করোনার পর ইউক্রেন যুদ্ধের প্রভাব চট্টগ্রাম-কক্সবাজার রেলপথে
বৈশ্বিক মহামারি করোনা’র (কোভিড-১৯) পর এবার ইউক্রেন যুদ্ধের প্রভাব পড়েছে চট্টগ্রাম-কক্সবাজার রেলপথ নির্মাণ কাজে। এ ছাড়া নির্মাণ সামগ্রির দাম বেড়ে যাওয়ায় প্রকল্পের অনেক প্রয়োজনীয় মালামাল কেনাও কঠিন হয়ে পড়েছে। বিদেশ থেকে কেনা মালামাল পরিবহনে জাহাজ ভাড়াও বেড়েছে অনেক।
এরই মধ্যে প্রকল্পের মেয়াদ আরেক দফা বাড়িয়ে ২০২৪ সালের জুন পর্যন্ত করা হয়েছে। এরপরও প্রকল্প কাজ এগিয়েছে ৬৯ শতাংশ। তবে রেলওয়ে আশা করছে, আগামী বছরের জুনেই অর্থাৎ ২০২৩ সালে প্রকল্প কাজ শেষ হবে।
এ ব্যাপারে প্রকল্পের পরিচালক মফিজুর রহমান ঢাকাপ্রকাশ-কে বলেন, জমি অধিগ্রহণ নিয়ে শুরুতেই প্রকল্প কাজে সময়ক্ষেপণ হয়। এরপর এলো করোনার ধাক্কা। সবকিছু এড়িয়ে প্রকল্প কাজ এগুতে থাকে। এমন সময় বাঁধে রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ। যুদ্ধ শুরুর পর দেশের সব প্রকল্পের মতো রেলপথ নির্মাণের এ প্রকল্পেও প্রভাব পড়েছে।প্রকল্প কাজের জন্য মালামাল আনতে হয় দেশের বাইরে থেকে। সেইসব মালের দাম বেড়েছে। আবার বিদেশ থেকে কেনা পণ্য জাহাজে পরিবহন করা হয়। সেই জাহাজ ভাড়াও বেড়েছে। সব কিছু মিলিয়ে প্রকল্প কাজে নেতিবাচক প্রভাব পড়েছে।
ইতিমধ্যে প্রকল্পের মেয়াদ বাড়ানোর আবেদন করা হয়েছে। চলতি বছরের জুনের পরিবর্তে ২০২৪ সালের জুন পর্যন্ত প্রকল্পের মেয়াদ বর্ধিত করার বিষয় আবেদনে বলা হয়েছে। আমরা আশা করি, ২০২৩ সালের জুনেই প্রকল্প কাজ শেষ হবে।
২০২৩ সালের মধ্যে প্রকল্প কাজ শেষ হলে ২০২৪ সালের জুন পর্যন্ত প্রকল্পের মেয়াদ বাড়ানোর আবেদন করা হলো কেন? এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ২০২৩ সালের জুনেই শেষ হবে কাজ। ট্রেনও চলাচল শুরু হবে। বাকি এক বছর অর্থাৎ ২০২৩ সালের জুন থেকে ২০২৪ সালের জুন পর্যন্ত অবজারভেসন পিরিয়ড। এই সময় প্রকল্পের ত্রুটি বিচ্যুতি খুঁটিনাটি বিষয় পর্যবেক্ষণ করা হবে। এটাই বড় প্রকল্পের ক্ষেত্রে নিয়ম।
রেলওয়ের সংশ্লিষ্টরা জানান, চট্টগ্রাম-কক্সবাজার রেলপথের কাজ দ্রুত এগোচ্ছে। প্রকল্পের ৬৯ শতাংশই কাজই এখন শেষ। বাকি ৩১ শতাংশ কাজ আগামী বছরের মধ্যে শেষ হওয়ার প্রত্যাশা করছে রেলওয়ে। আর আগামী বছরের মাঝামাঝি থেকে চলবে ট্রেন।
