বেগমগঞ্জের ইউএনও’র বিরুদ্ধে দুর্নীতির অভিযোগ, অবশেষে বদলি
নোয়াখালীর বেগমগঞ্জ উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) শামছুন নাহারের বিরুদ্ধে নানা অনিয়ম, দুর্নীতি করে লাখ লাখ টাকা আত্মসাৎ ও ব্যাংক এবং ব্যক্তির মাধ্যমে অন্যত্রে টাকা পাচারের অভিযোগ উঠেছে। এলাকাবাসী জানায়, সাধারণ মানুষের সঙ্গে দুর্ব্যবহার, স্বজন প্রীতি ও ক্ষমতার অপব্যবহারে ইউএনও’র নানা অনৈকিত কর্মকাণ্ড এখন টক অব দ্যা নোয়াখালীতে পরিণত হয়েছে।
ইউএনওর এমন কর্মকাণ্ডে বিব্রত খোঁদ প্রশাসনের উর্ধ্বতন মহলও। ইউএনওর এসব দুর্নীতি, অনিয়মের তদন্ত ও আয়ের উৎস খতিয়ে দেখতে দুর্নীতি দমন কমিশনসহ উর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের হস্তক্ষেপ চেয়েছিল এলাকাবাসী। অবশেষে শনিবার (১৯ নভেম্বর) সন্ধ্যার দিকে ইউএনও শামসুন নাহারের বদলির খবর আসে। সেই খবর পেয়ে স্থানীয় এলাকাবাসী মিষ্টি বিতরণ করেছে বলে জানিয়েছে স্থানীয় গণমাধ্যম কর্মীরা।
অনুসন্ধানে জানা গেছে, মাত্র দুই মাসেই ইউএনও শামছুন নাহার বেগমগঞ্জ থেকে অর্ধ কোটি টাকা পাচার করেন। তিনি বিগত ১৩-৯-২০২২ তারিখে পিআইও অফিসের ওয়ান ব্যাংক চৌমুহনী শাখার একাউন্ট থেকে দুটি চেকের মাধ্যমে প্রথমে ১৫ লাখ এবং পরে আরো ৩ লাখ টাকা উত্তোলন করেন। গত ২৯-৯-২০২২ তারিখে ১০ লাখ ও ৩০-১০-২০১০ তারিখে আরো ১৮ লাখ টাকা উত্তোলন করেন অফিস স্টাফের মাধ্যমে। এসব টাকা অফিসের এক স্টাফের আইডি কার্ড ব্যবহার করে ওয়ান ব্যাংক চৌমুহনী শাখা থেকে উত্তোলন করে যমুনা ব্যাংক চৌমুহনী শাখার মাধ্যমে কুমিল্লার নাঙ্গলকোর্টে পাঠান বলে জানা গেছে। এক্ষেত্রে নাঙ্গলকোর্টের আধুনিক ডায়াগনেষ্টিক সেন্টার (একাউন্ড নম্বর-১১৯-০২১০০০৩২০৬), যমুনা ব্যাংক, নাঙ্গলকোর্ট শাখা ও পাটোয়ারী জেনারেল হাসপাতাল (একাউন্ট নম্বর-২০৫০৪৪৮০১০০০০০৩০৬) ও ইসলামী ব্যাংক, নাঙ্গলকোর্ট শাখা ব্যবহার করা হচ্ছে।
এ ছাড়াও উপজেলা নির্বাহী অফিসার শামছুন নাহারের বিরুদ্ধে গত ২ বছরে বেগমগঞ্জ থেকে কয়েক কোটি টাকা পাচার করার অভিযোগ রয়েছে। পাচারকৃত এসব টাকা দিয়ে তিনি নিজের বাবার নামে ঢাকার মিরপুর-১৪ নম্বরে বাড়ি করছেন বলেও সূত্র জানিয়েছে।
তা ছাড়াও উপজেলা পরিষদের অভ্যন্তরে আনসার সদস্যদের জন্য ভবন নির্মাণের জন্য ২১ লাখ টাকা বরাদ্ধ হলেও ভবনের ছাদ, পিসি রুম ও অস্ত্রাগার নির্মাণ না করে নামমাত্র ভবন করে টাকা আত্মসাৎ করেন। এমনকি অফিসের বই কিনার নামে টাকা আত্মসাৎ, এডিবির, টিআর, কাবিটা প্রকল্প ও ১ পার্সেন্টের টাকা ইউনিয়ন পরিষদের নামে সুষম বন্টন না করে টাকা আত্মসাতেরও অভিযোগ রয়েছে ইউএনও‘র বিরুদ্ধে।
