রংপুরে শীতে এক সপ্তাহে ১৫ শিশুর মৃত্যু
রংপুরে তীব্র শীতে কাহিল হয়ে পড়েছে নিম্ন ও মধ্যে আয়ের মানুষ। তাপমাত্রা ওঠা-নামা করার সঙ্গে বাড়ছে শীতজনিত রোগে আক্রান্ত শিশুর সংখ্যা। নিউমোনিয়া, ডায়রিয়া, শ্বাসকষ্ট, জ্বর, সর্দিসহ বিভিন্ন রোগে আক্রান্ত হয়ে বার্ন ইউনিটে ও শিশু ওয়ার্ডে প্রায় তিন শতাধিক রোগী ভর্তি করা হয়েছে। ভর্তি হওয়া শিশুদের মধ্য থেকে এক সপ্তাহে ১৫ শিশু ও নবজাতকের মৃত্যুর খবর পাওয়া গেছে। যা সপ্তাহে স্বাভাবিক মৃত্যুর চেয়ে দ্বিগুণ। এদের বয়স এক মাস থেকে চার বছরের মধ্যে।
এ বিষয়ে রংপুর মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের শিশু বিভাগের ৯ নম্বর ওয়ার্ডের ইনচার্জ ও জ্যেষ্ঠ স্টাফ নার্স শিখলি খাতুন বলেন, শীতজনিত রোগে শিশুরা ডায়রিয়ায় আক্রান্ত হচ্ছে। গত এক সপ্তাহের মধ্যে নিউমোনিয়া, ডায়রিয়াসহ বিভিন্ন রোগে আক্রান্ত প্রায় তিন শতাধিক শিশুকে ভর্তি করা হয়েছে।
রংপুর মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের শিশু ওয়ার্ড ঘুরে দেখা যায়, প্রতিটি শয্যায় একাধিক শিশু চিকিৎসা নিচ্ছে। শয্যা না পেয়ে অনেক শিশুকে মেঝেতে বিছানা পেতে রাখা হয়েছে। কোনো কোনো শয্যায় মায়েরা তাদের অসুস্থ শিশু সন্তানকে কোলে নিয়ে বসে আছেন। শিশুর সঙ্গে থাকা অভিভাবকদের ভিড়ে নার্স ও চিকিৎসকরা সেবা দিতে হিমশিম খাচ্ছেন।
রংপুর সিভিল সার্জন ও মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ জানিয়েছে, পৌষের দ্বিতীয় সপ্তাহ থেকে রংপুর অঞ্চলে শীতের তীব্রতা বাড়তে শুরু করেছে। তাপমাত্রা কমে আসায় শীতে শিশু ও বয়স্করা শীতজনিত রোগে কাবু হচ্ছেন। চলতি সপ্তাহের চেয়ে গত সপ্তাহে আক্রান্তের সংখ্যা বেশি ছিল। এখন পরিস্থিতি কিছুটা নিয়ন্ত্রণের মধ্যে রয়েছে।
গত সোমবার লালমনিরহাটের কালীগঞ্জ থেকে আড়াই মাস বয়সী শিশু আহনাফকে নিয়ে হাসপাতালে এসে ভর্তি করান তার মা আলো বানু। তিনি বলেন, শীতে হঠাৎ তার ছেলের সর্দি-কাশি দেখা দেয়। শীতের কারণে নিউমোনিয়া হয়েছে বলে চিকিৎসকরা তাকে জানিয়েছে।
রংপুর মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের শিশু বিভাগ সূত্রে জানা যায়, গত ২৮ ডিসেম্বর থেকে ৩ জানুয়ারি পর্যন্ত ১ সপ্তাহে ১৫ শিশুর মৃত্যু হয়েছে। এর মধ্যে রংপুরের মিঠাপুকুরের ১০ মাসের শিশু ওমর আলী, লালমনিরহাট পাটগ্রামের তিন বছরের শিশু, গাইবান্ধার নবজাতক, কুড়িগ্রামের চিলমারীর আড়াই বছরের শিশু, রংপুর নগরের শালবন এলাকার ১৯ মাসের মাহমুদুল নামের শিশু রয়েছে। আর মেডিকেলের শিশু ওয়ার্ডে সপ্তাহে সাত থেকে আটজনের মৃত্যু হয়েছে। এ বছর শীতের প্রকোপ বাড়ায় অন্যান্য রোগে আক্রান্ত শিশুরও মৃত্যুর হার বেশি।
শিশু ওয়ার্ডের চিকিৎসক ও নার্সরা বলছেন, দুটি শিশু ওয়ার্ডে দুই সপ্তাহ ধরে শিশু রোগী ভর্তির সংখ্যা শয্যার চেয়ে কয়েক গুণ বেশি। যাদের বয়স এক দিন থেকে চার বছর পর্যন্ত। শীতের আগে এই ওয়ার্ডে এভাবে এত রোগী থাকতে দেখা যায়নি।শীতের প্রকোপ বেড়ে যাওয়ায় নবজাতকদের শ্বাসকষ্ট, নিউমোনিয়া দেখা দেয়।
