কর্ণফুলী টানেলের কাজ শেষের পথে, খুলছে ফেব্রুয়ারিতে
চট্টগ্রামে বহুল প্রতীক্ষিত টানেলে পুরোদমে যানবাহন চলাচলের অপেক্ষার পালা শেষ হচ্ছে। আগামী ফেব্রুয়ারিতেই খুলছে টানেল এমনটিই জানালেন প্রকল্প সংশ্লিষ্টরা। কর্ণফুলী নদীর তলদেশে নির্মাণাধীন টানেলটির নাম 'বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান টানেল'। এখন চলছে শেষ মুহূর্তের কাজ।
টানেলের গুরুত্বপূর্ণ কাজের একটি অংশ পুরোপুরি শেষ। নিরাপত্তা বলয় তৈরি, বৈদ্যুতিক সংযোগের কাজও শেষের পথে। আর ফেব্রুয়ারিতে টানেলটি চালু হওয়ার মাধ্যমে স্বপ্নের স্বার্থক রুপ লাভ করবে। ইতিমধ্যে খসড়া টোল হার নির্ধারণ করা হয়েছে। চালুর আগেই তা চূড়ান্ত করা হবে। টানেলটি শুধু বাংলাদেশ নয় পুরো দক্ষিণ এশিয়ার জন্য বড় একটি দৃষ্টান্ত বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা।
এ ব্যাপারে শুক্রবার (৬ জানুয়ারি) কর্ণফুলী টানেল নির্মাণ প্রকল্পের পরিচালক মো. হারুনুর রশীদ বলেন, টানেলের কাজ প্রায় শেষ বলা যায়। তবে শেষ মুহূর্তের কিছু কাজ বাকি আছে। তাই এখনই টানেল খুলে দেওয়া হচ্ছেনা। আমরা টানেল নির্মাণে নিরাপত্তা দিক সহ সব ধরনের বিষয় খতিয়ে দেখেছি। কোথাও কোন ধরনের ঘাটতি নেই। আশা করছি আগামী ফেব্রুয়ারি মাসে টানেল খুলে দেয়া হতে পারে। এটি চালু হলে এই অঞ্চলের উন্নয়নে বৈপ্লবিক পরিবর্তন হবে।
টানেল নির্মাণ নির্মাণ কাজ বাস্তবে আদৌ শুরু হবে কিনা তা নিয়ে জল্পনা কল্পনা ছিল। কিন্তু ২০১৬ সালের ১৪ অক্টোবর প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও চীনের প্রেসিডেন্ট শি জিনপিং প্রকল্পের ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করেন। এরপর টানেলের ধারনা বাস্তব রুপ লাভ করতে শুরু করে।
২০১৯ সালের ২৪ ফেব্রুয়ারি টানেলের নির্মাণকাজ আনুষ্ঠানিকভাবে উদ্বোধন করেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। এরপর থেকে শুরু হয় টানেলের মহাকর্মযজ্ঞ। মাঝখানে ভয়াবহ করোনা মহামারী টানেলের কাজের গতি শ্লথ করে দেয়। পরে পুরোদমে শুরু হয় কাজ। টানেলে প্রতিদিন প্রচুর যানবাহন চলাচল করবে বলে আশা করা হচ্ছে। বিশেষ করে ঢাকা-চট্টগ্রাম-কক্সবাজারমুখী যানবাহন বেশি চলবে।
টানেল চালুর পর বছরে ৬৩ লাখ গাড়ি চলাচল করতে পারবে বলে একটি সমীক্ষায় বলা হয়েছে। এই হিসাব ধরে দিনে চলতে পারবে ১৭ হাজার ২৬০টি গাড়ি। ২০২৫ সাল নাগাদ টানেল দিয়ে গড়ে প্রতিদিন ২৮ হাজার ৩০৫টি যানবাহন চলাচল করবে। যার মধ্যে অর্ধেক থাকবে পণ্যবাহী যানবাহন। ২০৩০ সাল নাগাদ প্রতিদিন গড়ে ৩৭ হাজার ৯৪৬টি এবং ২০৬৭ সাল নাগাদ ১ লাখ ৬২ হাজার যানবাহন চলাচলের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা আছে।
