জামিনে মুক্তি পেয়ে হাসপাতালের পিয়ন মেডিকেল অফিসার
নওগাঁর সাঈদ হোসেন। ছিলেন ঢাকার সাভার উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে অফিস সহায়ক (পিয়ন) হিসেবে হাসাপাতালের কর্মচারী। দেশে করোনা মাহামারি শুরু হলে বিদেশগামী যাত্রীদের নিকট উচ্চমূল্যে করোনার জাল সনদ বিক্রির দায়ে কারাবাস হয় সাঈদের। এরপর জামিনে মুক্তি পেয়ে গ্রামের বাড়িতে ফিরে এসে বনে যান ডাক্তার।
এমবিবিএস বা বিডিএস ডিগ্রী না থাকলেও বর্তমানে সকল রোগের চিকিৎসক সাঈদ হোসেন। নামের আগে পদবি লিখছেন ‘ডাক্তার’। ৩০০ থেকে ৪০০ টাকা ভিজিট নিয়ে ব্যবস্থাপত্র (প্রেসক্রিপশন) দিচ্ছেন সাধারণ রোগীদের। ব্যবস্থাপত্রে ডিএমএফ ডিগ্রী বসিয়ে তিনি এখন উপ-সহকারী কমিউনিটি মেডিকেল অফিসার। অথচ কোথা থেকে কত সালে ডিএমএফ কপ্লিট করেছেন তার কোনো সনদ বা রোল-রেজিস্ট্রেশনসহ কোনো প্রকার সুর্নিষ্ট তথ্য প্রমাণ দিতে পারেননি তিনি। নেই কোনো বিএমডিসি’র রেজিস্ট্রেশন।
নওগাঁর হোগল বাড়ি মোড়ে ভাই ভাই মেডিকেয়ার ফার্মেসীতে সাঈদের রোগী দেখার চেম্বার। প্রতিদিন সকাল থেকে মধ্যরাত অব্দি রোগী দেখেন তিনি।
জানা গেছে, সাঈদ হোসেন হোগল বাড়ি মোড়ের শহিদুল ইসলামের ছেলে। তার মা সাভার উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের সুনামধন্য এক ডাক্তারের বাসায় বুয়ার কাজ করতেন। সেই সুবাদে মায়ের অনুরোধে সাঈদ হোসেনকে স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে পিওন পদে চাকরি পাইয়ে দেন সেই চিকিৎসক। এরপর করোনা মহামারি শুরু হওয়াতে সাঈদের ভাগ্য পরিবর্তন হয়ে যায়। হাসপাতালে বসে করোনার ভুয়া সনদ (সার্টেফিকেট) বানিয়ে বিক্রি শুরু করেন তিনি। পরে বিষয়টি জানাজানি হলে স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের দায়ের কারা রাষ্টদ্রোহী মামলায় ২০২০ সালের ২৫ মে আটক হয়ে জেলে যেতে হয় সাঈদকে। বর্তমানে সেই মামলাটি আদালতে চলমান রয়েছে। পরে ২০২১ সালে জামিনে মুক্তি হয়েই রাতারাতি চিকিৎসক হয়ে যান সাঈদ। গ্রামের বাড়িতে ফিরে এসে একটি ফার্মেসি ও চেম্বার বসিয়ে শুরু করেন সকল রোগের চিকিৎসা।
বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকরা বলছেন, পল্লী চিকিৎসকের কাছে ভুল চিকিৎসার কারণে রোগীরা মারাত্মক স্বাস্থ্য ঝুঁকিতে পড়ছেন। রোগের প্রাথমিক অবস্থায় তারা উচ্চমাত্রার অ্যান্টিবায়োটিক দিয়ে দিচ্ছেন। সামান্য অসুখেও তারা উচ্চমাত্রার অ্যান্টিবায়োটিক সেবনের পরামর্শ দিচ্ছেন। অ্যান্টিবায়োটিকের অতিরিক্ত ব্যবহারের কারণে রোগ-প্রতিরোধ ক্ষমতা নষ্ট হয়ে রোগীরা আক্রান্ত হচ্ছেন জটিল রোগে। ফলে রোগ নিরাময়ে সময় বেশি লাগছে। আবার অনেক রোগী রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতাও হারিয়ে ফেলছেন। এতে পরবর্তী সময়ে একদিকে অ্যান্টিবায়োটিক কাজ করছেন না। অন্যদিকে রোগীর খরচও বাড়ছে। এসব রোগীর রোগ নির্ণয়েও অনেক সময় হিমশিম খেতে হচ্ছে বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকদের। তাদের ভুল চিকিৎসা, মাত্রাতিরিক্ত ওষুধের প্রেসক্রিপশনের কারণে হরহামেশাই মারাত্মক স্বাস্থ্য ঝুঁকিতে পড়তে হচ্ছে সাধারণ রোগীদের।
