কুড়িগ্রামে এসএসসি পরীক্ষার্থীর চেয়ে শিক্ষকই বেশি
দেশের উত্তরের জেলা কুড়িগ্রামে এসএসসি পরীক্ষার্থীর চেয়ে শিক্ষকের সংখ্যা বেশি। এবার জেলায় এসএসসি পরীক্ষার ফলাফলে ঘটেছে শতভাগ ফেল করার ঘটনাও। শিক্ষার্থী সংকট আর পড়ালেখায় শিক্ষার্থীর অনাগ্রহকে দায়ী করছেন সংশ্লিষ্টরা।
সরেজমিনে দেখা যায়, কুড়িগ্রাম সদর উপজেলার খামার বড়াইবাড়ি উচ্চ বিদ্যালয়ে ১৪ জন শিক্ষক, ৬ জন স্টাফ কর্মরত আছেন। এই বিদ্যালয়ে ২০২১-২২ সেশনে ৯ম শ্রেণিতে রেজিস্ট্রেশন করে ৪০ জন। কিন্তু ২০২২ সালের এসএসসি পরীক্ষায় ফরম ফিলাপ করেছে ১৬ জন। অথচ পরীক্ষায় মাত্র চারজন অংশ নিয়ে সবাই এসএসসি পরীক্ষায় ফেল করেছে। অংশ নেওয়া শিক্ষার্থীদের মধ্যে দুইজন মেয়ে স্বামীর বাড়ি থেকে পরীক্ষায় অংশ নেন। আর বাকি দুইজন ছেলে দারিদ্রতার কষাঘাতে কাজের জন্য ঢাকায় অবস্থান করে। সেখান থেকে এসে পরীক্ষায় অংশ নেয়। শতভাগ ফেলের ঘটনা না ঘটলেও সদরের যাত্রাপুর বালিকা উচ্চ বিদ্যালয়ের চিত্র প্রায় একই। এই বিদ্যালয়ের ৯ম শ্রেণিতে রেজিষ্ট্রেশন করে ৫১ জন। এসএসসিতে ফরম ফিলাপ করে ৪০ জন এবং পরীক্ষায় অংশ নেয় ৩৬ জন। যার মধ্যে ২০ জন পাস করে আর ফেল ১৮ জন। এই বিদ্যালয়ে শিক্ষক ১১ জন, স্টাফ ৪ জন।
আদর্শ উচ্চ বিদ্যালয়ের ৯ম শ্রেণিতে রেজিষ্ট্রেশন করে ৪২ জন এবং এসএসসিতে ফরম ফিলাপ করে ৩০ জন। তারা সবাই পরীক্ষায় অংশ নিলেও পাস করে ১৬ জন এবং ১৪ জন ফেল করে। এখানে শিক্ষকের সংখ্যা ৯ জন, স্টাফ ৪ জন এবং শূন্য পদ আছে ৪টি। অনন্তপুর বালিকা উচ্চ বিদ্যালয়ে ৯ জন শিক্ষক ও ৫ জন স্টাফ কর্মরত থাকলেও পরীক্ষায় অংশ নিয়েছে মাত্র ৪ জন। এর মধ্যে একজন ফেল।
সুন্দরগ্রাম পুটিকাটা উচ্চ বিদ্যালয় থেকে এসএসসি পরীক্ষায় অংশগ্রহণ করে ১৬ জন। এর মধ্যে ফেল ১২ জন। অথচ এই বিদ্যালয়ে ১৫ জন শিক্ষক এবং ৪ জন স্টাফ কর্মরত আছেন।
ভীমশর্মা উচ্চ বিদ্যালয় থেকে পরীক্ষায় অংশগ্রহণ করা ১৪ জনের মধ্যে ১১ জনই ফেল। এই বিদ্যালয়ে নিম্ন মাধ্যমিক এমপিওভুক্ত শিক্ষক ৭ জন, স্টাফ একজন।
খামার বড়াইবাড়ি উচ্চ বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক রেজাউল হক শতভাগ ফেলের কথা স্বীকার করে বলেন, মেয়েদের বিয়ে হয়ে যাওয়া, দারিদ্রতার কারণে ছেলেরা কাজের জন্য ঢাকাসহ বিভিন্ন স্থানে চলে যাওয়া এবং মাদ্রাসা শিক্ষার প্রতি অভিভাবকদের আগ্রহ বেড়ে যাওয়ায় শিক্ষার্থী সংকট। আর এ কারণে ফলাফল বিপর্যয় হয়েছে।
অনন্তপুর বালিকা উচ্চ বিদ্যালয়ের সহকারি শিক্ষক আঞ্জুমান আরা বেগম তার বিদ্যালয়ে ৯ জন শিক্ষক এবং ৫ জন স্টাফ কর্মরত থাকলেও পরীক্ষায় মাত্র ৪ জন অংশগ্রহণের বিষয়টি স্বীকার করেছেন।
