বাঁধ ভেঙে পুরো বছরের স্বপ্ন ভাসিয়ে নিয়ে গেল
দিগন্তজোড়া ধানক্ষেত। বিস্তীর্ণ হাওরের সবুজ ধানসায়রে দোলা দিচ্ছিল মায়াবী ধানের শীষ। আর কদিন পরই হাওরের অগণিত গোপাট মুখরিত হয়ে উঠতো কৃষাণ-কৃষাণি আর ভাগালুদের পদচারণায়।
সুনামগঞ্জ জেলার লাখ লাখ মানুষের জীবিকার প্রধান অবলম্বন এই ধান। কিন্তু হাওর ভর্তি সেইসব সোনার ধান ঘরে তোলার স্বপ্ন যেন চোখের সামনেই তলিয়ে যাচ্ছে পানির নিচে।
সর্বশেষ রবিবার (১৭ এপ্রিল) রাতে সুনামগঞ্জের দিরাই উপজেলার হুরামন্দিরা হাওরের বাঁধ ভেঙে আরও ৩০০ হেক্টর জমির ফসল পানিতে তলিয়ে গেছে। এর আগে রবিবার দিনে তাহিরপুর উপজেলার গুরমার বর্ধিতাংশের বাঁধটি ভেঙে ধর্মপাশা ও তাহিরপুরের হাজারো কৃষকের পাকা-আধাপাকা ধান ডুবে সারা বছরের স্বপ্ন নিঃশেষ হয়ে যায়।
উজানে টানা বৃষ্টি ও পাহাড়ি ঢলে সুনামগঞ্জের নদ-নদীর পানি বৃদ্ধির ফলে ঢলের স্রোতে রবিবার (১৭ এপ্রিল) রাত থেকে দিরাইয়ে হুরামন্দিরা হাওরের ৪২ নম্বর পিআইসি বাঁধের সাতবিলা রেগুলেটর সংলগ্ন অংশ ভেঙে গেছে। এতে ৩০০ হেক্টর বোরো ধান তলিয়েছি বলে জানিয়েছেন স্থানীয়রা। তবে কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের দাবি ২০০ হেক্টর জমির ধান হাওরের পানিতে ডুবেছে।
এদিকে, নদীর পানি বাড়ায় তাহিরপুরের শনির হাওরের বৈজ্ঞানি স্লুইস গেট দিয়ে পানি চুঁইয়ে হাওরে প্রবেশ করছে।
জামালগঞ্জের মহালিয়া হাওরের হিজলা পার্শ্ববর্তী বাঁধের বুরুঙ্গা দিয়ে পানি চুঁইছে। শাল্লার বরাম হাওরের ২৪, ২৫ ও ২৬ ও ভাণ্ডা বিলের ১২ নম্বর পিআইসির বাঁধ এবং ছায়ার হাওরের শাল্লা সেতু হতে মুক্তারপুর সেতু পর্যন্ত বাঁধ নিয়ে উৎকণ্ঠায় রয়েছেন কৃষকরা। জগন্নাথপুরের সর্ববৃহৎ নলুয়া হাওরে আবারও কয়েকটি বেড়িবাঁধ ঝুঁকিতে পড়েছে। পানি বেড়ে যাওয়ায় শনিবার রাতে নলুয়া হাওরে নতুন করে ৯ ও ১৪ নম্বর প্রকল্পে ফাটল দেখা দিয়েছে। ক্ষতিগ্রস্ত স্থানে কাজ চলছে। এ ছাড়া ৫, ৬, ৭, ৯, ১৪, ২০ নম্বর বেড়িবাঁধসহ কমপক্ষে ১০টি বাঁধ ঝুঁকিতে আছে।
হুরামন্দিরা হাওরের কৃষক মহিবুর রহমান ঢাকাপ্রকাশ-কে বলেন, দিনরাত বাঁধে পরিশ্রম করেছি, বাঁধটা যেনো না ভাঙে। আমি গরিব মানুষ, প্রায় ৩৫ হাজার টাকা ঋণ করে ধান করেছিলাম, কিন্তু রাতে বাঁধ ভেঙে সব ধান তলিয়ে গেছে। এখন পরিবারের মা-বাবা ও সন্তানদের নিয়ে কীভাবে চলবো। আমরারে তো সরকারেও দেখে না।
হাওরপাড়ের আরেক কৃষক সালাম আহমেদ বলেন, বাঁধটি পাড়ের অংশ থেকে ক্রমেই সরিয়ে নদীর দিকে আনা হয়েছে। যেন স্লোপের অংশের মাপ নেওয়ার সময় বেশি মাটি দেখাতে পারে। নদীতে পানি আসার পরই বাঁধ দেবে যায়। বিপদ হয় আমাদের। বাঁধের পিআইসি ও যারা তদারকির দায়িত্বে ছিল তাদের বিচার হওয়া জরুরি। বাঁধে ধস ও ফাটল দেখা দেবার পর যেভাবে সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা এসেছেন বাঁধ নির্মাণের সময় সেভাবে তাদের দেখা যায়নি।
হাওরের ফসল হারানো কৃষকদের সঙ্গে কথা হলে তাহিরপুর উপজেলার শ্রাবণ মিয়া বলেন, আমার নিজের চোখের সামনেই এক ভয়াবহ দৃশ্য দেখলাম। আমরা এই রকম দৃশ্য চিন্তাও করিনি। ভেবেছিলাম দু-একদিনের মধ্যে হাওরের সব ধান গোলায় তোলতে পারবো। পুরো বছর নিয়ে অনেক স্বপ্ন দেখেছিলাম। কিন্তু সেই স্বপ্ন ভাসিয়ে নিয়ে গেলো পানি। কী ভয়াবহ দৃশ্যরে ভাই কী যে ভয়াবহ! আমার সব শেষ!
