ধরলা-তিস্তার ভাঙনে আড়াই শতাধিক বসতবাড়ি বিলীন
কুড়িগ্রামের চিলমারী উপজেলার রমনা ইউনিয়নের পাত্রখাতা গ্রামে তিস্তা নদী ও ফুলবাড়ী উপজেলার চরগোরকমন্ডল এলাকায় ধরলা নদীর তীব্র ভাঙনে নদীগর্ভে বিলীন হয়ে যাচ্ছে একের পর এক বসতবাড়ি ও আবাদি জমি। গত দুই মাসে দুই শতাধিক বসতবাড়ি ও প্রায় ৪০০ বিঘা আবাদি জমি চলে গেছে তিস্তার পেটে। ভাঙন হুমকিতে রয়েছে আরও শতাধিক বসতভিটা, কয়েকশ বিঘা আবাদি জমি এবং তিনটি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান।
অন্যদিকে জেলার ফুলবাড়ীতে গত তিনদিনের ভারী বৃষ্টিপাত ও উজান থেকে নেমে আসা ঢলে ধরলা নদীর পানি বৃদ্ধি পাওয়ায় তীব্র ভাঙন দেখা দিয়েছে। গত দুই সপ্তাহে ধরলার ভাঙনে উপজেলার নাওডাঙ্গা ইউনিয়নের চরগোরকমন্ডলে নদীর তীরবর্তী প্রায় আড়াই কিলোমিটার এলাকাজুড়ে তীব্র ভাঙনে শতশত বিঘার আবাদি জমি বিলীন হয়ে গেছে। এ ছাড়া তীরবর্তী এলাকার ১০টি পরিবার ঘরবাড়ির জিনিসপত্র নিয়ে উঁচু জায়গায় আশ্রয় নিয়েছে।
এদিকে নদীর তীব্র স্রোতে ধরলার তীর রক্ষা বাঁধ (গোরকমন্ডল আবাসন থেকে আনন্দ বাজার যাওয়া সড়কটি) যেকোনো মুহূর্তে নদীতে বিলীন হয়ে যেতে পারে বলে আশঙ্কা করছেন স্থানীয়রা। কর্তৃপক্ষ দ্রুত ব্যবস্থা না নিলে বাঁধটি রক্ষা পাবে বলে জানিয়েছেন এলাকাবাসী। বাঁধটি ভাঙলে চরগোরকমন্ডলের অধিকাংশ এলাকা ও প্রায় দেড় শতাধিক ঘরবাড়ি ধরলা নদীতে বিলীন হয়ে যাবে।
বৃহস্পতিবার (৪ আগস্ট) সকালে উপজেলার নাওডাঙ্গা ইউনিয়নের চরগোরকমন্ডলের ভাঙনকবলিত এলাকায় গিয়ে দেখা গেছে, স্থানীয় লোকজন ভাঙন ঠেকাতে বাঁশ ও কলা গাছ দিয়ে চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন। আবার কেউ কেউ ভাঙনের ভয়ে আগাম ঘরবাড়ি সরানোর কাজ চালিয়ে যাচ্ছে।
ফুলবাড়ী উপজেলার চরগোরকমন্ডল এলাকার দিনমজুর বদিউল জামাল জানান, মাত্র ১৬ শতক জমিতে বসতবাড়ি। ধরলা যেভাবে ভাঙতেছে সেই জমিটুকুও বুঝি গিলে খাবে। তিনি চরম ক্ষোভ ও কষ্টে কথাগুলো বলেন আর বাড়ি সরানোর কাজ করেন।
তিনি আরও জানান, ঘরবাড়ি সরানো হচ্ছে। আজ রাতটা যে কোথায় থাকব জানি না। দ্রুত ভাঙন রক্ষার্থে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের কাছে জোর দাবি জানান তিনি।
ফুলবাড়ী উপজেলার নাওডাঙ্গা ইউনিয়নের চেয়ারম্যান হাসেন আলী দুপুরে ধরলার তীব্র ভাঙন এলাকা পরিদর্শন করে জানান, পরিস্থিতি খুবই ভয়াবহ। এরইমধ্যে ভাঙনে নদীতে বিলীন হয়েছে প্রায় অর্ধশতাধিক পরিবার। তারা অন্য জায়গায় আশ্রয় নিয়েছে। এ ছাড়া হুমকির মুখে প্রায় দেড় শতাধিক পরিবার। দ্রত ভাঙনের হাত থেকে বাঁধটি রক্ষা করতে না পারলে শতশত আবাদি জমি ও শতাধিক ঘরবাড়ি বিলীন হয়ে যাবে। তাই বিষয়টি সংশ্লিষ্ট ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষকে জানানো হয়েছে।