যাত্রাপুর বালিকা উচ্চ বিদ্যালয় ভারপ্রাপ্ত প্রধান শিক্ষক আব্দুল মান্নান জানান, তার বিদ্যালয় থেকে রেজিষ্ট্রেশন করা সকল শিক্ষার্থী পরীক্ষায় অংশ নিতে পারেনি। কেননা চরাঞ্চল এবং নদী ভাঙন এলাকায় হওয়ায় শিক্ষার্থীরা বিভিন্ন জায়গায় স্থানান্তরিত হয়ে গেছে। এতে করে পড়ালেখা ব্যাহত হওয়ায় ফেলের হার বেশি।
ফেলের হার বেশি হওয়ার কথা স্বীকার করে ভীমশর্মা উচ্চ বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক আনোয়ার হোসেন বলেন, আমার বিদ্যালয়ে মাধ্যমিক পর্যায়ে ৫ জন ননএমপিও শিক্ষক। তারা ২০০৪ সাল থেকে মানবেতর জীবনযাপন করছেন।
খামার বড়াইবাড়ি গ্রামের অভিভাবক শাহেরা বেগম বলেন, স্কুলে ঠিক মতো মাস্টাররা আসে না, ক্লাসও হয় না। তাই দুই কলম শেখানোর জন্য সন্তানদের মাদ্রাসায় ভর্তি করে দিছি।
দেবিচরণ গ্রামের অভিভাবক শাবানা বেগম বলেন, অটো পাশের চিন্তা শিক্ষার্থীদের মাথায় ঢোকার কারণে এবার পড়াশোনা করেই নাই তারা। অভিভাবকরাও ততটা গুরুত্ব দেয় নাই।
এ ছাড়াও বিদ্যালয়ের প্রতি শিক্ষক, অভিভাবক, কমিটিসহ কর্মকর্তাদের সঠিক তদারকির অভাবে ছাত্র-ছাত্রীর উপস্থিতি ও ফলাফল হতাশাজনক বলে জানান স্থানীয়রা।
এ ব্যাপারে কুড়িগ্রাম শিক্ষা কর্মকর্তা শামছুল আলম বলেন, শিক্ষকের চেয়ে অনেক শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে এসএসসি শিক্ষার্থীর সংখ্যা কম রয়েছে। ফলাফল বিপর্যয় শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের পাশাপাশি যেসব প্রতিষ্ঠানে শিক্ষার্থীর সংখ্যা কম তাদের বিরুদ্ধেও ব্যবস্থা নেওয়ার দাবি জানান তিনি।
প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ না নিলে পড়ালেখায় জেলায় আরও বিপর্যয় ঘটার শঙ্কা প্রকাশ করেন এই কর্মকর্তা।
জেলা মাধ্যমিক কার্যালয় সূত্রে জানা যায়, কুড়িগ্রামের ৯টি উপজেলায় এমপিও ভুক্ত শিক্ষা প্রতিষ্ঠান রয়েছে ৫৪৪টি। এর মধ্যে নিম্ন মাধ্যমিক ৩২টি, মাধ্যমিক ২৭০টি, মাদ্রাসা ২০৩টি, স্কুল অ্যান্ড কলেজ ১২টি এবং কলেজ ২৭টি।
জেলা প্রাথমিক কার্যালয় সূত্রে জানা যায়, ১২৪০টি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় রয়েছে।
দিনাজপুর শিক্ষা বোর্ডের তথ্যানুযায়ী, কুড়িগ্রাম জেলায় ২০২২ সালে এসএসসি পরীক্ষায় মোট পরিক্ষার্থী অংশ নিয়েছিল ১৯ হাজার ২০৩ জন। এর মধ্যে জিপিএ-৫ পেয়েছে ২ হাজার ২০৩ জনসহ পাশ করেছে ১৪ হাজার ৪০৭জন। ছেলে শিক্ষার্থী ১০ হাজার ৩০৯ জনের মধ্যে ৭ হাজার ৭৫৫ জন এবং মেয়ে শিক্ষার্থী ৮ হাজার ৮৯৪ জনের মধ্যে ৬ হাজার ৬৫২ জন পাশ করেছে। জেলায় গড় পাশের হার ৭৫ দশমিক শূন্য ২ ভাগ।
এ ছাড়াও বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর তথ্যমতে, কুড়িগ্রামে ২০১১ সালে আদমশুমারীর তথ্যানুযায়ী ৪২ দশমিক ৫ এবং ২০২২ সালে ৬৪ দশমিক ৯৯ ভাগ।
এসআইএইচ