সবজি বাজারে পাইকারী-খুচরা দামের অস্বাভাবিক পার্থক্য
ফেনী তরকারি আড়তে যে মূলা ১৫ টাকা কেজি, একই মূলা তরকারি আড়ত থেকে আধা কিলোমিটার দূরে ফেনী বড় বাজারে এলেই তা বেড়ে হয়ে যায় ৫০ টাকা। একইভাবে শিম পাইকারিতে ৪০ টাকা বিক্রি হলেও বাজারে বিক্রি হচ্ছে ৮০ টাকায়। ফুলকপি ৩৫ টাকায় বিক্রি হলেও খুচরা বাজারে ৮০ টাকা। বাজার ঘুরে দেখা গেছে, দামের এ অস্বাভাবিক পার্থক্য প্রায় সব ধরনের সবজিতে।
বাজার ঘুরে করে দেখা যায়, ফেনী খাজা আহাম্মদ পৌর তরকারি আড়তের ২০ গজ সামনে ভ্যান গাড়িতে হকারদের তরকারিও বিক্রি হচ্ছে দ্বিগুণ দামে। যার মধ্যে যেখানে পাইকারিতে কাঁচামরিচ বিক্রি হচ্ছে ৩৫ থেকে ৪০ টাকায়, খুচরা বাজারে বিক্রি হচ্ছে ৬০ থেকে ৬৫ টাকায়, পাইকারিতে ফুলকপি বিক্রি হচ্ছে ৩৫ থেকে ৪০ টাকায় খুচরা বাজারে বিক্রি হচ্ছে ৮০ টাকায়, সাদা শিম পাইকারিতে ৪০ থেকে ৪৫ টাকা বিক্রি হলেও খুচরা বাজারে দ্বিগুণ দামে ৮০ থেকে ১০০ টাকা পর্যন্ত বিক্রি হচ্ছে।
বেগুন পাইকারিতে ২৫ টাকা বিক্রি করলেও খুচরা বাজারে দাম ৫০ থেকে ৬০ টাকা। বরবটি ৬০ টাকায় বিক্রি হয় পাইকারিতে খুচরা বাজারে দাম ৮০ টাকা। একইভাবে পাতাকপি পাইকারিতে ৩৫ টাকা খুচরা বাজারে ৫০ থেকে ৬০ টাকা। টমেটো, গাজর পাইকারি দোকানে ১০০ টাকা করে কেজি বিক্রি হলেও পাইকারিতে বিক্রি হচ্ছে যথাক্রমে ১৩০ ও ১৪০ টাকায়। খুচরা বাজারে পটল ৪০ টাকা, সসিন্ধা ৫০, খিরা ৬০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। যা পাইকারিতে আরও অনেক দামে বিক্রি হয়। ফেনী শহরের প্রবেশদ্বারে অবস্থিত খাজা আহাম্মদ পৌর তরকারি আড়ত এ প্রতিদিন কোটি টাকার কেনাবেচা হয়।
সেখানকার ব্যবসায়ীদের দেয়া তথ্যমতে, ফেনীর সকল উপজেলা ছাড়াও আশেপাশের চৌদ্দগ্রাম, খাগড়াছড়ি, রাঙ্গুনিয়া, বান্দরবানের ব্যবসায়ীরা ও এ বাজার থেকে পাইকারি ক্রয় করতে আসেন। দেশের বিভিন্ন প্রাপ্ত হতে এ আড়তে তরকারি আসে। এ বাজার থেকেই ফেনী বড় বাজার, পৌর হকার্স মার্কেট, মুক্ত বাজার, ভ্যান গাড়ির হকারসহ আশেপাশের ব্যবসায়ীরা পাইকারিতে সবজি ক্রয় করেন। দাম নিয়ে পাইকার ও খুচরা ব্যবসায়ী ও সাধারণ ক্রেতাদের সাথে কথা হলে তারা সকলেই ভিন্নমত ও কারণ উপস্থাপন করেন।
