গরমে রামেক হাসপাতালে উদ্বেগজনক হারে বাড়ছে ডায়রিয়া রোগী
রাজশাহীতে শীতের আবহ শেষ হতে না হতেই ফাল্গুনের প্রথম সপ্তাহ থেকে বেড়েছে ডায়রিয়ার প্রকোপ। এদিকে, চৈত্র শেষ হলেও কমেনি খরতাপ। কয়দিন ধরে তীব্র দাবদাহে পুড়ছে রাজশাহী। একদিকে গরম আর অন্যদিকে মানুষের অসচেতনতায় উদ্বেগজনক হারে প্রকোপ বাড়ছে ডায়রিয়ার। রাজশাহী মেডিকেল কলেজ (রামেক) হাসপাতালে প্রতিদিন ৪০ এর বেশি ডায়রিয়া রোগী ভর্তি হচ্ছেন। যা নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন চিকিৎসকসহ সংশ্লিষ্টরা।
সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, রাজশাহী মেডিকেল কলেজ (রামেক) হাসপাতালে গত ফেব্রুয়ারি মাসে ৬৫৫ জন ডায়রিয়া রোগী চিকিৎসা নিয়েছেন। মার্চে এ সংখ্যা দ্বিগুণেরও বেশি বৃদ্ধি পায়। মার্চ মাসে ১ হাজার ৬৩৫ জন ডায়রিয়া রোগী চিকিৎসা নেন। এ ছাড়া এপ্রিলের ১২ তারিখ পর্যন্ত ১৩টি ওয়ার্ডে ১ হাজার ১২৬ জন ডায়রিয়া রোগী চিকিৎসা নিয়েছেন। আর গত আড়াই মাসে ডায়রিয়া আক্রান্ত হয়ে পানি শূন্যতায় পাঁচ রোগীর মৃত্যু হয়েছে।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, আবহাওয়া পরিবর্তনের এ সময় ডায়রিয়ার প্রকোপ থাকে। তবে প্রকোপ এবার কিছুটা বেশি বলেই মনে হচ্ছে। আবহাওয়া পরিবর্তনের সঙ্গে এখন রমজান মাস চলছে। এ সময় বাইরের অস্বাস্থ্যকর ফাস্টফুড মানুষ বেশি খাচ্ছে। দোকানিরা ভালোভাবে না ঢেকেই খোলা জায়গায় খাবার বিক্রি করছেন। আঁখের রসসহ যেসব শরবত রাস্তা-ঘাটে বিক্রি হচ্ছে, যেগুলোও অস্বাস্থ্যকর পরিবেশে তৈরি হচ্ছে। শরবত তৈরিতে তারা কী পানি ব্যবহার করছেন এটা নিয়েও শঙ্কা রয়েছে। এসব খাবার খেয়েই মানুষ ডায়রিয়ায় আক্রান্ত হচ্ছেন।
বিশেষজ্ঞরা আরও বলছেন, মুখের মাধ্যমে জীবাণু প্রবেশ ছাড়া ডায়ারিয়া হওয়ার সম্ভাবনা থাকে না। তাই কী খাচ্ছি, কোথায় খাচ্ছি এ বিষয়ে সচেতনতা প্রয়োজন।
রামেক হাসপাতালের মেডিসিন বিভাগের বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক ডা. মাহাবুবুর রহমান বাদশাহ বলেন, হঠাৎ গরম ও আবহাওয়ার পরিবর্তন জনিত কারণে ডায়রিয়া আক্রান্ত রোগীর সংখ্যা বেড়েছে। তবে প্রতিদিন যে হারে বাড়ছে তা উদ্বেগজনক! ডায়রিয়ায় শিশু ও বয়স্করা বেশি আক্রান্ত হচ্ছেন। কিডনি ফেইলর হয়ে মৃত্যুও হচ্ছে। মূলত মুখের মাধ্যমে অস্বাস্থ্যকর খাবার খাওয়ার কারণে ডায়রিয়া হচ্ছে। তাই বাইরের অস্বাস্থ্যকর খাবার আমাদের পরিহার করতে হবে।
তিনি আরও জানান, ডায়রিয়া সংক্রামক রোগ। যদিও মৃত্যুঝুঁকি খুবই কম। তারপরও ডায়রিয়া হলে বাসায় অপেক্ষা না করে বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকের পরামর্শ নিতে হবে। অন্যথায় কিডনি অকেজো হয়ে মৃত্যুও হতে পারে।
এদিকে, রাজশাহী মেডিকেল কলেজ (রামেক) হাসপাতালে শুক্রবার (১৫ এপ্রিল) সকাল ৯টা থেকে শনিবার (১৫ এপ্রিল) সকাল ৯টা পর্যন্ত ডায়রিয়া ব্লকে ৬৯ জন রোগী ভর্তি হয়েছেন। পূর্বের রোগী সংখ্যা ছিল ১৬৯ জন। ২৪ ঘণ্টায় ছাড়পত্র নিয়ে বাড়ি ফিরেছেন ৩১ জন। সর্বোশেষ ২০৭ জন ডায়রিয়া রোগী ভর্তি ছিল। এর আগের ২৪ ঘণ্টায় ৪৭ জন ডায়রিয়া রোগী ভর্তি হয়েছিল।
