কৃষিতেই জীবন চলে সংগ্রামী আকলিমার
অনটনের সংসারে বিবাদ লেগেই থাকত। একপর্যায়ে তিন সন্তানসহ আকলিমাকে ছেড়ে স্বামী তোহিদুল ইসলাম চলে যান। আরেকটা বিয়ে করে নতুন করে সংসার পাতেন। এরপর ৫ বছর স্বামীর অপেক্ষায় সেখানেই কোনো রকম জীবনধারণ করছিলেন তিন সন্তান নিয়ে। পরে সন্তানদের নিয়ে ভাইয়ের বাড়ি চলে আসেন। নেমে পড়েন জীবন যুদ্ধে। শুরু করেন কৃষি কাজ। পরের জমি চাষ করে আজ সফল কৃষক আকলিমা।
কুড়িগ্রামের ফুলবাড়ী উপজেলার শিমুলবাড়ী ইউনিয়নের চরপেচাই গ্রামে আকলিমা বেগমের বাড়ি। ২০ বছর আগে বিয়ে হয় একই এলাকার তোহিদুল ইসলামের সঙ্গে। তিন সন্তানের জন্ম হয়। দিনমজুর তোহিদুল সংসার চালানো নিয়ে নানা নির্যাতন করতেন আকলিমাকে। সন্তানদের মুখের দিকে চেয়ে সবই সহ্য করতেন আকলিমা। তবুও তোহিদুল চলে যান তাদের ছেড়ে।
আকলিমা বেগম ভাইয়ের সহযোগিতায় চরপেচাই এলাকায় মানুষের জমি লিজ (কন্ট্রাক্ট) নিয়ে বাদাম, ভুট্টা ও ধানের চাষাবাদ করেন। তিন সন্তানকে নিয়ে জীবন-জীবিকা নির্বাহ করছেন কৃষির উপর নির্ভর করেই। সপ্তম শ্রেণি পর্যন্ত লেখাপড়া করে আর এগোতে পারেনি আকলিমার বড় ছেলে রায়হান। মা আকলিমার সঙ্গে ক্ষেতের কাজে সহযোগিতা শুরু করে। দ্বিতীয় ছেলে রাকিবুল হাসান পঞ্চম শ্রেণি ও ছোট মেয়ে শিশু শ্রেণিতে পড়ে।
আকলিমা বেগম এ বছর দেড় বিঘা জমিতে বাদাম ও দেড় বিঘা জমিতে ধান চাষ করেছেন। এভাবে তিনি মানুষের জমি লিজ নিয়ে গত ৫ বছর ধরে সন্তানের ভরণপোষণ ও পড়ালেখার খরচ চালিয়ে অনেকটা স্বচ্ছল জীবন যাপন করছেন। পুরুষ শাসিত সমাজের চোখ রাঙানি উপেক্ষা করে পুরুষ চাষিদের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে জীবন-যুদ্ধে সংগ্রামী এ নারী হয়ে উঠেছেন সফল চাষি।
আকলিমা জানান, তিনি গত ৫ বছর ধরে বাদাম, ভুট্টা ও ধানের চাষাবাদ করে ব্যাপক জনপ্রিয়তা অর্জন করেছেন। এ বছর আবহাওয়া অনুকূল থাকায় বাদাম ও ধানের ফলন ভালো হয়েছে।
তিনি বলেন, আমার স্বামী ৫ বছর ধরে কোনো খোঁজ খবর রাখেনি। আমার তিন সন্তান। বড় চ্যালেঞ্জ নিয়ে লড়াই সংগ্রাম করেই দুই ছেলে ও ১ মেয়েসহ জীবিকা নির্বাহ করছি। যদিও তেমন কিছু জমানো সম্ভব হয়নি। এক দিকে স্বামী থেকেও নেই, অন্য দিকে অভাবের কারণে বড় ছেলের পড়া বন্ধ হয়েছে। তাই বড় ছেলেসহ আমি ক্ষেতে কাজ-কাম করি। ছোট ছেলে ও মেয়ের পড়াশুনা চালিয়ে যাচ্ছি। সবাই আমার জন্য দোয়া করবেন আমি যেন দুই সন্তানের পড়াশুনা করিয়ে মানুষের মতো মানুষ করতে পারি।
আকলিমা আরও বলেন, এখন আমার স্বামী না এলেও কোনো সমস্যা নেই। জায়গা জমি না থাকলেও ভাইয়েরা আমার থাকার ব্যবস্থা করে দিয়েছে। সব সময় ভাইয়েরা খোঁজ খবর নেন। কৃষি কাজেও ভাইয়েরা অনেক সহযোগিতা করেন। আমি এভাবেই আজীবন কৃষি কাজ করে তিন সন্তানকে নিয়ে বেঁচে থাকতে চাই। তিনি উপজেলা কৃষি অফিস থেকে কৃষি কাজের সব ধরনের সহযোগিতার জন্য সু-দৃষ্টি কামনা করি।
আকলিমার ভাই ফজর আলী বলেন, আমার ছোট বোন আকলিমা খুবই পরিশ্রমী। তিন-চার বিঘা জমিতে বিভিন্ন ধরনের ফসল ফলায়। কোনো প্রকার মজুর নেয় না। সব কাজই সে নিজে করে। মাঝে মধ্যে তার বড় ছেলে একটু সহযোগিতা করে। কৃষি কাজের পাশাপাশি হাঁস, মুরগি ও ছাগল পালনও করেন। এভাবেই মাঠে ময়দানে লড়াই সংগ্রাম করেই যাচ্ছে আকলিমা।
উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা নিলুফা ইয়াছমিন জানান, আকলিমার মতো নারীরা কৃষি কাজে এগিয়ে এলে কৃষিতে আমূল পরিবর্তন আসবে। সেই সঙ্গে কৃষি প্রধান দেশ হিসেবে নারীদের যেমন কৃষির উপর কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টি হবে, অন্য দিকে বাড়বে কৃষি উৎপাদনশীলতাও। কৃষি বিভাগ থেকে আকলিমাকে প্রয়োজনীয় সব ধরনের সহায়তা দেওয়া হবে।
এসএন