দায়িত্বে আছে। তারা সবটুকুই করেন। বিরাট ক্যাম্প। এখানকার নিবন্ধিত রোহিঙ্গাদের মধ্যে কেউ অপরাধী হলে সেটা আইনশৃঙ্খলা বাহিনী দেখবে।
রোহিঙ্গা ক্যাম্পের নিরাপত্তার দায়িত্বে থাকা ১৪ এপিবিএনের অধিনায়ক অতিরিক্ত উপ-মহাপরিদর্শক সৈয়দ হারুন অর রশিদ বলেন, ক্যাম্পের নিরাপত্তায় সর্বোচ্চ জোরদার করা হয়েছে। তারপরও চোরাই পথে হয়তো কেউ কেউ বাইরে চলে যায়। তাদের ধরে আবার ক্যাম্পে ফিরিয়ে আনা হয়।
তিনি আরও বলেন, এখন রোহিঙ্গাদের মধ্যে যারা মামলার আসামি তারা ক্যাম্পে ফিরলে অবশ্যই আমরা তাদের গ্রেপ্তার করব। আইনের আশ্রয় নেব।
এদিকে আরআরআরসির পক্ষ থেকে জানানো হয়েছে, নিবন্ধিতদের স্ব স্ব ক্যাম্পেই ফেরত পাঠানো হবে। যাদের বিরুদ্ধে মামলা ও অপরাধে জড়িত থাকার অভিযোগ আছে তা আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকে জানিয়ে দেওয়া হবে। আইনশৃঙ্খলা বাহিনী নিজেরাও এ ব্যাপারে তথ্য সংগ্রহ করছে। নিবন্ধনের আওতায় থাকা রোহিঙ্গাদের আপাতত উখিয়ার কুতুপালং ক্যাম্প সংলগ্ন ট্রানজিট ক্যাম্পে রাখা হবে।
শূন্য রেখায় থাকা সাড়ে চার হাজার রোহিঙ্গার মধ্যে দুই হাজার ৯৭০ জন রোহিঙ্গার তথ্য পাওয়া গেলেও বাকিরা কোথায় তা বলতে পারছেন না কেউ। তবে এ ব্যাপারে প্রশাসন খোঁজ-খবর নিচ্ছে জানিয়ে আরআরআরসি মিজানুর রহমান চৌধুরী বলেন, প্রাথমিকভাবে ধারণা করা হচ্ছে, এসব রোহিঙ্গাদের কেউ কেউ মিয়ানমারের অভ্যন্তরে চলে গেছে বা বাংলাদেশের কোথাও আত্মগোপন করেছে অথবা বিভিন্ন ক্যাম্পে আশ্রয় নিয়েছে।
এসআইএইচ