বিদ্যুতের ভুতুড়ে বিলে বিপাকে আশ্রয়কেন্দ্রের বাসিন্দারা
প্রধানমন্ত্রীর দেওয়া উপহারের চিলাবাড়ী আশ্রয়কেন্দ্রে ভুতুড়ে বিদ্যুৎ বিলের কারণে দিশেহারা হয়ে পড়েছেন গৃহহীন ৪০ পরিবারের সদস্যরা। সহায় সম্বলহীন হওয়া সত্ত্বেও বিদ্যুৎ বিলের ভোগান্তির শিকার এখন টাঙ্গাইল সদর উপজেলার চিলাবাড়ী আশ্রয় কেন্দ্রের পরিবারগুলো। প্রতি মাসে তাদের গুণতে হচ্ছে প্রায় এক থেকে দেড় হাজার টাকার বিদ্যুৎ বিল। বিদ্যুৎ বিভাগের বিরুদ্ধে এমন হয়রানির অভিযোগ তুলেছেন পরিবারগুলোর বাসিন্দারা। এ ছাড়াও পয়োনিষ্কাশন, জলাবদ্ধতা, যাতায়াত ব্যবস্থা, গৃহনির্মাণে ত্রুটিসহ নানা সমস্যায় দিন কাটাচ্ছেন আশ্রয়কেন্দ্রের লোকজন।
সরেজমিনে দেখা যায়, ২০১৯-২০ অর্থবছরে নির্মিত চিলাবাড়ী আশ্রয়কেন্দ্রে বসবাস করছেন ৪০টি পরিবারের দেড় শতাধিক সদস্য।
চিলাবাড়ী আশ্রয়কেন্দ্রে বসবাসরত গৃহিনী তিসার বৈদ্যুতিক কাস্টমার নম্বর- ৯৭০৯২৭৬৪ ও মিটার নম্বর-১৬৮০৪০। তার অভিযোগ, চলতি বছরের ২৮ আগস্ট বিদ্যুৎ বিল ১৬৭০ টাকা, সেপ্টেম্বর মাসে ১৯১৫ টাকা আর অক্টোবর মাসে বিল এসেছে ১৩৯৫ টাকা। প্রতি মাসে তার এই পরিমাণ বিল এলেও আশ্রয়কেন্দ্রের কোনো কোনো বাড়িতে বিলই দেওয়া হচ্ছে না। ভুতুড়ে ওই বিল পরিশোধ করতেই হিমশিম খাচ্ছেন তিনি।
তিনি আরও জানান, ১০ টি পরিবারের জন্য একটি টিউবওয়েলের বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে। সেই টিউবওয়েলের পানিতে আয়রন থাকায় তাদের খাওয়াসহ ব্যবহারে চরম সমস্যা হচ্ছে। এ ছাড়াও নেই ড্রেন ও যাতায়াতের রাস্তা। এ কারণে ব্যবহৃত পানি যাচ্ছে অন্যের জমিতে আর হাঁটাচলাও করতে হচ্ছে অন্যের জমির উপর দিয়ে। ব্যবহৃত ওই পানি আর হাঁট-চলার কারণে প্রায় প্রতিদিনই তাদের শুনতে হচ্ছে প্রতিবেশীদের কটু কথা।
গৃহিনী শাহনাজের বৈদ্যুতিক কাস্টমার নম্বর- ৯৭০৯০৫৬০ ও মিটার নম্বর- ১০৭০৩৯। চলতি বছরের ২৮ আগস্ট বিদ্যুৎ বিল ১০২৫, সেপ্টেম্বর মাসে ১২৭৮ আর অক্টোবর মাসে বিল এসেছে ১৪৭৭ টাকা। রিকশাচালক স্বামীসহ তিন সদস্যের সংসার তার। তিনি বলেন, ঘরে একটা ফ্রিজ, রাইস কুকার, ফ্যান আর লাইট ব্যবহার করি। মিটার দেখতে কেউ না এলেও প্রায় প্রতি মাসেই তাকে বিল দিতে হচ্ছে দেড় থেকে দুই হাজার টাকা। গরিব মানুষ বলেই তো আমরা আশ্রয়কেন্দ্রে এসেছি। এরপরও আমাদের গুণতে হচ্ছে ভুতুড়ে ওই বিদ্যুৎ বিলের টাকা। এত টাকা পরিশোধ করতে চরম কষ্ট হয়।
আশ্রয়কেন্দ্রের গৃহিনী আন্না খাতুন বলেন, যারা ব্যাটারিচালিত ভ্যানসহ নানা ধরনের বৈদ্যুতিক সরঞ্জাম চার্জ দিচ্ছেন, তাদের বিদ্যুৎ বিল এক থেকে দেড়শ টাকা বিল এলেও আমি ঘরে একটা ফ্যান আর বাল্ব ব্যবহার করি তাতেই প্রতি মাসে বিল আসছে ৭০০-৮০০ টাকা। গরিব মানুষ বলেই তো আমরা আশ্রয়কেন্দ্রে থাকি। ধনী হলে তো এখানে থাকতাম না। এত বিদ্যুৎ বিল আসায় চরম কষ্টে আছি। বিদ্যুৎ অফিসে বাড়তি বিলের বিষয়ে জানানো হলেও তারা বলেন বিল যা আসবে তাই দিতে হবে। আমরা গরিব মানুষ হওয়ায় তারা আমাদের কথা শুনেন না।
গৃহিনী রাহেলা খাতুন বলেন, একটা ফ্রিজ, ফ্যান আর লাইট ব্যবহার করি তাতেই বিদ্যুৎ বিল আসছে ১৪০০-১৫০০ টাকা। এই মাসে ১৪৭৭ টাকা বিল এসেছে। আমরা গরিব মানুষ এত টাকা বিল দিলে খামু কী। এ ছাড়াও পায়খানায় ময়লা জমে গেছে। সেটি ফেলার মত কোনো জায়গা না থাকায় চরম কষ্টে আছি। এ ছাড়াও ঘরগুলো তৈরিতে রয়েছে অনেক সমস্যা। হাত দিয়ে চিমটি দিলে খসে পড়ছে ঘরের প্লাস্টার। ড্রেনের ব্যবস্থাসহ চলাচলের রাস্তা না থাকায় বেশি কষ্ট ভোগ করছেন তারা।