একাধিক বিশ্বস্ত সূত্র আরো জানায়, ইউএনও শামছুন নাহারের বিরুদ্ধে ভূমিহীনদের জন্য মুজিববর্ষের ঘর নির্মাণে অনিয়ম, ইট ভাটার মালিকদের থেকে মোবাইল কোর্টের ভয় দেখিয়ে ইট ও টাকা আদায়, উপজেলা পরিষদ ভবনের পূর্ব পাশে একটি বাড়ি একটি খামার প্রকল্পের ভবন নির্মাণে ১১ লাখ টাকা বরাদ্ধ দেখিয়ে নামমাত্র কাজ করে টাকা আত্মসাৎ, বঙ্গবন্ধু বঙ্গমাতা টুর্নামেন্টের নামে মাত্র একটি খেলার আয়োজন করে মোটা অংকের টাকা আত্মসাৎ, বিভিন্ন দিবসের নামে টাকা আদায় ও খরচের নামে টাকা আত্মসাৎ, ২০২১-২২ অর্থবছরে জেলা প্রশাসক উপজেলা পরিষদের পার্ক, মাঠ ভরাট ও পুকুরের গাইড ওয়াল নির্মাণের নামে একাধিক প্রকল্প দিয়ে মোটা অংকের টাকা আত্মসাৎ। এ ছাড়াও প্রতিটি ঘর বাবদ ঘরের মালিকদের কাছ থেকে ২০ হাজার থেকে ৫০ হাজার টাকা আদায় করা। ২০২০-২০২১ অর্থবছরে এডিপি থেকে ৪টি প্রকল্প নিয়ে দুঃস্থ মহিলাদের জন্য সেলাই মেশিন ক্রয় দেখিয়ে টাকা আত্মসাৎ, বেগমগঞ্জ স্টেডিয়ামে চেয়ার সরবরাহের নামে টাকা আত্মসাৎ, উপজেলা কালচালার একাডেমির বিভিন্ন সংস্কার কাজের নামে টাকা আত্মসাৎ। ২০২০-২০২১ অর্থবছরে দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা মন্ত্রণালয়ের অধীনে ৩০০টি চাদর ক্রয়ের নামে টাকা আত্মসাৎ, উপজেলা পরিষদের হল রুমের সংস্কার কাজের নামে টাকা আত্মসাৎ, নিজের বাসায় সংস্কারের নামে একাধিক প্রকল্প দেখিয়ে নামমাত্র কাজ করে মোটা অংকের টাকা আত্মসাৎ করেন তিনি। উপজেলা পর্যায়ের বিভিন্ন অফিসের কর্মকর্তা-কর্মচারীদের বার্ষিক প্রশিক্ষণ কর্মশালার জন্য মোটা অংকের টাকাও বরাদ্ধ দেওয়া হয়। ইউএনও শামছুন নাহার নামমাত্র কর্মশালা দেখিয়ে বাকি টাকা আত্মসাৎ করেন। ইউএনও শামছুন নাহারের এমন অনিয়ম ও দুর্নীতি নিয়ে উপজেলা প্রশাসনের কর্মকর্তা কর্মচারী, ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান, বিভাগীয় কর্মকর্তাদের মধ্যে চরম অসন্তোষ দেখা দিয়েছে। সাধারণ মানুষ উপজেলায় সেবা নিতে গেলে তাদের সঙ্গেও দুর্ব্যবহার করেন তিনি। এ নিয়ে জনমনেও ক্ষোভের সৃষ্টি হয়েছে। ক্ষুন্ন হচ্ছে সরকারের ভাবমূর্তিও। যেকোনো সময় দেখা দিতে পারে জনবিষ্ফোরণ।
