তৃণমূলে স্বাস্থ্যসেবা পৌঁছে দিচ্ছে কমিউনিটি ক্লিনিক
সাতক্ষীরায় কমিউনিটি ক্লিনিকের সুফল ভোগ করছেন প্রান্তিক পর্যায়ের অবহেলিত নারী, শিশু ও কিশোরীরা। এসব ক্লিনিকের মাধ্যমে মা ও শিশুর স্বাস্থ্যসেবা, প্রজনন স্বাস্থ্য, পরিবার পরিকল্পনা সেবা, টিকাদান কর্মসূচি, পুষ্টি, স্বাস্থ্যশিক্ষা, পরামর্শসহ বিভিন্ন সেবা গ্রহণ করেন প্রান্তিক পর্যায়ের মানুষরা। বর্তমানে সাতক্ষীরার ৭৮টি ইউনিয়নের ২২৭ কমিউনিটি ক্লিনিকের মাধ্যমে প্রতিদিন ১০ হাজারেরও বেশি মানুষ চিকিৎসা সেবা নিচ্ছেন।
কর্মীদের নিয়মিত উপস্থিতি, ওষুধের পর্যাপ্ত সরবরাহ আর পরিচ্ছন্ন পরিবেশের কারণে জেলার কমিউনিটি ক্লিনিকগুলোতে চিকিৎসা নিতে আসা রোগীর সংখ্যা ক্রমেই বাড়ছে। নিজ এলাকাতেই প্রাথমিক চিকিৎসা পেয়ে খুশি এলাকাবাসী।
গ্রামের হতদরিদ্র মহিলা, শিশু ও কিশোরীরা এখন হাতের কাছে স্বাস্থ্যসেবা নিচ্ছেন। হতদরিদ্র ও গরিব শ্রেণির পরিবারের নারী, কিশোরীসহ অন্যান্য সদস্যরা কমিউনিটি ক্লিনিকে সেবা নিতে আসেন। সেবার পাশাপাশি বিনামূল্যে দেওয়া হচ্ছে সরকারি ওষুধ। তবে কমিউনিটি হেলথ কেয়ার প্রোভাইডার (সিএইচসিপি) ছাড়া ডাক্তারদের ক্লিনিকে পাওয়া যায় না বলে জানান স্থানীয়রা। তবে কমিউনিটি ক্লিনিক যেন বন্ধ না হয় এবং চাহিদা মোতাবেক ওষুধ সরবরাহ করা হয় এজন্য সরকারের দৃষ্টি আর্কষণ করেছেন এলাকাবাসী।
সাতক্ষীরা জেলা সিভিল সার্জন অফিস সূত্রে জানা যায়, সাতক্ষীরায় বর্তমানে ২২৭টি কমিউনিটি ক্লিনিক রয়েছে। আর ২টি কমিউনিটি ক্লিনিক নির্মাণাধীন। প্রতিটি ক্লিনিকের মাধ্যমে ৬ হাজার মানুষের প্রাথমিক স্বাস্থ্যসেবা পাওয়ার কথা। একটি কার্টনে ২ মাসের জন্য ৩০ ধরনের ওষুধ নির্ধারণ করা থাকে। এসব ওষধ দিয়ে ওইসব ক্লিনিকে ছুটির দিন ব্যতীত সকাল ৯টা থেকে বিকেল ৩টা পর্যন্ত সেবা দেওয়া হয়। নারী ও কিশোরীদের স্বাস্থ্য, পুষ্টি ও পরিবার পরিকল্পনা, কৈশোর কালের সমস্যা সেবা ও ইপিআই কর্মসূচির সব কার্যক্রম এসব কমিউনিটি ক্লিনিক থেকে বাস্তবায়ন করা হয়।