শনিবার (১৬ এপ্রিল) দুপুরে রাজশাহী মেডিকেল কলেজ (রামেক) হাসপাতাল ঘুরে দেখা যায়, ১০, ২৪ ও ২৬ শিশু ওয়ার্ডসহ ১৩, ১৪, ১৫, ১৬, ১৭, ৩৬, ৩৭, ৩৮, ৪২ ও ৪৯ নম্বর ওয়ার্ডের প্রত্যেকটিতেই ডায়রিয়া রোগী আছে।
বেড না পেয়ে বারান্দায় চিকিৎসা নিচ্ছেন অনেক রোগী। অধিকাংশ ওয়ার্ডের পরিচ্ছন্নতা ব্যবস্থা সন্তোষজনক নয়। ভ্যাপসা গরমের মধ্যে ছড়াচ্ছে দুর্গন্ধও। ভাঙা ও অপরিচ্ছন্ন শৌচাগার এবং পয়ঃনিষ্কাশন ব্যবস্থা নিয়ে ক্ষোভ প্রকাশ করছেন রোগীর স্বজনসহ চিকিৎসকরাও।
তাদের অভিযোগ, হাসপাতালের পয়ঃনিষ্কাশন ব্যবস্থা খুবই দুর্বল। কোথাও শৌচাগারের দরজা ভাঙা, কোথাও ওভারলোড হয়ে দুর্গন্ধ ছড়াচ্ছে। কোথাও আবার পানি নেই। এমন পরিস্থিতিতে বিপাকে পড়তে হচ্ছে রোগী ও স্বজনদের। কখনো কখনো চিকিৎসা সংশ্লিষ্টরাও এমন দুর্ভোগের মধ্যে পড়ছেন।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক ইন্টার্ন চিকিৎসক বলেন, আবহাওয়া পরিবর্তনের কারণে ডায়রিয়ার প্রকোপ বেড়েছে। এসব রোগীদের সাধারণত বাথরুমে যাওয়া লাগে বেশি। এর মধ্যে তাদের অতিরিক্ত স্বজনের চাপ। যারা হাসপাতালে এসে পরিচ্ছন্নতার নূন্যতম বিষয়গুলো মানছেন না।
অপরদিকে, হাসপাতালের পরিচ্ছন্নতা ও পয়ঃনিষ্কাশন ব্যবস্থাও দুর্বল। এতে সবাইকেই বিব্রতকর পরিস্থিতির সম্মুখীন হতে হচ্ছে। এমন পরিবেশে সুস্থ মানুষও অসুস্থ হয়ে যাবে।
৩৭ নম্বর ওয়ার্ডের বারান্দায় চিকিৎসা নেওয়া এক রোগীর স্বজন আশরাফ আলী জানান, গত বৃহস্পতিবার রাতে তার মা কে এই ওয়ার্ডে ভর্তি করেছেন। রোগীর চাপ প্রচুর। দিনে একবার করে ডাক্তার দেখে যাচ্ছেন। ওষুধের সরবরাহ থাকলেও চিকিৎসা পরিবেশটা খুবই খারাপ! একটু পরপর ভ্যাপসা গরমের সঙ্গে দুর্গন্ধ ভেসে আসছে।
শিশু ওয়ার্ডে চিকিৎসাধীন আরেক রোগীর স্বজন নাইমুল হাসান বলেন, শিশু ওয়ার্ডে রোগীর চাপে পা ফেলার জায়গা নেই। অধিকাংশই ডায়রিয়ার রোগী। পয়ঃনিষ্কাশন ব্যবস্থা সম্পর্কে বলেও লাভ নেই। ডাক্তারদের একবারের বেশি দু’বার দেখা মেলে না। প্রয়োজন হলে বারবার নার্সদের ডাকতে হয়। তারাও তেমন গুরুত্ব দেয় না।
এ বিষয়ে রাজশাহী মেডিকেল কলেজ (রামেক) হাসপাতালের পরিচালক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল শামীম ইয়াজদানী বলেন, ডায়রিয়া রোগীর প্রকোপ বৃদ্ধি পাওয়ায় ওষুধসহ পর্যাপ্ত প্রস্তুতি নেওয়া হয়েছে। তবে পয়ঃনিষ্কাশন নিয়ে কিছু সমস্যা আছে। বাথরুম একটা ঠিক করতে না করতেই আরেকটা নষ্ট হচ্ছে। হাসপাতালের জনবলের অনেক সংকট আছে। ১ হাজার ২০০ বেডের হাসপাতালে যে জনবল দরকার তার থেকে অনেক কম জনবল। অথচ চিকিৎসা দিতে হচ্ছে তিন হাজারের বেশি রোগীকে।
তিনি আরও বলেন, এতো সংকটের মধ্যেও বর্তমানে অস্থায়ী ভিত্তিতে কিছু লোক নিয়ে কাজ করানো হচ্ছে। তবে রোগীদের সর্বোচ্চ সেবা দিতে তারা আন্তরিকতার সঙ্গে কাজ করে যাচ্ছেন।
এমএসপি