পদ্মার মাছ থেকে গরুর খিচুড়ি সবই মিলে ৮০ টাকায়
পাবনার ঈশ্বরদী উপজেলার পাকশী ইউনিয়ন। পাকশী বিভাগীয় রেলওয়ে দপ্তরের সামনে রেলওয়ে ফুটবল মাঠ সংলগ্ন আমতলা মাঠে শত বছরের কড়ই তলায়। পাকশী সদর দপ্তর অফিসের পাশে রেলওয়ে জমি লিজ নিয়ে নির্মিত 'হোটেল কিছুক্ষণ'। এখানে যেই খাবারই খান না কেন আপনাকে দিতে হবে মাত্র ৮০ টাকা। উপরে টিনের চালা, ইট-বালির তৈরী দেয়াল ও কাঠের পাল্লাযুক্ত দরজা দিয়ে কোনমতে দাড় করানো এই খাবার হোটেল। খাবার খাওয়ার আগে হাত ধোয়ার জন্য নেই কোন বেসিং। বসার ব্যবস্থা করা হয়েছে মান্ধাতা আমলের কাঠের তৈরী টেবিল চেয়ার দিয়ে। নেই কোন আধুনিকতার ছোঁয়া। তবে সবকিছুই বেশ পরিচ্ছন্ন।
হোটেলের নামকরণের সাথেও রয়েছে অদ্ভুত মিল। কেননা সপ্তাহের রবিবার থেকে বৃহস্পতিবার পর্যন্ত খোলা থাকে এই হোটেল। তাও আবার দুপুর ২ টা পর্যন্ত। সপ্তাহের বৃহস্পতিবার দুপুর ১২ টা থেকে ২ টা পর্যন্ত মেলে খিচুড়ি তাও আবার মাত্র ৮০ টাকায়। খিচুড়ি খেতে হলে আগে এসে অর্ডার করে যেতে হবে। এছাড়াও সপ্তাহের রবিবার থেকে বুধবার মেলে সকালে নাস্তা দুপুরে সাদা ভাতের সাথে থাকে দেশী মুরগী ঝোলের গোস্ত, বিভিন্ন দেশী প্রজাতির পদ্মা নদীর মাছ, সঙ্গে পাতলা মশুরের ডাল, যার দামও আসে মাত্রই ৮০ টাকা।
বৃহস্পতিবার (৩ নভেম্বর) ঈশ্বরদী উপজেলার পাকশী ইউনিয়নে পাকশী বিভাগীয় রেলওয়ের সদর দপ্তরের আমতলা রেলওয়ের শতবর্ষের ফুটবল মাঠ সংলগ্ন 'কিছুক্ষণ' হোটেলের সামনে গিয়ে দেখা যায়, দোকানে কোন কর্মচারী নেই, ষাটোর্ধ বছর বয়সী আতিয়ার রহমান একা একা নিজেই রান্নার উপকরণ কেঁটে-কুটে খিচুড়ি রান্না করার প্রস্তুতি নিচ্ছেন। দুপুর গড়ানোর আগেই রান্না শেষ হতে না হতেই মানুষের আনাগোনা লক্ষ্য করা যায়। কেউ হোটেল বসেই সুস্বাদু ভুনাখিচুড়ি খাচ্ছেন। কেউবা পরিবারের জন্য বাড়িতে নিয়ে যাচ্ছেন। দুপুর শেষের আগে পাতিল ভর্তি খিচুড়ি শেষ হয়ে যায়।
পাকশী ইউনিয়নের বীর-মুক্তিযোদ্ধা খালেদুজ্জামান টোকন ঢাকা প্রকাশকে জানান, এখানকার রান্না, সুস্বাদু ও রুচিসম্মত রান্না। আমরা বাড়িতে যে ধরণের খাবার খেয়ে থাকি। অল্পদামে সে ধরণের খাবার মেলে, তৃপ্তি সহকারে খাওয়া যায়। সপ্তাহের বৃহস্পতিবারে যে খিচুড়ি রানা হয়, সেটা অদ্ভুত রান্না! ঈশ্বরদীর বড় নামীদামী হোটেলে এত কম দামে এমন রান্না মিলবে না।
পাবনার ঈশ্বরদীর পাকশীতে রয়েছে নৈসর্গিক মনোরম দৃশ্য। শত বছরের কড়ই গাছ দেখার জন্য দেশের দূর দুরান্তর থেকে স্বপরিবারে অনেকেই ঘুড়তে আসেন। অনেকেই হোটেল কিছুক্ষনে আতি ভাইয়ের রান্না করা সুস্বাদু খিচুড়ি খেয়ে আবার চলে যান নিজ গন্তব্যে।
পাকশী বিভাগীয় রেলওয়ে অফিসের কর্মচারী মাসুদ রানা জানান, সাধারনত, আমরা বাড়ি থেকে দুপুরের খাবার নিয়ে আসি। তবে রেল কর্মকর্তা- কর্মচারীদের দুপুরের খাবার নিয়ে কোন টেনশন থাকে না। তৃপ্তি সহকারে যে খাবার ব্যবস্থা, পাকশী ছাড়া আর কোথাও মেলে না এমন। প্রায় দিন খাবার শেষ হয়ে যায়, দেরি হয়ে গেলে। আগে থেকে বলতে হয়, আমাদের এতজনের,খাবার লাগবে। সেই অনুযায়ী তিনি রান্না করেন।
'কিছুক্ষণ' হোটেলের মালিক ষাটোর্ধ বছর বয়সী আতিয়ার রহমান আতি ঢাকা প্রকাশ কে জানান, আমি প্রায় ৪২ বছর ধরে ব্যবসার সাথে জড়িত। ১৯৭৩ সালে পাকশী পদ্মা নদীর ওপর ফেরিঘাট ছিল। ছোটবেলা আমি হোটেল কর্মচারী হিসেবে কাজ করেছি। ৮০ এর দশকের শুরুতে পাকশীতে বিভাগীয় রেলওয়ের সদর দফতর অফিস গড়ে ওঠেছিল। তখন উত্তর-পশ্চিম-দক্ষিণাঞ্চলের যত জেলা আছে, রেলওয়ের কর্মচারীদেরকে পাকশী আসতেই হতো। ওই সময় আমার চাঁচাতো ভাই এর সাথে ব্যাবসা শুরু করি। একসময় আমাকে একা ফেলে ব্যবসার হিসাব নিকাস চুকিয়ে চলে যান। লেখাপড়া জানতাম না বলে, হিসাব-নিকাস তখন কিছু বুঝিনি!
সেই কৈশোর থেকে শুরু করে জীবন যুদ্ধে জয়ী আতি কখনো হার মানেননি কারও কাছে। তিনি তার সুস্বাদু রান্না খাইয়ে অসংখ্য মানুষের মনকে জয় করেছেন। দৈনিক সারাদিনে ৩/৪ হাজার টাকার ব্যবসা শেষে, সব খরচ বাদ দিয়ে দিনে নগদ ৭/৮শ টাকা নিয়ে বাড়িতে ফেরেন পাকশীর আতিয়ার রহমান আতি। দাম্পত্য জীবনে তার স্ত্রী, এক ছেলে তিন মেয়ে রয়েছেন। কষ্ট করে মেয়েদের বিয়ে দিয়েছেন। ছেলে ঈশ্বরদী ইপিজেডে চাকুরী করেন। অল্পতেই সন্তুষ্ট ও তুষ্ট তিনি সাধনার জীবন যাপনে।
এএজেড