ভাঙা হচ্ছে খুলনার এরশাদ শিকদারের ‘স্বর্ণকমল’
খুলনায় অপরাধমূলক কর্মকাণ্ডে ফাঁসিতে মৃত্যুদণ্ড কার্যকর হওয়া এরশাদ শিকদারের সেই দোতলা বাড়ি 'স্বর্ণকমল' ভেঙে ফেলা হচ্ছে। গত কয়েকদিন ধরে চুপিসারে দোতলা বাড়ির একাংশের জানালা, ছাদ ও দেওয়াল হাতুড়ি দিয়ে ভেঙে ফেলছেন শ্রমিকরা। এতে নতুন করে জনমনে আগ্রহ তৈরি করেছে বাড়িটি।
বুধবার (৪ জানুয়ারি) সকালে নগরীর সোনাডাঙ্গা মজিদ সরণিতে অবস্থিত বাড়ির সামনে গিয়ে দেখা যায়, উৎসুক জনতা বাড়ির সামনে দাঁড়িয়ে ভেঙে ফেলার কাজ দেখছে ও ছবি তুলছে।
এলাকাবাসী জানান, প্রায় দুই ডজন হত্যাকাণ্ড, চাঁদাবাজি, দখল ও অপরাধমূলক কর্মকাজের অভিযোগে ১৯৯৯ সালে গ্রেপ্তার হন এরশাদ শিকদার। ২৪টি হত্যাকাণ্ডের বর্ণনা দিয়ে আদালতে তার বিরুদ্ধে জবানবন্দি দেন তারই দেহরক্ষী নুরে আলম। ২০০৪ সালে ১০ মে মধ্যরাতে খুলনা জেলা কারাগারে ফাঁসিতে ঝুলিয়ে এরশাদ শিকদারের মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করা হয়।
এদিকে ফুলনার সোনাডাঙ্গা মজিদ সরণিতে এরশাদ শিকদারের বিলাসবহুল দোতলা বাড়ি ‘স্বর্ণকমল' নিয়েও নানা কল্পকাহিনি ছড়িয়ে আছে। বাড়িটিতে গোপন কুঠুরি ও অস্ত্র ভাণ্ডারের কথাও শোনা যায়। ওই বাড়ির বিভিন্ন গোপন স্থানে নগদ কয়েক কোটি টাকা লুকানো ছিল। প্রায়ই জলসা বসতো বাড়িতে। শহরে নামিদামি ব্যক্তিরা যেতেন সেখানে। এরশাদ শিকদারের মৃত্যুর পর সাধারণ মানুষের আগ্রহের জায়গা ছিল 'স্বর্ণকমল'। দূরদূরান্ত থেকে মানুষ বাড়িটি দেখতে আসত।
তার ছেলে কামাল শিকদার জানান, তার বাবা এরশাদ শিকদার জীবিত থাকা অবস্থায় কেডিএর ১০ কাঠার এ প্লট নিজের ও শাশুড়ি ফরিদা বেগমের (বড় স্ত্রী খোদেজার মা) নামে কিনেন। পরে ফরিদা বেগম তার মেয়ে খোদেজার নামে পাঁচ কাঠা জমি হেবা দলিল করে দেন। আর এরশাদ শিকদারের মৃত্যুর পর তার নামের বাকি পাঁচ কাঠা সম্পত্তির মালিক হন দুই স্ত্রীসহ পাঁচ ছেলে-মেয়ে।
তিনি আরও জানান, বাড়ির ১০ কাঠা সম্পত্তির মধ্যে তার মা খোদেজার নামে থাকা পাঁচ কাঠা জমি আলাদা করা হচ্ছে। বাম পাশের ফাঁকা জমিসহ মূল ভবনের একাংশ ও মূল ভবনের পেছনে আরও একটি ছোট ভবন ভেঙে পাঁচ কাঠা জমি আলাদা করে ডেভেলপারকে দেওয়া হবে। বাকি পাঁচ কাঠা জমিতে মূল ভবনটি আগের মতোই থাকবে। কেডিএর অনুমতি নিয়ে বাড়িটি দুটি হোল্ডিংয়ে ১৩৫ ও ১৩৫ (ক) নামে আলাদা করা হচ্ছে।