আইয়ুব আলী বলেন, এক বছর হলো এই আশ্রয়কেন্দ্রে বসবাস করছি। বেশ কয়েকদিন ধরে পানির ট্যাংকির সমস্যায় আছি। পানি ব্যবহার করতে পারছি না। টানা বৃষ্টির কারণে ট্যাংকির নিচের মাটি সরে যাওয়ায় ট্যাংকিতে পানি উঠানো যাচ্ছে না। এ কারণে ট্যাংকির পানি ব্যবহার বন্ধ রয়েছে। ট্যাংকির পানিতে পর্যাপ্ত আয়রন। এরপরও ট্যাংকির পানি সরবরাহ ঠিক থাকলে তাদের পানি সমস্যা অনেকটা লাঘব হয়।
তিনি আরও বলেন, আশ্রয়কেন্দ্রের তাদের অংশের ১৬টি ঘরের খাওয়ার পানির চাহিদা মিটাতে একটি টিউবওয়েল দেওয়া হয়েছে। মাত্র একটি টিউবওয়েল ব্যবহার কষ্টকর বলেও জানান তিনি।
আশ্রয়কেন্দ্রে থাকা ঝর্না বেগম বলেন, থাকার জমি ছিল না, প্রধানমন্ত্রী থাকার ব্যবস্থা করে দিয়েছেন। এখানে আমরা ভালো আছি। পরিবারের সবজি খাওয়ার যোগান দিতে বাড়তি জমিতে লাউ আর বটবটি আবাদ করছি।
স্থানীয় দাইন্যা ইউনিয়নের ৪ নম্বর ওয়ার্ড চিলাবাড়ী গ্রামের ইউপি সদস্য শহীদ সরকার বলেন, ড্রেন, যাতায়াতের সড়ক না থাকাসহ টিউবওয়েলের পানিতে আয়রন উঠায় চরম সমস্যায় রয়েছে বলে আশ্রয় কেন্দ্রের বাসিন্দারা তার কাছে অভিযোগ করেছেন। তবে বিষয়গুলো দেখভালের দায়িত্বে আছেন উপজেলা প্রশাসন। তিনি বলেন, এই গ্রামে টিউবওয়েলের জন্য ৬০ ফুট পাইপ গাড়লেই ভালো পানি পাওয়া যেত, সেখানে টিউবওয়েলের পাইপ গাড়া হয়েছে ২০০ ফুট। এ কারণে ওই পানিতে আয়রন উঠছে।
টাঙ্গাইল বিদ্যুৎ বিক্রয় ও বিতরণ বিভাগ-২ এর নির্বাহী প্রকৌশল মো. শাহগির হোসেন জানান, আশ্রয়কেন্দ্রে কয়েকটি ডিজিটাল মিটার রয়েছে, এ ছাড়া বেশির ভাগই প্রিপেইড মিটার। তবে ডিজিটাল মিটারেও ভৌতিক বিল বা গড় বিল করার সুযোগ নেই। এ ছাড়াও কেউ আমাকে এমন কোনো অভিযোগ করেননি। এরপরও যদি এখন কোনো ভুক্তভোগী থেকে থাকেন, তিনি অভিযোগ করলে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
টাঙ্গাইল সদর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা রানুয়ারা খাতুন জানান, নদীসংলগ্ন আশ্রয়কেন্দ্রগুলোর ড্রেনেজ ও পয়োনিষ্কাশনের ব্যবস্থা করা হয়েছে। চিলাবাড়ী আশ্রয়কেন্দ্রের আশপাশে কোনো নদী বা খাল না থাকায় ড্রেনেজ ও পয়োনিষ্কাশনের সমস্যা নিরসন সম্ভব হয়নি। তবে সমস্যা সমাধানের পরিকল্পনা রয়েছে।
তিনি আরও জানান, টিউবওয়েল স্থাপনের কাজ করেছে জনস্বাস্থ্য প্রকৌশল বিভাগ। টিউবওয়েলের পানিতে পর্যাপ্ত আয়রন থাকায় ওই পানি ব্যবহার করতে সমস্যা হচ্ছে এমন অভিযোগ পেয়েই জনস্বাস্থ্য কর্তৃপক্ষকে বিষয়টি জানানো হয়েছিল। তবে কেন এখনো পানির সমস্যা নিরসন করা হয়নি বিষয়টি জনস্বাস্থ্য প্রকৌশল বিভাগ কর্তৃপক্ষের সঙ্গে কথা বলে জানতে পারব। দ্রুতই পানির সমস্যা সমাধান করা হবে বলে আশ্বাস প্রকাশ করেছেন তিনি।
এ বিষয়ে টাঙ্গাইল জনস্বাস্থ্য প্রকৌশলী অধিদপ্তরের নির্বাহী প্রকৌশলী মো. ইবনে মায়াজ প্রামাণিক জানান, টাঙ্গাইলের পানিতে পর্যাপ্ত আয়রন। পানি ব্যবহারের উপযোগী করতে আশ্রয়কেন্দ্রের টিউবওয়েলে ফিল্টার স্থাপনের সিদ্ধান্ত হয়েছে। আশা করছি খুব দ্রুতই কার্যক্রম শুরু করা যাবে।
এসএন