ভোলায় দেখা মিলছে বিলুপ্তপ্রায় গরুর হাল
ভোলার গ্রামে হঠাৎ দেখা গেল পুরোনো পদ্ধতিতে গরুর হাল। শুধু ভোলায় নয় গরু মহিষের হালের ব্যবহার একসময় সারা বাংলাদেশেই প্রচলিত ছিল। এক সময় গ্রামবাংলায় ফসল ফলাতে জমি চাষ লাঙ্গল দিয়েই করতো কৃষক। তখন সচ্ছল কৃষকদের প্রত্যেক বাড়িতে ছিল গরু মহিষের একাধিক হাল।
শুধু হালচাষে নয় তখন গরু মহিষ ব্যবহার হতো, আখের গুড় তৈরির জন্য আখের রস সংগ্রহে, তিল, শরিষার তেল উৎপাদন করতে কাঠের ঘাঁনিতে, এবং গাড়ি চালাতেও দেখা মিলতো গরু মহিষের। ভোলা সদর উপজেলার রাজাপুরের কন্দ্রকপুরে মহিজল বেপারির রবিশস্য ক্ষেতে দেখা যায় গরু দিয়ে হাল চাষ করতে।
৫/৭ বছর পুর্বেও ভোলায় প্রত্যন্ত গ্রামাঞ্চলে গরু মহিষের হাল কৃষি কাজে ব্যবহার হতে দেখা যেত, এখন সেসব বিলুপ্তির পথে। তবে ভোলায় এখন গরু অথবা মহিষের কাঁধে জোয়াল (কৃষকদের ভাষায় জুমাল) তুলে দিয়ে তাতে লাঙ্গল লাগিয়ে শতবছর ধরে হালচাষ করে আসা প্রান্তিক কৃষকদের এখন আর দেখা যায়না। ভোলায় হালচাষে গরু ও মহিষের ব্যবহার নেই বলেলেই চলে। এখন আর ভোলার কালিনাথ রায়ের বাজার, ও ইলিশা বাজারে বসে না লাঙ্গল, ইস, জুমাল, বিক্রির হাটও। গরু মহিষের হালের সাথে বিলুপ্ত হয়েছে এসব দেশিয় কৃষি সরঞ্জামের হাট বাজারও।
তবে চাষি মহিজল বলেন এখন গরু মহিষের হালচাষের জায়গা দখল করে নিয়েছে যান্ত্রিক যানবাহন ট্রাক্টর ও পাওয়ার টিলার। চাষি মহিজল আরো বলেন আমার ছোট ছোট খন্ড খন্ড জমি বর্তমানে জ্বালানী তেলের দাম অস্বাভাবিক বৃদ্ধির কারনে জমি চাষের দাম বৃদ্ধি পেয়েছে, তাছাড়া খন্ড খন্ড জমি চাষ করতে পাওয়ার টিলার আসতে চাননা বলেই আমার পুরোনো পদ্ধতিতে চাষ করার এই উদ্যেগ।
গত ১৪/১৫ বছর আগেও একজন কৃষক অথবা কৃষি শ্রমিক নিজ হাতে জোড়া গরুর দড়ি তুলে নিয়ে গরু অথবা মহিষের কাঁধে জুমাল লাগিয়ে দিয়ে মাঝখানে লাঙ্গলের ইস জোয়ালের মাঝে বেঁধে গরু অথবা মহিষের হালচাষের দৃশ্য প্রতিটি গ্রামে গ্রামেই দেখা যেত। গরু দিয়ে হালচাষ করা এবং হালচাষের সরঞ্জাম বিক্রির হাট একসময় ছিল গ্রামবাংলার চিরচেনা চিত্র।
হেমন্তে মাঠ হতে ফসল তুলার পরপরই শুরু হতো হাল দিয়ে রবিশস্য উৎপাদনে জমি চাষের কাজ। হেমন্তের ভোর হলেই গ্রাম ও চরাঞ্চলের কৃষক বা কৃষিশ্রমিকরা কাঁধে লাঙ্গল-জুমাল নিয়ে গরু মহিষ নিয়ে জমিতে হাল চাষের জন্য বেরিয়ে পড়তেন,এখন সেসব চিত্র আর চোখে পরেনা। একজন কৃষক বা কৃষি শ্রমিক এক দিনে ৪০/৪২ শতাংশ জমি একচাষ করা ছিল খুবই কষ্টের ব্যাপার। ঘুরে ঘুরে জমি চাষ করতে হতো একই সাথে শক্তহাতে চেপে ধরতে হতো লাঙ্গলের পরকুডি। এতে শক্তি ও কৌশলের প্রয়োজন ছিল বেশ।
