ভরা মৌসুমে লোডশেডিংয়ে কঠিন চ্যালেঞ্জের মুখে চা শিল্প
বিদ্যুৎ ও জ্বালানি সাশ্রয়ে লোডশেডিং ব্যবস্থা চালু হওয়ায় কঠিন চ্যালেঞ্জের মুখে পড়েছে মৌলভীবাজারের চা শিল্প। এই লোডশেডিং দিনে সর্বনিম্ন একঘন্টা থেকে চার-পাঁচ ঘন্টা স্থায়ী হচ্ছে। চায়ের সবচেয়ে ভরা মৌসুমে ঘন ঘন লোডশেডিংয়ের কারণে ব্যাহত হচ্ছে চায়ের উৎপাদন। শঙ্কা দেখা দিয়েছে চায়ের গুণগত মান নিয়েও। যার প্রভাব পড়বে রপ্তানি বাজারেও। চায়ের মান খারাপ হলে চা পাতা রপ্তানিও করা যাবে না। আবার রপ্তানি করা গেলে সেটি ফেরত আসার আশঙ্কা থাকবে। তখন বিশ্ববাজারে বাংলাদেশি চায়ের মর্যাদাহানি ঘটবে।
আর জেনারেটর চালিয়েও চায়ের কারখানাগুলোকে সচল রাখা যাচ্ছে না। কারণ চাহিদা অনুযায়ী জ্বালানি পাওয়া যাচ্ছে না। আবার জেনারেটর চালাতে গিয়ে ব্যয়ও বাড়ছে।
বিপর্যয়কর এই পরিস্থিতি থেকে সহসা উত্তরণের কোনো আশা দেখাতে পারছে না মৌলভীবাজারের পল্লী বিদ্যুৎ সমিতিও। সব মিলিয়ে এক ধরনের হতাশা দেখা দিয়েছে চা বাগানগুলোর মালিক ও কর্মকর্তাদের মধ্যে।
রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের কারণে জ্বালানা তেলের সংকট ও মূল্যবৃদ্ধির কারণে সরকার বিদ্যুৎ রেশনিং ব্যবস্থা চালু করেছে মঙ্গলবার (১৯ জুলাই) থেকে৷
মৌলভীবাজারকে বলা হয় চায়ের রাজধানী। দেশের সিংহভাগ চা উৎপাদন হয় এই জেলায়। সারাদেশে মোট ১৬৩টি চা বাগানের মধ্যে শুধু মৌলভীবাজার জেলাতেই রয়েছে ৯২টি। দেশের অভ্যন্তরীণ চায়ের চাহিদা মিটিয়ে বিদেশেও চা রপ্তানি করা হয় এখানকার চা। তবে হঠাৎ করে লোডশেডিংয়ের কবলে পড়ে চা শিল্প এখন নানামুখী সংকটে পড়েছে৷
চা শিল্প সংশ্লিষ্টরা বলছেন, হঠাৎ করে লোডশেডিং তীব্র হওয়ায় ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে উৎপাদন প্রক্রিয়া। জুলাই থেকে অক্টোবর পর্যন্ত চা উৎপাদনের মৌসুম সিজন। এই পিক সিজনে প্রতিটি বাগানের ফ্যাক্টরিতে ক্ষেত্রভেদে পাঁচ হাজার থেকে ৭০ হাজার কেজি চা পাতা আসে প্রক্রিয়াজাতের জন্য ৷ কিন্তু বিদ্যুৎ বিভ্রাটের ফলে এই কাঁচা পাতা প্রক্রিয়াজাত করতে সমস্যায় পড়ছেন বাগান মালিকরা ৷
দিনে একাধিকবার লোডশেডিং এর কবলে পড়ার কারণে ব্যবহার করতে হচ্ছে জেনারেটর, আর তাতে বেড়ে যাচ্ছে উৎপাদন খরচ ৷ পাশাপাশি সরকার জ্বালানি তেলের কৃচ্ছতা সাধনের নীতি প্রয়োগ করায় জেনারেটর চালানোর জন্য পর্যাপ্ত ডিজেলেরও সরবরাহ পাওয়া যাচ্ছে না বলে জানিয়েছেন সংশ্লিষ্টরা ৷ নিরবিছিন্ন বিদ্যুৎ সরবরাহ না থাকায় চা বাগানের কারখানাগুলো ২৪ ঘণ্টা চালু রাখা যাচ্ছে না। এতে করে নষ্ট হচ্ছে চায়ের গুণগত মান ৷
জেলার বড়লেখা উপজেলার স্কয়ার গ্রুপের মালিকানাধীন শাহবাজপুর চা বাগানের ব্যবস্থাপক মোহাম্মদ রাশেদুল ইসলাম বলেন, লোডশেডিংয়ের কারণে আমাদের মারাত্নক সমস্যা হচ্ছে, আমাদের খরচ বেড়ে গেছে ৷ বিদ্যুৎ যখন চলে যায় তখন আমাদের জেনারেটর চালাতে হয় আর জেনারেটর চালানোর জন্য প্রয়োজন হয় ডিজেল ৷ ডিজেলের লিটার ৮৫ টাকা করে। কিন্তু সেই ডিজেলও আমরা চাহিদামত পাচ্ছি না। তারপর সরকার আবার বলেছে পেট্রোল পাম্প সপ্তাহে একদিন বন্ধ থাকবে ৷ যে কারণে জেনারেটার চালিয়েও উৎপাদন ঠিক রাখতে পারছি না আমরা ৷