এ প্রসঙ্গে হাসপাতালটির শিশু বিভাগের রেজিস্ট্রার চিকিৎসক তানভীর চৌধুরী বলেন, শুধুমাত্র শীতজনিত রোগে এসব শিশুর মৃত্যু হয়নি। রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা এবং ওজনে কম থাকা নবজাতক শিশুদের স্বাভাবিক মৃত্যু হয়েছে।
এ বিষয়ে রংপুর মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের শিশু ওয়ার্ডের বিভাগীয় প্রধান ডা. সুজা উদ্দৌলা বলেন, শীতের প্রকোপ বেড়ে যাওয়ায় নবজাতকদের শ্বাসকষ্ট, নিউমোনিয়া দেখা দেয়। নবজাতকের ক্ষেত্রে কম ওজনের শিশু জন্মের সময় মাথায় আঘাত পাওয়া শিশুদের মৃত্যু হয়েছে। গরমের সময় তেমন সমস্যা না হলেও শীতের প্রকোপে এসব শিশুরা রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা হারিয়ে ফেলে।
রংপুর জেলা সিভিল সার্জন ডা. শামীম আহমেদ বলেন, শীতের কারণে নিউমোনিয়া, ডায়রিয়াসহ বিভিন্ন রোগের প্রকোপ দেখা দেয়। বহির্বিভাগে চিকিৎসা নিতে আসা শিশুদের মধ্যে যাদের অবস্থা সংকটাপন্ন মনে হচ্ছে তাদের ভর্তি করা হচ্ছে। শীতজনিত রোগে আক্রান্তের সংখ্যা এখন অনেকটা নিয়ন্ত্রণে রয়েছে।
এ ব্যাপারে রংপুর জেলা সিভিল সার্জন ডা. শামীম আহমেদ বলেন, শীতের কারণে নিউমোনিয়া, ডায়রিয়াসহ বিভিন্ন রোগের প্রকোপ দেখা দেয়। বহির্বিভাগে চিকিৎসা নিতে আসা শিশুদের মধ্যে যাদের অবস্থা সংকটাপন্ন মনে হচ্ছে তাদের ভর্তি করা হচ্ছে। তবে শীতজনিত রোগে আক্রান্তের সংখ্যা এখন অনেকটা নিয়ন্ত্রণে রয়েছে।
অন্যদিকে শীত নিবারণে খড়কুটো জ্বালিয়ে আগুন পোহাতে গিয়ে অগ্নিদগ্ধ হয়ে রামেক হাসপাতালের বার্ন ইউনিটে চিকিৎসাধীন অবস্থায় গত মঙ্গলবার দুই নারীর মৃত্যু হয়েছে। তারা হলেন-রংপুরের গঙ্গাচড়া উপজেলার আফরোজা (৩৭) ও পঞ্চগড়ের বোদা উপজেলার নছিমন বেওয়া (৬৮)। বর্তমানে হাসপাতালের বার্ন ইউনিটে চিকিৎসা নিচ্ছেন অগ্নিদগ্ধ ৩৩ জন। এদের মধ্যে পাঁচজনের অবস্থা আশঙ্কাজনক। কারো কারো শরীরের ৮০ শতাংশ, আবার কারো শরীরের ৪০ শতাংশ পুড়ে গেছে। অগ্নিদগ্ধদের মধ্যে নারী ও শিশুর সংখ্যা বেশি।
রংপুর মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের বার্ন ইউনিট সূত্রে জানা গেছে, গত ডিসেম্বর মাসে অগ্নিদ্বগ্ধ ৩৪ জন ভর্তি হয়েছিলেন। এদের চারজনকে ঢাকায় উন্নত চিকিৎসার জন্য রেফার্ড করা হয়েছে। এ ছাড়া গত মাসে বহির্বিভাগে ৪১ জনকে চিকিৎসা দেওয়া হয়েছে। বর্তমানে সরকারি কোনো অনুদান না পাওয়ায় চিকিৎসা সেবা ব্যাহত হচ্ছে।
এদিকে রংপুর আবহাওয়া অফিসের আবহাওয়াবিদ মোস্তাফিজুর রহমান বলেছেন, রংপুর অঞ্চলে ১৩ থেকে ৮ ডিগ্রি সেলসিয়াস তাপমাত্রা ওঠা-নামা করছে। বুধবার রংপুরে সর্বনিম্ন ১২ দশমিক ৫ ডিগ্রি সেলসিয়াম তাপমাত্রা রেকর্ড করা হয়েছে। চলতি জানুয়ারি মাসে শীতের তীব্রতা বাড়ার পাশাপাশি কয়েকটি শৈত্য প্রবাহের সম্ভাবনা রয়েছে।
এসআইএইচ