জেলার বিভিন্ন কমিউনিটি ক্লিনিক ঘুরে জানা যায়, এখানে সার্বিক প্রজনন স্বাস্থ্য পরিচর্যার আওতায় গর্ভবর্তী মহিলাদের প্রসব পূর্ব প্রতিষেধক টিকাদানসহ প্রসব পরবর্তী নবজাতকের সেবা, সময়মতো যক্ষ্মা, ডিপথেরিয়া, হুপিং কফ, পোলিও, ধনুষ্টংকার, হাম, হেপাটাইটিস-বি, নিউমোনিয়াসহ বিভিন্ন রোগের প্রতিষেধক টিকা দেওয়াসহ শিশু ও কিশোর-কিশোরীদের জন্য প্রয়োজনীয় স্বাস্থ্য সেবা দেওয়া হয়।
জনগণের জন্য বিশেষ করে মহিলা ও শিশুদের অপুষ্টি দূরীকরণের জন্য ফলপ্রসূ ব্যবস্থা গ্রহণ ও সেবা প্রদান করা হয় এই ক্লিনিক থেকেই। এ ছাড়া, ম্যালেরিয়া, যক্ষ্মা, কুষ্ঠ, কালা-জ্বর, ডায়রিয়াসহ অন্যান্য সংক্রামক রোগ প্রতিরোধ ব্যবস্থা এবং সেগুলোর সীমিত চিকিৎসা সুবিধা রয়েছে। সাধারণ জখম, জ্বর, ব্যথা, কাটা, পোড়া, দংশন, বিষক্রিয়া, হাঁপানি, চর্মরোগ এবং চোখ, দাঁত ও কানের সাধারণ রোগের ক্ষেত্রে লক্ষণ ভিত্তিক প্রাথমিক চিকিৎসা দেওয়া হয়। অস্থায়ী পরিবার পরিকল্পনা পদ্ধতি সংক্রান্ত কনডম, পিল, ইসিপিসহ বিভিন্ন উপকরণ সরবরাহ ও বিতরণ নিশ্চিত করা হয়। জটিল রোগীদের প্রয়োজনীয় প্রাথমিক সেবা প্রদান করে দ্রুত উচ্চতর পর্যায়ে রেফার করা হয়।
এদিকে কমিউনিটি ক্লিনিকের চাকরি রাজস্ব খাতে না হওয়ায় কর্মঠ ও দক্ষ সিএইসসিপিরা চাকরি ছেড়ে অন্যত্রে চলে যাচ্ছেন। এতে মেধাবী ও দক্ষ কর্মী হারাচ্ছে কমিউনিটি ক্লিনিক। দ্রুত চাকরি রাজস্ব খাতে না করলে প্রধানমন্ত্রীর এই প্রকল্প মুখ থুবড়ে পড়ার আশঙ্কা প্রবল হয়ে উঠেছে।
জেলার বিভিন্ন কমিউনিটি ক্লিনিকে চিকিৎসা নিতে আসা একাধিক ব্যক্তিরা জানান, এখন আর কষ্ট ও টাকা খরচ করে শহরের হাসপাতালে যেতে হয় না তাদের। প্রাথমিক রোগের চিকিৎসা সেবা তারা কমিউনিটি ক্লিনিক থেকেই নিতে পারছেন। এখান থেকে ওষুধ নিতে কোনো টাকা দিতে হয় না। তবে যদি বড় ডাক্তাররা ক্লিনিকে নিয়মিত আসতেন তাহলে চিকিৎসা সেবার মান আরও ভাল হতো।
সাতক্ষীরা সদর উপজেলার ঝিটকী কমিউনিটি ক্লিনিকের স্বাস্থ্য সহকারী শরিফুন নেছা ও কমিউনিটি হেলথ কেয়ার প্রোভাইডার আমিনুর রহমান বলেন, ক্লিনিকে আসা যেকোনো রোগীর নাম প্রথমে রেজিস্টার করা হয়। পরে ক্লিনিকে কর্মরত সিএইচসিপির কাছে রোগীরা তাদের সমস্যা সম্পর্কে বিস্তারিত বলার পর রোগীর অবস্থা অনুযায়ী চিকিৎসা সেবা দেওয়া হয়। তবে রোগ যদি জটিল হয় তাহলে তাৎক্ষণিকভাবে তাদের অপেক্ষাকৃত উচ্চতর চিকিৎসা সেবার জন্য সরকারি হাসপাতালে যাওয়ার পরামর্শ দেওয়া হয়।