লাঙ্গলের কুডি একটু কম বেশী আকাবাঁকা হলেই গরু অথবা মহিষের পায়ে লাঙ্গলের ফলা বা আল ঢুকে গিয়ে মারাত্মক জখম হবার ঝুঁকি থাকতো। আবার যে কৃষক বা কৃষিশ্রমিক হালচাষ করতো তাকেও সবসময় মনোযোগী ও শতর্ক থাকতে হতো। তার পায়েও লাঙ্গলের ফলা বা আল লাগার সম্বাবনা থাকতো। এখন আর কৃষকদের কাঁধে লাঙ্গল-জোয়াল ও হাতে জোড়া গরুর দড়ি দেখা যায় না। বিলুপ্ত হয়ে গেছে গরু ও মহিষ দিয়ে হালচাষের পদ্ধতি।
এক সময় গ্রামগঞ্জে গাঁতা হিসেবে (দুই জোড়া গরুতে এক গাঁতা) গরু ও মহিষ দিয়ে হালচাষ করা হতো। এখন গ্রামে গাঁতা প্রচলনও আর নেই। এখন যন্ত্র ও পাশাপশি কৃষি শ্রমিক দিয়ে সকল চাষের কাজ করা হয়। কৃষিকাজে কৃষকের সম্মান বেড়েছে। বেড়েছে কৃষি শ্রমিকের কদর। তবে ভোলায় গরু, মহিষ দিয়ে হালচাষ করা বিলুপ্ত হলেও গ্রামে গরু মহিষ প্রতিপালন কিন্তু বেড়েছে।
এক সময় চাষাবাদ করতো না এমন পরিবারেও গরু মহিষ পালন করতো হালচাষের জন্য। তারা শুধুমাত্র গরু, মহিষ দিয়ে হালচাষ করে জীবন জীবিকা নির্বাহ করতেন। এখন গরু মহিষ দিয়ে হালচাষের পেশাটির বিলুপ্তি ঘটেছে। তবে সেই জায়গায় গ্রামের অনেক পরিবার যাদের চাষের জমি নেই তারা এখন উন্নতজাতের গরু মহিষ পালন করতে শুরু করেছেন দূধের জন্য। কিন্তু বর্তমানে লাঙ্গলের হাল চাষ আর চোখে পরে না। লাঙ্গলের হালচাষ বিলুপ্ত হয়ে গেছে।
এ চাষি বলেন, গরু দিয়ে হাল চাষের অনেক উপকারিতা লাঙ্গলের ফলা মাটির অনেক গভীরে যায় তাই জমির মাটি ভালো আলগা ও নরম হয়, ফসলের জন্য অনেক ভালো হয়। গরু দিয়ে হাল চাষ করলে জমিতে ঘাসও কম হয়। আর ফলনও ভালো হয়। লাঙ্গল দিয়ে প্রতিদিন জমি চাষ করা সম্ভব হয় প্রায় ৪০ শতাংশ। কৃষিতে মান্দাতা আমলের ধ্যানধারনা পাল্টে গেছে।
ভোলা কৃষি অধিদপ্তরের উপ-পরিচালক হাসান মোঃ ওয়ারিসুল কবির বলেন, বর্তমানে কৃষিতে এসেছে আমূল পরিবর্তন। কৃষি কাজেও প্রযুক্তির ব্যবহার বেড়েছে। যে কৃষি জমিতে বছরে দুবার আবাদ করা হতো সেই জমিতে এখন তিন/চার বার আবাদ করা হচ্ছে। সময়ের প্রয়োজনে মানুষ এখন লাঙ্গল দিয়ে হাল চাষের পরিবর্তে ট্রাক্টর, পাওয়ার টিলার দিয়ে জমি চাষ করছে। কৃষি কাজে কৃষকদের সহায়ক পরামর্শ ও আধুনিক কৃষি সরঞ্জাম প্রদান করছে সরকার। তারই ধারাবাহিকতায় প্রতিটি ইউনিয়নে আমাদের কৃষি উপসহকারি সর্বদা কৃষকের সেবায় নিয়োজিত রয়েছেন।
এএজেড