টানেলে যানবাহনের টোল কত হবে তা নিয়ে গেল বছর থেকে নানা কথা বলা হচ্ছে। বেশ বিতর্কও জমেছিল টোল নিয়ে। তবে টোল কত হবে তার একটি প্রস্তাবিত তালিকা করেছে বাংলাদেশ সেতু কর্তৃপক্ষ। সেতু কর্তৃপক্ষের খসড়া তালিকা ২০ ডিসেম্বর অনুমোদন দিয়েছেন সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের। এখন তা অর্থ মন্ত্রণালয়ের অনুমোদনের অপেক্ষায় আছে। অনুমোদন পেলেই টোলের হার চূড়ান্ত হবে। তবে টোলের হার চাহিদা অনুযায়ী পরিবর্তন করা হতে পারে বলে সেতু কর্তৃপক্ষ সূত্র জানিয়েছে।
খসড়ায় দেখা যায়, নির্ধারিত হার অনুযায়ী টানেল দিয়ে চলতে প্রাইভেটকার, জিপগাড়ি ও পিকআপকে ২০০ টাকা করে টোল দিতে হবে। মাইক্রোবাসকে ২৫০ টাকা। ৩১ কিংবা এর চেয়ে কম আসনের বাসকে ৩০০ টাকা। আবার ৩২ কিংবা তার চেয়ে বেশি আসনের বাসকে ৪০০ টাকা টোল দিতে হবে। পাশাপাশি পাঁচ টনের ট্রাককে ৪০০, পাঁচ থেকে আট টনের ট্রাককে ৫০০, আট থেকে ১১ টনের ট্রাককে ৬০০ টাকা টোল দিতে হবে। তবে টানেল দিয়ে চলবে না মোটর সাইকেল। টানেল প্রকল্পে রক্ষণাবেক্ষণ ও টোল আদায় করবে চীনা কোম্পানি।
গত বছর ১৮ মে অর্থনৈতিক বিষয় সংক্রান্ত মন্ত্রিসভা কমিটির সভায় এই কাজের জন্য চায়না কমিউনিকেশন্স কনস্ট্রাকশন কোম্পানি লিমিটেডকে নিয়োগের প্রস্তাব নীতিগতভাবে অনুমোদন দেওয়া হয় গত বছরের ২৬ নভেম্বর বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান টানেলের দক্ষিণ প্রান্তের একটি টিউবের পূর্তকাজের সমাপ্তি উদযাপন করা হয়েছে। এই উদযাপন অনুষ্ঠানে গণভবন থেকে ভার্চুয়ালি যুক্ত হন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা।
দেশের প্রথম এই টানেল নির্মিত হচ্ছে চীনের আর্থিক ও কারিগরি সহযোগিতায়। নদীর তলদেশে হওয়ায় যেকোনো সময় পানি জমতে পারে আশঙ্কায় টানেলের মধ্যে বসানো হচ্ছে ৫২টি সেচ পাম্প। টানেলে দুই প্রান্তে নির্মাণ করা হয়েছে প্রায় ৫ দশমিক ৩৫ কিলোমিটার অ্যাপ্রোচ সড়ক ও ৭৭২ মিটার দীর্ঘ ফ্লাইওভার।
প্রকল্প কাজে সংশ্লিষ্টরা জানান, টানেল চালু হলে চট্টগ্রাম নগরীর পরিধি দ্রুত পরিবর্তন হবে। অর্থাৎ পরিধি বাড়বে। চীনের সাংহাই শহরের আদলে ওয়ান সিটি টু টাউন পরিকল্পনার অংশ হিসাবেই নির্মিত হচ্ছে টানেল। টানেলের কাজ শেষ হওয়ার সঙ্গে পাল্লা দিয়ে আনোয়ারা উপজেলার অংশের জমির দাম বাড়ছে দ্রুত।
বিভিন্ন শিল্প গ্রুপ নতুন নতুন কারখানা স্থাপনের জন্য ইতিমধ্যে সম্ভাব্যতা যাচাই শুরু করেছে। মূল টানেলের দৈর্ঘ্য ৩ দশমিক ৩২ কিলোমিটার। তবে সংযোগ সড়কসহ টানেলের সর্বমোট দৈর্ঘ্য ৯ দশমিক ৩৯ কিলোমিটার। নদীর নিচে সুড়ঙ্গের মাধ্যমে তৈরি করা হয়েছে ১০ দশমিক ৮০ মিটার ব্যাসের দুটি টিউব। এর প্রতিটির দৈর্ঘ্য ২ দশমিক ৪৫ কিলোমিটার।
টানেলে টিউব দুটি থাকলেও সংযোগ পথ আছে তিনটি। এর মধ্যে একটি বিকল্প পথ হিসেবে প্রথম দুটির সঙ্গে যুক্ত থাকবে। দুই সুড়ঙ্গের মধ্যে প্রথম সংযোগ পথের দৈর্ঘ্য ১২ দশমিক ১৪ মিটার। দ্বিতীয় বা মধ্যবর্তী সংযোগ পথের দৈর্ঘ্য ১২ দশমিক ৩৪ মিটার। শেষটির দৈর্ঘ্য ১০ দশমিক ৭৪ মিটার। প্রতিটির ব্যাস গড়ে সাড়ে চার মিটার।
এএজেড