তারা আরও বলেন, বর্তমানে ঝিটকী কমিউনিটি ক্লিনিকের মাধ্যমে প্রতিমাসে কয়েক হাজার নারী ও কিশোরীদের বিনামূল্যে চিকিৎসা এবং ওষুধ দেওয়া হচ্ছে। পাশাপাশি একই ক্লিনিকের মাধ্যমে কিশোরীদের বিভিন্ন ভ্যাকসিন দেওয়া হচ্ছে। এর ফলে মাতৃমৃত্যুর হার অনেকাংশে কমে এসেছে। তা ছাড়া সম্প্রতি ব্র্যাকের সঙ্গে যুক্ত হয়ে যক্ষ্মা রোগ নিয়েও কাজ করছেন বলে জানান তারা।
সাতক্ষীরা সদর উপজেলা চেয়ারম্যান আসাদুজ্জামান বাবু বলেন, গ্রামীণ জনগণের অত্যাবশ্যকীয় চিকিৎসা সেবা বিতরণের প্রথম স্তর হলো কমিউনিটি ক্লিনিক। তৃণমূল পর্যায়ে সাধারণ মানুষের চাহিদা অনুসারে ওয়ান স্টপ সার্ভিস সেন্টার হিসেবে বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনার বিশেষ উদ্যোগে কমিউনিটি ক্লিনিক স্থাপন করা হয়। বর্তমানে তৃণমূল মানুষের স্বাস্থ্যসেবায় কমিউনিটি ক্লিনিক এখন স্বাস্থ্যসেবার মডেল হয়ে দাঁড়িয়েছে। মা ও শিশুর পাশাপাশি সাধারণ মানুষের স্বাস্থ্যসেবায় এক নীরব বিপ্লব ঘটিয়েছে এই ক্লিনিক।
তিনি আরও বলেন, প্রথম দিকে সচেতনতার অভাবে কমিউনিটি ক্লিনিকে সেবা গ্রহীতাদের ভিড় না থাকলেও এখন ক্লিনিকগুলোতে রোগীর ভিড় ক্রমশ বাড়ছে। এই ক্লিনিকের মাধ্যমে গ্রামাঞ্চলের মানুষের দোরগোড়ায় স্বাস্থ্যসেবা পৌঁছে দেওয়া হচ্ছে। কমিউনিটি ক্লিনিকগুলো বাড়ির কাছাকাছি হওয়ায় এবং সেখানে বিনামূল্যে সাধারণ রোগের ওষুধ পাওয়া যায় বলে দিন দিন এর সেবাগ্রহীতার সংখ্যাও বাড়ছে।
এ ব্যাপারে সাতক্ষীরা সিভিল সার্জন ডা. মোহাম্মদ হুসাইন শাফায়াত বলেন, বর্তমানে জেলার ৭ উপজেলায় অবস্থিত ২২৭টি কমিউনিটি ক্লিনিকের মাধ্যমে প্রান্তিক পর্যায়ের মানুষদের মাঝে বিনামূল্য চিকিৎসা সেবা পৌঁছে দেওয়া হচ্ছে। কমিউনিটি ক্লিনিকগুলোয় চিকিৎসা দেওয়া পাশাপাশি ওষুধ সরবরাহ নিশ্চিত করায় উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সগুলোতে রোগীদের চাপ কমেছে। সাধারণ মানুষদের চিকিৎসা সেবার আওতায় নিয়ে আসতে কমিউনিটি ক্লিনিকগুলো গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখছে। কমিউনিটি ক্লিনিকগুলোর সক্ষমতা আরও বাড়াতে পারলে গ্রামীণ জনগোষ্ঠীর চাহিদামতো চিকিৎসা সেবা প্রদান সম্ভব হবে।
এসজি/