খুচরা বিক্রেতারা বলেন, সবজি পাইকারি বাজার থেকে খুচরা বাজারে আনতে গাড়ি ভাড়া, লেবার খরচ, পলিথিনের ব্যাগ কেনার খরচ, জায়গা ভাড়া, বিদ্যুৎ বিলসহ আরও অনেক খরচ থাকে। এসব খরচ তুলে লাভ করতে হলে বেশি দামে বিক্রি করা ছাড়া উপায় নেই। তবে বিক্রেতাদের সাথে কথা বলে ধারণা করা যায়, পণ্যের উপর বাড়তি ১৫ শতাংশ ব্যয় যুক্ত হয়। বিভিন্ন বাজারে বিক্রেতাদের অতিরিক্ত মুনাফার চেষ্টার ফলে ক্রেতা কিছুটা মুখ ফিরিয়েছে। ভ্যানে সবজির প্রতি ঝুঁকছে সাধারণ ক্রেতারা। এক্ষেত্রে সান্ধ্যকালীন ক্রেতাদের ভিড় সবচেয়ে বেশি ভ্যান গাড়িতে।
তরকারি আড়তে পাইকারী বিক্রেতারা বলছেন, ট্রাকে করে মাল আসে। যেদিন যে দাম অনুযায়ী আসে ওইভাবেই বিক্রি করতে হয়। আমরা কমিশন হিসেবে বিক্রি করি। তবে যে দামে পাইকারিতে বিক্রি হয় তার থেকে ৫ থেকে ৭ টাকা লাভে খুচরায় বিক্রি করার কথা কিন্তু খুচরা ব্যবসায়ীরা বেশী দাম নিচ্ছেন। এ ব্যাপারে অভিযান চালিয়ে নিয়ন্ত্রণ করা উচিত।
গ্রামেগঞ্জে ভ্যান গাড়িতে তরকারি বিক্রি করেন আবুল হোসেন নামে একজন সবজি বিক্রেতা। ফেনী পৌর তরকারি আড়তে এ পাইকারিতে তরকারি কিনতে এসেছেন। যে মূলা তিনি ১৫ টাকা দিয়ে কিনেছেন ঠিক একই সময়ে আড়তের এর বাইরে অন্য ভ্যানগাড়িতে মূলা বিক্রি হচ্ছিল ৫০ টাকা। এমন চিত্র অন্য সব শাক সবজিতে। তিনি বলেন, প্রতিদিন এখান থেকে সবজি কিনে গ্রামে বিক্রি করি, এরমধ্যে অনেক পঁচা থাকে। ফেলে দিতে হয়। যার জন্য কেনার চাইতে বেশী দাম নিতে হয়।
আবুল কালাম নামে ফেনী বড় বাজারের একজন খুচরা ব্যবসায়ী বলেন, ৩০ টাকা দিয়ে কিনলে প্রতি কেজিতে ৩ টাকা খরচ করতে হয়। বিক্রির সময় অনেক ক্রেতা খুচরা টাকা কম দেয়, বস্তা কিনলে তারমধ্যে ৫ থেকে ৭ কেজি নষ্ট থাকে। গাড়ি ভাড়া, লেবার খরচ সব মিলিয়ে হিসাব করেই দাম নির্ধারণ করতে হয়। যার জন্য দাম পাইকার বাজার থেকে বেশী রাখতে হয়।
সহিদ নামে আরেকজন ব্যবসায়ী বলেন, মাল নিতে গেলে বস্তা খুলে নেয়া যায় না, খারাপ হলে টাকা শেষ। নষ্টগুলো ক্রেতাদের দেয়া যায় না। ফেলে দিতে হয় কিন্তু টাকা দিয়েই কিনে আনি আমরা। এরমধ্যে লেবার খরচ যায় ৮০০ থেকে ৯০০ টাকা। সবমিলিয়ে আমাদের খরচ যা পড়ে তা উঠাতে বেশী দামে বিক্রি করতে হয়।
জানে আলম নামে একজন ভ্যানগাড়িতে সবজি বিক্রেতা বলেন, সকালে ফুলকপি নিয়েছি ১ বস্তা। তার মধ্যে ৭ কেজি পঁচা বাদ দিতে হয়েছে। কিন্তু এগুলো টাকা দিয়েই কিনেছি। এভাবে প্রতিদিন বাদ দিতে হয়। তারমধ্য ক্রেতারা খুচরা টাকা দেয় না। নিজের পরিশ্রম আছে সবমিলিয়ে দাম নির্ধারণ করতে হয়।
