চট্টগ্রামেও উধাও ভোজ্যতেল, পাইকারদের আশা সংকট কাটবে সহসা
সারাদেশের মতো চট্টগ্রামেও সয়াবিন ও পাম তেলের দামের লাগাম টেনে ধরা যাচ্ছে না। দুই শ্রেণির তেলের দাম বেড়ে যাওয়ার নেতিবাচক প্রভাব পড়তে শুরু করেছে সরিষার তেলেও। চট্টগ্রামে ইতিমধ্যে বোতলজাত সয়াবিন তেলের দাম ২০০ টাকা ছাড়িয়েছে। আর বোতলজাত সরিষার তেলের দাম প্রতি লিটার ৩০০ টাকা ছাড়িয়েছে। দাম বাড়লেও ভোজ্যতেল মিলছে না এমন অভিযোগ ক্রেতা বিক্রেতা উভয়ের।
তারা বলছেন, বাড়তি দামে ভোজ্যতেল কিনতে গিয়ে এমনিতে নাভিশ্বাস অবস্থা। সীমিত পরিমাণে কিনে হলেও চাহিদা সামাল দেওয়া যাচ্ছে। কিন্তু সমস্যা হচ্ছে বাজারে ভোজ্যতেলই মিলছে না। সারাদেশের মতো চট্টগ্রামে উধাও হয়ে গেছে। অথচ চট্টগ্রাম বন্দরে একের পর এক অয়েল ট্যাংকারে আসছে বিপুল অপরিশোধিত ভোজ্যতেল। এসব রিফাইনারিতে পরিশোধের পর বাজারে সরবরাহ পৌঁছতে অন্তত ১০ দিন লাগতে পারে। তবে আমদানি করা ভোজ্যতেল বাজারে পৌঁছার পর দাম কমবে কি না তার নিশ্চয়তা দিতে পারছেন না ব্যবসায়ীরা। তারা বলছেন, পরিস্থিতি কোন দিকে যায় তা বলা মুস্কিল। দাম বৃদ্ধি নিয়ে পাইকার ও খুচরা ব্যবসায়ীদের বক্তব্যও ভিন্ন।
রবিবার (৮ মে) বিকালে খাতুনগঞ্জ ট্রেড অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রি অ্যাসোসিয়েশনের সাধারণ সম্পাদক ছৈয়দ ছগির আহমদ বলেন, ‘বিভিন্ন কারণে দাম বাড়ছে। আমি মনে করছি তিন কারণে সয়াবিন ও পাম অয়েলের দাম বাড়ছে। এগুলো হচ্ছে ইন্দোনেশিয়ায় খরার কারণে সয়াবিন উৎপাদন বিঘ্নিত হওয়া, ইন্দোনেশিয়া থেকে পাম রপ্তানিতে নিষেধাজ্ঞা এবং রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ।
তার মতে আন্তর্জান্তিক বাজারে দাম বৃদ্ধির কারণে দেশের বাজারে ভোজ্যতেলের দামে প্রভাব পড়েছে। তেলের কিছু সংকট চললেও তা বেশিদিন থাকবে না। ব্যবসায়ীরা যেভাবেই হোক সয়াবিন পাম কিংবা সরিষার তেল সংগ্রহ করবেন। দাম বাড়তি দিতে হবে ঠিকই। কিন্তু বাজারে চলমান তেল সংকট বেশিদিন থাকবে না।
চট্টগ্রাম নগরীর চান্দগাঁও ১৪ নম্বর গ্যারেজ এলাকার বিসমিল্লাহ স্টোরের মালিক ইদরিস সওদাগর বলেন, শনিবার (৭ মে) রাত থেকে থেকে রবিবার (৮ মে) দুপুর পর্যন্ত নগরীর বিভিন্ন এলাকার পাইকারদের দোকানে গিয়েছি সয়াবিন তেল খুজতে। কিন্তু কোথাও মিলছে না। আমার দোকানেও মজুত নেই। এখন চিন্তায় পড়েছি নিয়মিত ক্রেতাদের কিভাবে সয়াবিন তেলের জোগান দিতে পারি।
তিনি বলেন, ‘সয়াবিন তেলের দাম সরকার নির্ধারণ করেছে প্রতি লিটার বোতলজাত ১৯৮ টাকা। বাস্তবে বিক্রি হচ্ছে ২১০ টাকা থেকে ২১৫ টাকা। বাড়তি দাম দিয়ে হলেও কিনে ক্রেতা চাহিদা সামাল দিতে চায়। কিন্তু বাজারে না মিললে ক্রেতাদের কী বলব?’