চিলমারী উপজেলার রমনা ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান গোলাম আশেক আকা বলেন, পাত্রখাতা গ্রামে প্রতিদিনই তিস্তা নদীর ভাঙনে বিলীন হচ্ছে বসতভিটা ও আবাদি জমি। ভাঙন ঠেকাতে একমাস আগে পানি উন্নয়ন বোর্ড কার্যকরী ব্যবস্থা নিলে এত পরিমাণ বসতভিটা নদীগর্ভে বিলীন হতো না।
তিনি আরও বলেন, গেল চার-পাঁচ ধরে বালুভর্তি জিও ব্যাগ ফেলছে পানি উন্নয়ন বোর্ড। ভাঙনকবলিত পরিবারের লোকজন আশ্রয় নিয়েছেন সরকারি খাস জমি, রাস্তা ও অন্যের জমিতে। অনেকে গ্রাম ছেড়ে চলে গেছেন অন্য গ্রামে। তিস্তা নদীর ভাঙনে হুমকিতে রয়েছে মন্ডলেরহাট সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়, মাদারীপাড়া মন্ডলেরহাট নিম্ন মাধ্যমিক বিদ্যালয় ও পাত্রখাতা রিয়াজুল জান্নাহ দাখিল মাদ্রাসা।
পাত্রখাতা রিয়াজুল জান্নাহ দাখিল মাদ্রাসার সুপার মাও. আব্দুল আজিজ আকন্দ জানান, স্থায়ীভাবে ভাঙন ঠেকানো না গেলে তিস্তা নদীর ভাঙনে মানচিত্র থেকে পাত্রখাতা গ্রামটি মুছে যাবে। ভাঙন থেকে রক্ষা করা যাবে না শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলো। স্থায়ীভাবে ভাঙনরোধে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের দ্রুত পদক্ষেপ নেওয়ার দাবি জানান।
পাত্রখাতা গ্রামে নদী ভাঙনে বসতভিটা হারানো নয়া মিয়া জানান, তার শেষ সম্বল ৮ শতাংশ বসতভিটা হারিয়ে পরিবার পরিজন নিয়ে আশ্রয় নিয়েছেন সরকারি রাস্তার উপর। একমাস আগে তার ৩ বিঘা আবাদি জমি চলে গেছে তিস্তার পেটে। তিনি এখন নিঃস্ব ও ভূমিহীন। জমি কিনে বসতভিটা তৈরি করার সামর্থ্য নেই তার। তাই সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের কাছে ভাঙন ঠেকানোর জোর দাবি জানান তিনি।
কুড়িগ্রাম পানি উন্নয়ন বোর্ডের নির্বাহী প্রকৌশলী আব্দুল্লাহ আল মামুন জানান, ওই এলাকায় তিস্তা নদীর ভাঙনরোধে ৭০ হাজার জিও ব্যাগ বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে। বালুভরে এসব জিও ব্যাগ নদীতে ফেলার কাজ শুরু হয়েছে। তিস্তা ও ধরলায় স্থায়ীভাবে ভাঙনরোধে ব্যবস্থা নেওয়ার জন্য সংশ্লিষ্ট ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষকে অবহিত করা হয়েছে বলে জানান তিনি। বালুভর্তি জিও ব্যাগ ফেলার কারণে ভাঙন পরিস্থিতি কিছুটা নিয়ন্ত্রণে এসেছে বলেও দাবি করেন তিনি।
ফুলবাড়ী উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) সুমন দাস জানান, চরগোরকমন্ডল এলাকায় দ্রুত ভাঙন ঠেকাতে কুড়িগ্রাম পানি উন্নয়ন বোর্ডের নির্বাহী প্রকৌশলীকে জানানো হয়েছে। আশা করি তিনি দ্রুত পদক্ষেপ নিবেন।
এসজি/