বেগমগঞ্জ উপজেলা ক্রীড়া সংস্থার কোষাধ্যক্ষ আনোয়ার হোসেন জন্টু ক্ষোভ প্রকাশ করে বলেন, ‘আজ ৯ থেকে ১০ বছর কমিটিতে আছি। আমি কোষাধ্যক্ষ হিসেবে কিছুই জানি না। কোনও মিটিংও হয় না। কত টাকা সংস্থার জন্য বরাদ্ধ হয় বা খরচ হয় কিছুই আমাদের জানানো হয় না।
নোয়াখালী জেলা ইটভাটা মালিক সমিতির সভাপতি আজিজুল বাশার স্বপন জানান, আমরা এমনিতেই উপজেলার যে কোনও বিষয়ে সহযোগিতা করে থাকি। কিন্তু চাপ প্রয়োগ করে কেউ কিছু করতে চাইলে তা সহ্য করার কথা নয়। তিনি নানা অজুহাতে আমাদের ইট ভাটা মালিকদের কাছ থেকে ইট আদায় করেন। না দিলে হুমকি দেন।
বেগমগঞ্জ উপজেলা চেয়ারম্যান সমিতির সাবেক সভাপতি এবং আমান উল্যাহপুর ইউনিয়নের সাবেক চেয়ারম্যান ও ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের সভাপতি আরিফুর রহমান মাহমুদ আরিফ জানান, আমরা ইউএনও শামছুন নাহারের অনিয়ম ও দুর্নীতির প্রতিবাদ করায় রোষালনে পড়েছি। আমার বিরুদ্ধে উপজেলা পরিষদ মিটিংয়ে রেজুলেশন করা হয়েছে। ইউএনও’র দুর্নীতির বিরুদ্ধে প্রতিবাদকারী নৌকা মার্কার চেয়ারম্যান প্রার্থীদের ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচনে পরাজিত করতে তিনি নেপথ্যে কাজ করছেন। যেই ইউএনও’র বিরুদ্ধে কথা বলেছে, সেই রোষানলে পড়েছে।
বেগমগঞ্জ উপজেলা চেয়ারম্যান সমিতির সভাপতি আবেদ সাইফুল কালাম ও সাধারণ সম্পাদক সালাহ উদ্দিন জানান, বেগমগঞ্জের ইতিহাসে এমনই উএনও আমরা দেখিনি। তিনি নিজে সব কিছু করতে চান। টাকা ছাড়া কিছুই বুঝেননা। আমাদের চেয়ারম্যানদের সাথে দূর্ব্যবহার করেন। প্রকল্পের টাকা আত্মসাত করেন। যা আমরা ডিসি মহোদয়কে জানিয়েছি। আমরা সবাই ডিসি মহোদয়ের সাথে দেখা করেছি। তিনি বিষয়টি দেখবেন বলে জানিয়েছেন।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে বেগমগঞ্জ উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) শামছুন নাহার বলেন, আমার ডিপার্টমেন্ট আছে ওনারা দেখবেন। মিডিয়ার কাছে আমি কিছু বলতে বাধ্য নয়। বিএনপি-জামায়াত-শিবিরের মানসিকতার লোকেরা সাপ্তহিক অপরাধ বিচিত্রাসহ ফেসবুকে ভাইরাল করছে ও অপ্রপচার চালাচ্ছে। আমি এর তীব্র নিন্দা জানাচ্ছি।
এ ব্যাপারে নোয়াখালী জেলা প্রশাসক দেওয়ান মাহবুবুর রহমান বলেন, বেগমগঞ্জ উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তার দুর্নীতির বিষয়ে কেউ অভিযোগ করেনি। ইতিমধ্যে সে বদলি হয়ে গেছে।
অপর এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, সে এখানে অনেক দিন কাজ করেছে। এ জন্য বদলি করা হয়েছে।
এসআইএইচ