তবে ক্রেতাদের অনেকে মনে করেন সরকার বাড়তি দাম নির্ধারণ করে দেওয়ায় ব্যবসায়ীরা বেশি দাম নিচ্ছেন। কিন্তু মজুতদারির কারণে বাড়তি দামেও ক্রেতারা সয়াবিন তেল কিনতে পারছে না। শনিবার রাতে চট্টগ্রামের ফটিকছড়ি এলাকায় এক ব্যবসায়ীর বাড়ি থেকে ২ হাজার লিটারের বেশি সয়াবিন তেল জব্দ করা হয়। এরপর মজুতদারির বিষয়টি আবার আলোচনায় এসেছে।
সরেজমিন ঘুরে দেখা গেছে, নগরীর সব কাঁচাবাজারের মুদি দোকানে ক্রেতাদের দৃষ্টি সয়াবিন তেলের দিকে। দাম নিয়ে সরব আলোচনা করছেন বিক্রেতা ক্রেতা উভয়েই। ক্রেতারা অভিযোগ করেছেন, ‘নগরীর খুচরা দোকানে বাড়তি দামে মিলছে না ৩ লিটার ও ৫ লিটারের বোতলজাত তেল। এ ছাড়া ১ ও ২ লিটার সয়াবিন তেল কিনতে হচ্ছে নতুন নির্ধারিত দামে। অথচ এসব তেলের গায়ে পুরনো দামই লেখা আছে। অর্থাৎ কোম্পানির নতুন তেল সরবরাহের আগেই খুচরা বাজারে ভোক্তাদের গুণতে হচ্ছে বাড়তি টাকা। কম দামে কেনা সয়াবিন তেলেই বিক্রেতারা বিক্রি করছেন বাড়তি দামে। এসব বিষয় তদারকি করার কেউ নেই।
রবিবার (৮ মে) দুপুরে নগরীর চকবাজার কাঁচাবাজারে কথা হয় ক্রেতা নূর উদ্দিনের সঙ্গে। তিনি বলেন, ‘এটা অবিশ্বাস্য। দাম বাড়তি দেয়ার কথা বলার পরও সয়াবিন তেল পায়নি অনেক দোকানে। শেষে বাজারে ভেতরে এক মুদি দোকানদান তিন লিটারের একটি বোতল দিতে রাজি হয়েছেন। বাড়তি দামের সঙ্গে বড় যন্ত্রনা হিসাবে যোগ হয়েছে চাহিদা অনুযায়ী তেল না পাওয়া।’
বহদ্দারহাট কাঁচাবাজারের ব্যবসায়ী ওমর ফারুক জানান, পাইকারদের কাছ থেকে পর্যাপ্ত সরবরাহ না পেলে ক্রেতাদের কাছে কোত্থেকে দেব। আগে পাইকাররা সরবরাহ বাড়াক। তারপর ক্রেতাদের চাহিদার সমান তেল দিতে পারব। দামের চেয়ে এখন সরবরাহ পরিস্থিতিই আমাদের ভাবিয়ে তুলেছে। ক্রেতাদের সঙ্গে আমাদেরও প্রশ্ন এত তেল গেল কই।
শনিবার (৩ মে) খাতুনগঞ্জে প্রতি মণ (৩৭ দশমিক ৩২ কেজি) পাম তেল বিক্রি হয়েছে ৬ হাজার ৩৫০ টাকায়। এ ছাড়া প্রতি মণ সয়াবিন তেল বিক্রি হয়েছে ৭ হাজার টাকায়। রবিবার (৮ মে) একই দাম স্থির ছিল।
কনজ্যুমারস অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ (ক্যাব) চট্টগ্রাম বিভাগীয় সভাপতি এস এম নাজের হোসাইন বলেন, বাজার থেকে সয়াবিন তেল উধাও হয়েছে লুকিয়ে ফেলা কিংবা সরিয়ে ফেলার কারণেই। সয়াবিনের মজুত যথেষ্ট ছিল। যা দিয়ে দাম বেশি নিলেও সরবরাহ স্বাভাবিকভাবেই পেত ক্রেতারা। এ ক্ষেত্রে প্রশাসনের তদারকির অভাব রয়েছে। যার কারণে ক্রেতারা বাজারে সয়াবিন তেল পাচ্ছে না।
প্রসঙ্গত গত বৃহস্পতিবার (৬ মে) বোতলজাত সয়াবিন তেলের দাম ৩৮ টাকা বাড়িয়ে ১৯৮ টাকা নির্ধারণ করে বাংলাদেশ ভেজিটেবল অয়েল রিফাইনার্স অ্যান্ড বনস্পতি ম্যানুফ্যাকসার্স অ্যাসোসিয়েশন। এ ছাড়া ৫ লিটার বোতলজাত সয়াবিন ৯৮৫ টাকায় নির্ধারণ করে। অপরদিকে খোলা সয়াবিন তেল ১৪০ টাকা থেকে বেড়ে ১ লিটার ১৮০ টাকা ও পাম তেল ৪২ টাকা বেড়ে ১ লিটার বিক্রি হবে ১৭২ টাকায়। মূলত নতুন দাম নির্ধারণের পর থেকে সয়াবিন তেলের দামে নৈরাজ্য চলছে।
এমএমএ/