মেসার্স ইলিয়াস ভূঞা স্টোরের ম্যানেজার আদিত্য কর্মকার জানান, খুচরা দোকানে এসব সবজি ৫ থেকে ৭ টাকা লাভে বিক্রির কথা কিন্তু আরও বেশী লাভ করছে। কেউ বিষয়টা দেখছেনা। ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তর যদি অভিযান পরিচালনা করে তবেই এ সমস্যা দূর হবে।
পাইকারি বাজারের দর সম্পর্কে তিনি বলেন, পার্টিরা আড়তে তরকারি নিয়ে আসে কৃষকদের থেকে আরও কমেই কেনা হয়। এর মধ্যে লেবার খরচ গাড়ি ভাড়া সবমিলিয়ে দাম নির্ধারণ হয়। পার্টিরা আমাদের যে মাল নিয়ে যায় তা থেকে লেবার খরচ, গাড়িভাড়া বাদ দিয়ে আমাদের কমিশন রাখি। যত টাকা আয় হবে সে টাকা অনুপাতে কমিশন। লাভ হলেও তাদের, লস হলেও তাদের।
অস্বাভাবিক দাম বৃদ্ধির বিষয়ে ফেনী বড় বাজারে একজন ক্রেতা আরিফ আজম বলেন, বিক্রেতারা যেমন ইচ্ছা দাম আদায় করছেন। আমরা তো বাধ্য হয়ে কিনছি। কিন্তু বাজার নিয়ন্ত্রণ করার নানা কর্তৃপক্ষ থাকলেও এসব দেখার কেউ নেই। তরকারি আড়তে বাইরের জেলার তরকারি বিক্রির পাশাপাশি স্থানীয় কৃষকদের উৎপাদিত তরকারি ও বিক্রি হয়।
আবদুল খালেক নামের এক প্রান্তিক কৃষক বলেন, এসব সবজি তাদের কাছ থেকে কম দামে কিনে নিয়ে খুচরা বাজারে অনেক বেশি দামে বিক্রি করা হচ্ছে। এতে পাইকারেরা লাভবান হলেও লোকসান হচ্ছে ফসল উৎপাদনকারী কৃষকের। তিনি বলেন, কাচা তরিতরকারির উৎপাদন খরচ বিবেচনায় উপযুক্ত মূল্য কৃষকের হাতে এলে এ পেশায় অনেকেই নতুন করে যুক্ত হবেন। তা না হলে কৃষক কমবে, অপর দিকে পণ্যের দামও বাড়বে।
বাজারে সবজি ক্রয় করতে আসা ক্রেতাদের সাথে কথা হলে তারা বলেন, বাজার সঠিকভাবে তদারকি করা হয় না, যার জন্য খুচরা ও পাইকারিতে অনেক পার্থক্য। এর ফলে সাধারণ মানুষকেই ভুক্তভোগী হতে হয়। দ্রব্যমূল্যের উর্ধ্বগতি সবকিছুতেই। এখন বাজার মনিটরিং না করলে সাধারণ মানুষকে না খেয়ে থাকতে হবে।
ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তর ফেনীর সহকারী পরিচালক কাওছার মিয়া বলেন, ভোক্তা অধিকার আইন অনুযায়ী ক্রয়কৃত মূল্যর চাইতে অস্বাভাবিক দামে পণ্য বিক্রি করলে আইনগত ব্যবস্থা নেয়া হয়। বেশী দামে বিক্রি করলেও এক্ষেত্রে ব্যবসায়ীদের ক্রয়ের রশিদ দেখাতে হয়। উপযুক্ত প্রমাণ না দিতে পারলে ওই ব্যবসায়ীকে আইনের আওতায় আনা হয়। তবে শাকসবজির বাজারে অস্বাভাবিক দাম বৃদ্ধির অভিযোগ পেলে অভিযান চালিয়ে ব্যবস্থা নেয়া হবে।
এএজেড