আওয়ামী লীগ নেতার দখলে সাভার পাবলিক লাইব্রেরি

সাভার পাবলিক লাইব্রেরি এখন আওয়ামী লীগ নেতার রাজনৈতিক কার্যালায়ে পরিণত হয়েছে। বছরের পর বছর রাজনৈতিক সভা-সেমিনার করার জন্য লাইব্রেরিটি ব্যবহার করছেন ওই আওয়ামী লীগ নেতা। তিনি প্রয়োজন হলে তালা খুলে ভিতরে প্রবেশ করেন। আবার প্রয়োজন শেষ হলে দরজায় লাগানো হয় তালা। ফলে দীর্ঘদিন ধরে লাইব্রেরিতে বসে বই পড়ার সুযোগ থেকে বঞ্চিত হচ্ছে সাভারবাসী। পাঠক শ্রেণির মানুষ বাধ্য হয়ে আড্ডা দিচ্ছেন চায়ের দোকানে।
খোঁজ নিয়ে জানা যায়, ১৯৩৯ সালে রাখাল চন্দ্র মেমোরিয়াল হল নামে এই লাইব্রেরিটি প্রতিষ্ঠিত হয়। এরপর কয়েক যুগ এখানেই পাঠকরা তাদের মনের খোরাক মেটাতো। মানুষ অবসর সময় পেলেই বই পড়তে ছুটে আসত এ লাইব্রেরিতে। তবে ঢাকা জেলা আওয়ামী লীগের সদ্য সাবেক যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক মাসুদ চৌধুরী লাইব্রেরির সাধারণ সম্পাদকের দায়িত্ব পাওয়ার পর থেকে পাঠকশূন্য হয়ে পড়ে লাইব্রেরিটি। গত ২০ বছর ধরে এটিই ব্যক্তিগত অফিস হিসেবে ব্যবহার করছেন তিনি।
ঢাকাপ্রকাশের অনুসন্ধানে জানা যায়, ঢাকা জেলা আওয়ামী লীগের সদ্য সাবেক যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক মাসুদ চৌধুরী ওই পাবলিক লাইব্রেরিটি ব্যবহার করছেন নিজের ইচ্ছামতো। মাঝেমধ্যে লাইব্রেরিতে বসে ব্যক্তিগত কাজ সম্পাদন করতে দেখা যায় তাকে। ভিতরে গ্লাসের বেষ্টনীতে আলাদা কেবিন। নামে লাইব্রেরির অফিস কক্ষ হলেও মূলত এটিতে বসে রাজনৈতিকসহ ব্যক্তিগত কাজ করে চলেছেন তিনি। এই লাইব্রেরিতে চলে রাজনৈতিক ভোজ, বিচার কার্য থেকে শুরু করে নানা ধরনের কাজ। ফলে পাঠক লাইব্রেরিতে না আসায় বইয়ে পড়েছে ধুলার স্তর।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে সাভার বিশ্ববিদ্যালয় কলেজের সাবেক ছাত্রলীগ নেতা বলেন, মাসুদ চৌধুরী পাবলিক লাইব্রেরিটিকে ব্যক্তিগত অফিস বানিয়ে ফেলেছে। সেখানে বসেই বিচার কাজ থেকে শুরু করে রাজনৈতিক সকল কাজ করেন তিনি। ফলে সেখানে বই পড়তে যাওয়ার মতো লোক খুঁজে পাওয়া যায় না। সাধারণ মানুষ রাজনৈতিক নেতাকে এমনিতেই একটু বড় মাপের মানুষ ভেবে তাদের কাছে কম যেতে চান। এ ছাড়া রাজনৈতিক প্রভাব থাকলে তো অনেকেই ভয় পান।
স্থানীয় বাসিন্দা মো. সালাম বলেন, পাবলিক লাইব্রেরি থাকলেও সেখানে বসে জ্ঞান চর্চা করা যায় না। বইও ছিল অনেক। তবে লাইব্রেরি থাকে তালাবদ্ধ অবস্থায়। সেখানে যাওয়ার তো কোনও পরিবেশ নেই। এখানে লাইব্রেরির সাধারণ সম্পাদক বসেন। জেলা পর্যায়ের রাজনৈতিক নেতা তিনি, তার আশপাশে সবসময় নেতা-কর্মী থাকে। এ কারণে অনেকেই লাইব্রেরিতে যায় না। আমি নিজেও যাই না।