স্থানীয় বাসিন্দা ও কৃষকরা জানিয়েছেন, গত ১৫ দিন ধরে গুরমার বর্ধিতাংশের এই বাঁধটি রক্ষার চেষ্টা করছিলেন। রবিবার (১৭ এপ্রিল) টাঙ্গুয়া হাওরের ওয়াচ টাওয়ারের পাশের অংশ ভেঙে হাওরে এমন বিপর্যয় দেখা দেয়। গুরমা বর্ধিতাংশের বাঁধে ১৩টি পিআইসি এবার বাঁধের কাজ করেছে। বরাদ্দ ছিল প্রায় আড়াই কোটি টাকা। এই বাঁধে ফসল রক্ষা হয় তাহিরপুর উপজেলার নোয়াল, গলগলিয়া, পানা, বলাইচাতল, উলান, জিনারিয়া, মানিকখিলা, গায়েরকিত্তা এবং ধর্মপাশা-মধ্যনগর উপজেলার কলমা ও হুরি বিলের। বাঁধটি গুরমার হাওরের মূল বাঁধটিকেও সুরক্ষা দেয়।
রবিবার সকালে হঠাৎ করে বাঁধের একাংশ দেবে উপর দিয়ে পানি প্রবেশ করতে থাকে। হাওরে পানি প্রবেশ শুরু হলে নিরুপায় হয়ে পড়েন বাঁধের কাজে থাকা কৃষকসহ সংশ্লিষ্ট সকলেই।
কৃষকরা বাঁধ ছেড়ে হাওরের দিকে ছুটতে থাকেন, জমিতে থাকা নিজের পাকা ধান ঘরে তুলে আনার চেষ্টা ছিল তাদের। সেই চেষ্টাও বৃথা যায়। কিছুক্ষণের মধ্যে ভেসে যায় হাওর। হাওরপাড়ের পাঠাবুকা, ভবানীপুর, সন্তোষপুর, মানিকটিলা, রামসিংহপুর, লামাগাঁও, উক্তিয়ারগাঁও, নোয়াগাঁও, বলাইকান্দি, গোলাভারি, গাঞ্জাইল, মোয়াজ্জেমপুরসহ অসংখ্য গ্রামের কৃষকরা এ সময় আহাজারি করতে থাকেন।
সুনামগঞ্জ পানি উন্নয়ন বোর্ড জানিয়েছে, গেল তিন দিনে উজানে (মেঘালয় ও চেরাপুঞ্জি) ও সুনামগঞ্জে বৃষ্টি হওয়ায় নদীর পানি বেড়েছে। সুনামগঞ্জ শহরের ষোলঘর পয়েন্টে সুরমা নদীর পানি বৃদ্ধি পেয়ে বিপৎসীমার ৬ সেন্টিমিটার নিচ দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। এ ছাড়া বিভিন্ন নদ-নদীর পানি বৃদ্ধি পাওয়ায় ঝুঁকিতে রয়েছে ফসলরক্ষা বাঁধ।
সুনামগঞ্জের জেলা প্রশাসক মো. জাহাঙ্গীর হোসেন ঢাকাপ্রকাশ-কে বলেন, উজানের বৃষ্টিই আমাদের জন্য সমস্যা বেশি। মাটির বাঁধগুলো ঢলের পানির ব্যাপক চাপ সামলাচ্ছে। মাটি নরম হয়ে গেছে। অনেক বাঁধে ফাটল ও ধস আছে। সেগুলোতে দিন-রাত কাজ হচ্ছে। হাওরের ফসলরক্ষা বাঁধ রক্ষায় জেলা প্রশাসনের সকল কর্মকর্তা মাঠ পর্যায়ে কাজ করছে। বাঁধ রক্ষায় আমরা সর্বাত্মক চেষ্টা করছি।
এমএসপি