এদিকে গতকাল সকাল থেকে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে আলোচিত বাড়িটি ভাঙার খবর ছড়িয়ে পড়ে। অনেকেই বাড়িটি শেষবারের মতো দেখতে ছুটে আসেন। আবার অনেকে এই বাড়ি না ভেঙে ইতিহাসের সাক্ষী হিসেবে সংরক্ষণের দাবিও জানান।
জানা যায়, এরশাদের দুই স্ত্রী খোদেজা ও সানজিদা নাহার শোভা। এরশাদ শিকদারের তিন ছেলে রয়েছে। তারা হলেন- মনিরুজ্জামান শিকদার জামাল, কামাল শিকদার ও হেলাল শিকদার। তারা পেশায় ব্যবসায়ী। এ ছাড়া সুবর্ণা ইয়াসমিন স্বাদ ও জান্নাতুল নওরিন এশা নামে এরশাদ শিকদারের দুই মেয়ে ছিল। যার মধ্যে এশা ২০২২ সালের ৩ মার্চ আত্মহত্যা করেন।
এরশাদ শিকদারের জীবন বৃত্তান্ত
এরশাদ শিকদারের জন্ম ঝালকাঠির নলছিটি উপজেলার মাদারঘোনা গ্রামে। তার বাবার নাম বন্দে আলী। ১৯৬৬-৬৭ সালে তিনি তার জন্মস্থান নলছিটি থেকে খুলনায় চলে আসেন। খুলনা আসার পর এরশাদ সেখানে কিছু দিন রেলস্টেশনের কুলির সহযোগী হিসেবে কাজ করেন। সেখান থেকেই ধীরে ধীরে রেললাইনের পাত চুরি করে বিক্রি করত এমন দলের সঙ্গে যোগ দেন। পরে তিনি তাদের নিয়ে নিজেই একটি দল গঠন করেন ও এলাকায় 'রাঙ্গা চোরা' নামে পরিচিতি পান। ১৯৭৬-৭৭ সালে তিনি ‘রামদা বাহিনী' নামে একটি দল গঠন করেন, যারা খুলনা রেলস্টেশন ও ঘাট এলাকায় চুরি-ডাকাতি এবং বিভিন্ন সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ডে লিপ্ত থাকত।
এ রামদা বাহিনী নিয়েই এরশাদ ১৯৮২ সালে ৪ ও ৫ নম্বর ঘাট এলাকা দখল করেন এবং এর একচ্ছত্র নিয়ন্ত্রক হিসেবে আত্মপ্রকাশ করেন। ১৯৮২ সালে তিনি জাতীয় পার্টিতে যোগদানের মাধ্যমে রাজনীতিতে প্রবেশ করেন। ১৯৮৮ সালের নির্বাচনে তিনি তৎকালীন ৮ নম্বর ওয়ার্ডের (বর্তমান ২১ নম্বর ওয়ার্ড) কমিশনার নির্বাচিত হন। ১৯৯১ সালে বিএনপি সরকার গঠনের পর এরশাদ শিকদার বিএনপিতে যোগ দেন। ১৯৯৭ সালের ২৬ ডিসেম্বর এরশাদ আবারও দল পরিবর্তন করে আওয়ামী লীগে যোগ দেন। কিন্তু সমালোচনার মুখে কিছু দিন পরই আওয়ামী লীগ থেকে বহিষ্কৃত হন। ১৯৯৯ সালে গ্রেপ্তার হওয়ার সময়ও তিনি ৮ নম্বর ওয়ার্ডের কমিশনার ছিলেন।
এসএন