প্রকল্প কাজে সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, বিরামহীভাবে চলছে কাজ। প্রধানমন্ত্রীর অগ্রাধিকার প্রকল্পের কাজে কোনো ধীরগতি নেই। মাঝে করোনার সময় কাজ কিছুটা ব্যহত হয়। এখন পুরোদমে চলছে নির্মাণ কাজ।
প্রকল্প বাস্তবায়নে দিন-রাত কাজ করছেন শ্রমিকরা। একসঙ্গেই চলছে রেললাইনে মাটি ভরাট, ব্রিজ ও পাস নির্মাণ, রেলস্টেশন তৈরির কাজ। ঢাকা থেকে চট্টগ্রাম রেলপথ ৩২০ কিলোমিটার। চট্টগ্রামের দোহাজারি থেকে কক্সবাজার পর্যন্ত ১০০ কিলোমিটার।
চাপ কমবে সড়ক পথে:
এক সময় চট্টগ্রাম-দোহাজারি ৫০ কিলোমিটার রেলপথে আট জোড়া ট্রেন চালু ছিল। এ পথে যাত্রী সংখ্যাও ছিল প্রচুর। রেলপথে যাত্রী চাহিদার কারণে ওই সময় টিকিটই পাওয়া যেত না। কিন্তু নব্বইয়ের দশকের শুরু থেকে পরিস্থিতি বদলে যেতে থাকে। গোল্ডেন হ্যান্ডশেকের নামে রেলওয়ের প্রচুর কর্মীকে বিদায় করার উদ্যোগ নেওয়া হয়। আর কর্মচারী সঙ্কট, যাত্রী সঙ্কটের কথা বলে এ রেলপথে একে একে লাভজনক বেশিরভাগ ট্রেন বন্ধ করে দেওয়া হয়।
২০২০ সালের মার্চে করোনার সংক্রমন শুরুর পর চলাচলকারী একজোড়া ট্রেনও বন্ধ করে দেওয়া হয়। ইঞ্জিন সঙ্কটের কথা বলে এই পথে যাত্রীবাহী আর কোনো ট্রেন চালু করা হয়নি। চলছে একসেট ডেমু ট্রেন। তাও শুধু নির্ধারিত কয়েকটি গন্তব্যের যাত্রী পরিবহন করে ট্রেনটি। ফলে, যাত্রী চাহিদা সামাল দেওয়া যাচ্ছে না। সেইসঙ্গে বেড়েছে সড়কের উপর চাপ। রেলপথে ট্রেন চলাচল কম থাকায় দক্ষিণ চট্টগ্রামে সড়ক পথে বেড়েছে যাত্রীর চাপ। এতে প্রায় সময়ই ঘটছে দুর্ঘটনা। অথচ ট্রেনে পর্যাপ্ত যাত্রী পরিবহন হলে সড়কে চাপ কমত। সাশ্রয়ী মূল্যে যানজটহীনভাবে দক্ষিণ চট্টগ্রামের বিভিন্ন গন্তব্যে সহজে যাতায়াত করা যেত বলে জানান সংশ্লিষ্টরা।
প্রকল্প কাজে জড়িত এক প্রকৌশলী জানান, রেল লাইনের পাশাপাশি স্টেশন নির্মাণ কাজ এগিয়ে যাচ্ছে। ইতিমধ্যে কক্সবাজার সদর, ঈদগাঁও, চকরিয়া, হারবাং এবং রামু এলাকায় ২৫ কিলোমিটার রেললাইন স্থাপনের কাজ শেষ হয়েছে। বাকি ৭৫ কিলোমিটার রেললাইন স্থাপনের পাশাপাশি চলছে সিগনেলিং তার টানার কাজও। মাটি ভরাটের কাজ শেষ হয়েছে ৮৫ শতাংশ। ৮০ শতাংশ কাজ শেষ হয়েছে মেজর ও মাইনর ব্রিজ এবং কালভার্টগুলোর। তাই প্রকল্প কাজের বড় কোন বাধা আর নেই।