হোগল বাড়ি গ্রামের সাজু নামে এক ভুক্তভোগী জানান, মাস তিনেক আগে আমার বাচ্চার সুন্নাতে খাতনা করাই ডা. আবু সাঈদের কাছে। তারপর কোনোভাবে বাচ্চার ব্লেডিং বন্ধ হচ্ছে না। বাচ্চার অবস্থা বেগতিক দেখে শেষে রাত দেড়টার দিকে বাচ্চাকে নওগাঁ সদর হাসপাতালে নিয়ে গিয়ে বাঁচাতে পারি। আমার বাচ্চা সেদিন মরেই যাচ্ছিল আল্লাহ পুনরায় হায়াত দিছে।
তিনি আরো বলেন, পরে এ বিষয়টি নিয়ে আমি গ্রাম্য মাতব্বরদের নিকট অভিযোগ করলে গ্রাম্য শালিশে ভুয়া ডা. সাঈদকে ৫ হাজার টাকা জরিমানা করেন মাতব্বররা।
স্থানীয় মোতাহার হোসেন নামে এক বয়স্ক রোগী বলেন, ‘বাবারে এই সাঈদ একটা ভুয়া ডা. আমার একটা সমস্যার জন্য দীর্ঘদিন থেকে তার কাছে বহু টাকার চিকিৎসা করছি কিন্তু রোগ সারে না। উপায় না পেয়ে আমি শহরে ভালো চিকিৎসক দেখাই। তারা আমাকে জানায় অসুখ অনুযায়ী এগুলা ওষুধ ঠিক নাই রোগ সারবে কই থেকে। পরে আমাকে ১০০ টাকার ওষুধ দিছে খেয়ে আমি বর্তমানে সুস্থ। এ তো রোগ-ই ধরতে পারে না তাহলে কিসের ডা. এই সাঈদ।’
চিকিৎসা নিতে আসা খাদেমুল ইসলাম নামে আরেক ব্যক্তি বলেন, প্রসাবের জ্বালা পোড়া, মাথা ঘোরানো ও চোখে ঝাপসা এই সমস্যা নিয়ে ডা. দেখাতে আসছি। এর আগেও চিকিৎসা নিয়েছি কোনো উন্নতি হচ্ছে না। বরং সমস্যা আরো বাড়ছে ১০দিন পর আসতে বলছিল। তাই আজকে আসছি।
স্থানীয় আবুল কালাম আজাদ হোসেন নামে এক ব্যক্তি জানান, সে তো ঢাকায় একটা হাঁসপাতালের পিওন ছিল। এরপর শুনেছি করোনার জাল সনদ বিক্রি করার জন্য জেলে গেছে। এখন জেল থেকে এসে আবার দেখি ডা. হয়ে গেছে। সে কখন ভর্তি হলো আর কখন চাকরি করল আর কিভাবেই বা ডাক্তার হলো বিষয়টা তদন্ত হওয়া দরকার।
এ বিষয়ে সাঈদ হোসেনের চেম্বারে গিয়ে তার বক্তব্য জানতে চাইলে তিনি বলেন, সাভার প্রিন্স মেডিকেল ইন্সটিটিউ (ম্যাটস) থেকে আমি ১১-১২ সেশনে ডিএমএফ করেছি। এর চেয়ে বেশি কোনো তথ্য দিতে পারেননি তিনি।
কিন্তু সেখানে আপনার কোনো ডকুমেন্ট বা পাশ কারার ব্যাপারে কোনো তথ্য পাওয়া যায়নি এমন প্রশ্ন করা হলে তার জবাব এড়িয়ে ক্যামরার সামনে কোনো মন্তব্য না করে চেম্বার ছেড়ে বাইরে চলে যান তিনি।
পরে আবার যোগাযোগ করা হলে সাঈদ হোসেন বলেন, সামনের মাসে ২৩ তারিখ আমার কেসের হাজিরা আছে। সেটা শেষ করে এসে সকল তথ্য দিব। আমার সকল কাগজপত্র আছে। এক পর্যায়ে তিনি ক্ষিপ্ত হয়ে বলেন, এসব ব্যাপারে কোনো তথ্য দিতে পারব না। আপনাদের যা ইচ্ছে করতে পারেন।
এ ব্যাপারে নওগাঁর সিভিল সার্জন ডা. আবু হেনা মোহাম্মদ রায়হানুজ্জামান সরকার বলেন, আপনাদের মাধ্যমে বিষটি অবগত হলাম তদন্ত সাপেক্ষে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহন করা হবে।
উল্লেখ্য, সুপ্রিম কোর্টের হাইকোর্ট বিভাগের রিট পিটিশন নং-৫৩৫/২০১৯ মোকদ্দমার রায় অনুসারে বিকল্প ধারার চিকিৎসা পদ্ধতির পেশাধারীরা নামের পূর্বে ‘ডাক্তার’ লিখতে পারবেন না। বিএমডিসি আইন-২০১০ এর ২৯ ধারা মোতাবেক নিবন্ধনভুক্ত মেডিকেল বা ডেন্টাল ইনস্টিটিউট কর্তৃক এমবিবিএস অথবা বিডিএস ডিগ্রীধারী ছাড়া কেউ (ডা.) পদবি ব্যবহার করতে পারবেন না। এতে আরও বলা হয়েছে, আপিল মামলা নিষ্পত্তি না হওয়া পর্যন্ত বর্তমান রিট মামলা নং ৫৩৫/২০১১ এর রায় বহাল থাকবে মর্মে প্রতীয়মান হয়। অথচ উচ্চ আদালতের এমন নিষেধাজ্ঞা অমান্য করে ব্যবস্থাপত্রে নামের আগে ডিগ্রি বসিয়ে প্রতিনিয়ত চিকিৎসা দিয়ে যাচ্ছেন এমন হাজারো ডাক্তার।
এসআইএইচ