এ ব্যাপারে সাভার অধরচন্দ্র উচ্চ বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক রতন পিটার গোমেজ বলেন, সাভার পাবলিক লাইব্রেরি এক সময় স্কুলেরই ছিল। এটা পাবলিক লাইব্রেরি জনগণের জন্য। সেখানে সবাই যাবে, বই পড়বে। সমসাময়িক বিষয় নিয়ে আলাপ আলোচনা করবে। স্বর্গীয় রাখাল চন্দ্র সাহা সাভারে এটিসহ তিনটি প্রতিষ্ঠান একসঙ্গে করেছেন। অধরচন্দ্র সরকারি হাইস্কুল, রাখাল চন্দ্র পাবলিক লাইব্রেরি ও তারাপুরের খেলার মাঠ। পরবর্তীতে স্থানীয়রা এটা কি হিসেবে কি করছে তারাই ভালো জানেন।
পাবলিক লাইব্রেরিকে ব্যক্তিগত অফিস বানিয়ে রাজনৈতিক ও বিচার কাজ সম্পাদনের ব্যাপারে তিনি বলেন, এটা আসলে হওয়ার কথা না। এটা যে উদ্দেশে দেওয়া হয়েছে সেটাই করা উচিত। এটার তো এখন সভাপতি ইউএনও। তবে রাজনৈতিক অফিস করে নেওয়ার ব্যাপারে কোনও মন্তব্য করব না।
এ প্রসঙ্গে সাভার উপজেলা সম্মিলিত সাংস্কৃতিক জোটের সাধারণ সম্পাদক স্মরণ সাহা বলেন, পাবলিক লাইব্রেরিটি সকলের জন্য উম্মুক্ত করে দেওয়া হোক। যাতে সকল শিক্ষানুরাগীরা জ্ঞান চর্চা করতে পারেন।
এদিকে অভিযুক্ত লাইব্রেরির সাধারণ সম্পাদক ও ঢাকা জেলা আওয়ামী লীগের সাবেক যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক মাসুদ চৌধুরী বলেন, এটি রাজনৈতিক ষড়যন্ত্র। তবে এই লাইব্রেরিতে রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডের কথা স্বীকার করলেও এর কোনও প্রভাব শিক্ষার্থীদের উপর পড়ে না বলে দাবি করেন তিনি।
তিনি আরও বলেন, এখান থেকে করোনার সময় খাদ্য দ্রব্য বিতরণ করা হয়েছে। গত পৌরসভা নির্বাচনে ১২ দিন ১ ঘণ্টা করে এটি ব্যবহার করা হয়েছে। জাতীয় নির্বাচনেও এটি তিন থেকে ৪ দিনের জন্য ব্যবহার করা হয়েছে। দুই-একটা মিলাদ ছাড়া এখানে নদী রক্ষা কমিটি মিটিং করেছে। তবে এসব কিছুর প্রভাব পাঠকদের উপর পড়ে না। এটাতে আগে জুয়া খেলা হতো সেটা এখন নেই। এখন তো এটার একটা পরিবেশ রয়েছে।
এ বিষয়টি নিয়ে লাইব্রেরির সভাপতি উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা(ইউএনও) বলেন, পাবলিক লাইব্রেরিটি যে ভবনে সেটি জরাজীর্ণ এবং প্রায় ব্যবহার অনুপযোগী। বিভিন্ন সময় এটি সংস্কার করে ব্যবহার করা হয়। এখানে কোনও রাজনৈতিক ব্যক্তির কার্যালয় রয়েছে তা আমার জানা নাই। বিষয়টি আপনার (সাংবাদিকদের) মাধ্যমে জানলাম। এমনটা যদি হয়ে থাকে তাহলে অবশ্যই ব্যবস্থা নেওয়া হবে। আমরা চেষ্টা করছি যাতে পাঠকরা এখানে আসেন এবং প্রকৃত অর্থে ব্যবহার করেন। যার মাধ্যমে একটি সাহিত্য সমৃদ্ধ সমাজ গঠন হতে পারে।
এসআইএইচ