তিনি বলেন, এখন হচ্ছে আমাদের পিক সিজন। এই মুহূর্তে যার চা পাতা একেবারেই কম তাদেরও নয়-দশ হাজার কেজি পাতা আসে ফ্যাক্টরিতে ৷ এসব পাতা প্রক্রিয়াজাত করতে ১০-১২ ঘন্টা সময় লাগে। এ কারণেই আমাদের ২৪ ঘন্টা কারখানা চালু রাখতে হয় ৷ আমরা পাতা সংরক্ষণ করে রাখতে পারি না, দিনেরটা দিনেই প্রসেস করতে হয়। তাই লোডশেডিংয়ের জন্য সামগ্রিকভাবে আমাদের বেশ ক্ষতি হচ্ছে ৷
ন্যাশনাল টি কোম্পানি (এনটিসি) কুরমা চা বাগানের ব্যবস্থাপক মোহাম্মদ আক্তার শহীদ বলেন, চা উৎপাদনের খুব ক্ষতি হচ্ছে, আমি একটানা দুই ঘন্টা ফ্যাক্টরি চালাতে পারছি না ৷ ২৪ ঘণ্টার মধ্যে ১২ ঘণ্টার বিদ্যুৎ বন্ধ থাকছে ৷ একঘণ্টা বিদ্যুৎ থাকলে পরের দুই ঘন্টা বিদ্যুৎ থাকছে না। একটানা যদি ফ্যাক্টরি না চলে তাহলে চায়ের গুণগতমান নষ্ট হয় ৷
তিনি আরও জানান, বাগান থেকে পাতা উত্তোলনের পর থেকেই বিদ্যুতের প্রয়োজন। এই কাঁচা পাতা ফ্যান চালিয়ে একটানা ছয় থেকে সাত ঘন্টা টার্ফে রাখতে হয়। তারপর মেশিনে তুলতে হয় তখন যদি একঘণ্টা চলার পর মেশিন বন্ধ হয়ে যায় তাহলে পাতা মেশিনে আটকে নষ্ট হয়ে যায় ৷
ইস্পাহানী জেরিন চা বাগানের ব্যবস্থাপক সেলিম রেজা জানান, আমরা প্রতিদিন চার থেকে সাড়ে চার হাজার কেজি কাঁচা চা পাতা প্রক্রিয়াজাত করি ৷ নিরবিছিন্ন বিদ্যুৎ সরবরাহ না থাকায় আমরা গ্যাস চালিত জেনারেটর দিয়ে কারখানা চালু রেখেছি ৷ এতে আমাদের উৎপাদন ব্যয় বেড়ে গেছে৷
বাংলাদেশ টি অ্যাসোসিয়েশন সিলেট শাখার চেয়ারম্যান জিএম শিবলী জানান, বিদ্যুৎসমস্যার কারণে আমাদের সবগুলো বাগানেই চা উৎপাদন ব্যহত হচ্ছে ৷ চা উৎপাদন প্রক্রিয়ার সঙ্গে জড়িত সকল যন্ত্রপাতি আবার অনেক সময় জেনারেটরে চালানো সম্ভব হয় না ৷ তা ছাড়া সবকিছুর দাম বাড়লেও চায়ের দাম কিন্তু সেভাবে বাড়েনি। এখন এই সমস্যার জন্য গুণগতমান যদি কমে যায় তাহলে চায়ের দামও কমে যাবে ৷
এদিকে বাংলাদেশ চা বোর্ড সূত্রে জানা গেছে, এই বছর দেশে মোট চায়ের উৎপাদন লক্ষ্যমাত্রা ছিল ১০০ বিলিয়ন কেজি ৷ কিন্তু লোডশেডিং ও জ্বালানি তেলের মূল্যবৃদ্ধির কারণে এই লক্ষ্যমাত্রা অর্জন নিয়ে শঙ্কা প্রকাশ করেছেন চা শিল্প সংশ্লিষ্টরা ৷
বিদেশে চা রপ্তানিকারী প্রতিষ্ঠান মেঘনা গ্রুপ অব ইন্ডাস্ট্রিজের বিপণন কর্মকর্তা মো শাহজালাল বলেন, চায়ের গুণগতমান খারাপ হলে রপ্তানিবাজারে এর ব্যাপক প্রভাব পড়বে ৷ খারাপ মানের কোনো চা বিশ্ববাজারে বিক্রয় করা সম্ভব না। আর বিক্রয় করলেও সেটি ফেরত আসবে। যার ফলে দেশের চায়ের রপ্তানি বাজার ও চা শিল্প দুটোই মারাত্নকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হবে ৷
তবে সহসাই এই সমস্যা থেকে উত্তরণের পথ দেখাতে পারছেন না বিদ্যুৎ সংশ্লিষ্টরা ৷ মৌলভীবাজার পল্লী বিদ্যুৎ সমিতির জেনারেল ম্যানেজার প্রকৌশলী সাখাওয়াত হোসেন জানান, বিশ্ববাজারে যদি পরিস্থিতি স্থিতিশীল হয় তাহলে এটার একটা সুরাহা হবে। তা ছাড়া শীতকাল আসলে বিদ্যুতের চাহিদাও কমে যাবে ৷
তিনি আরও জানান, বর্তমানে বিদ্যুতের চাহিদা পিক আওয়ারে ৯০ মেগাওয়াট আর সরবরাহ ৬০ মেগাওয়াট ৷ অফপিক আওয়ারে চাহিদা ৫৫ মেগাওয়াট এবং সরবরাহ ৪০ মেগাওয়াট ৷
চা শিল্পের বিদ্যুৎ সমস্যার ব্যাপারে তিনি বলেন, একটি বা দুটি চা কারখানা হলে আমরা তাদের আলাদা গুরুত্ব দিতে পারতাম। কিন্তু এখানে একাধিক চা কারখানা হওয়ায় আমাদের পক্ষে কিছু করা সম্ভব হচ্ছে না।
এনএইচবি/এমএমএ/