সংশ্লিষ্টরা জানান, চকরিয়া থেকে কক্সবাজার অংশে ২০টি সেতুর মধ্যে ১৭টির কাজ শেষ হয়েছে। বসানো হয়েছে সাড়ে ১২ কিলোমিটার রেললাইন। দোহাজারি-চকরিয়া অংশে ১৯টি সেতুর মধ্যে সাঙ্গু নদীর উপর ১টি, মাতামুহুরী নদীর উপর ২টি এবং বাঁকখালী নদীর উপর ১টি বড় রেলসেতুর নির্মাণ কাজ সম্পন্ন হয়েছে। বাকিগুলোর নির্মাণকাজ চলমান আছে।
কক্সবাজারের আইকনিক স্টেশনসহ সব মিলিয়ে ৯টি স্টেশন নির্মাণ করা হচ্ছে এই রেলপথের জন্য। এর মধ্যে দুলাহাজরা রেল স্টেশনের কাজ শেষের দিকে। দোহাজারি, লোহাগাড়া, হারবাং, চকরিয়া, ঈদগাঁও এবং কক্সবাজার রেলস্টেশন নির্মাণের কাজ চলছে। শুরু হয়েছে সাতকানিয়া এবং রামুতে রেল স্টেশন নির্মাণের কাজও। রেলপথ বসানোর জন্য প্রয়োজনীয় মাটির কাজ ইতিমধ্যে শেষ হয়েছে। সব মিলিয়ে রেললাইন বসেছে ২৫ কিলোমিটার পথে।
রেলওয়ে সূত্র জানায়, ২০১০ সালের ৬ জুলাই ‘চট্টগ্রামের চন্দনাইশ উপজেলার দোহাজারী হতে রামু হয়ে কক্সবাজার এবং রামু থেকে মিয়ানমারের ঘুমধুম সীমানা পর্যন্ত সিঙ্গেল লাইন ডুয়েলগেজ ট্র্যাক নির্মাণ (প্র্র্র্র্র্রথম সংশোধিত)’ প্রকল্প অনুমোদন দেয় সরকার। প্রকল্পের অধীনে দোহাজারী থেকে কক্সবাজার রামু পর্যন্ত ১০০ কিলোমিটার এবং রামু থেকে ঘুমধুম পর্যন্ত ২৯ কিলোমিটার রেললাইন নির্মানের কথা ছিল। ২০১১ সালের ৩ এপ্রিল প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এই রেললাইন প্রকল্পের উদ্বোধন করেন। এর প্রায় আট বছর পর ২০১৮ সালে ডুয়েলগেজ সিঙ্গেল ট্র্যাকের এই রেললাইন প্রকল্পের নির্মাণ কাজ শুরু হয়। তবে মিয়ানমার সরকারের সম্মতি না থাকায় আপাতত রামু থেকে ঘুমধুম পর্যন্ত ২৯ কিলোমিটার রেললাইনের কাজ হচ্ছে না। দোহাজারী থেকে কক্সবাজার রামু পর্যন্ত ১০০ কিলোমিটার রেললাইন নির্মাণে প্রথমে ব্যয় ধরা হয় ১ হাজার ৮৫২ কোটি টাকা। পরে ২০১৬ সালে প্রকল্প প্রস্তাব সংশোধন করে ব্যয় বেড়ে দাঁড়ায় ১৮ হাজার ৩৪ কোটি ৪৭ লাখ টাকা। অর্থায়ন করেছে এশিয়ান উন্নয়ন ব্যাংক (এডিবি) ও বাংলাদেশ সরকার।
২০১৩ সালের মধ্যে প্রকল্পের কাজ শেষ করার কথা থাকলেও ঠিকাদার নিয়োগ করা হয় ২০১৭ সালে। ওই সময় প্রকল্পের কাজ শেষ করার কথা ছিল ২০২২ সালের জুনে। তবে জমি অধিগ্রহণ, বনাঞ্চল নিরাপদ রাখার জটিলতাসহ নানাভাবে প্রকল্প বাধাগ্রস্ত হয়। এখন আরও দুই বছর বাড়ানোর প্রস্তাব করা হয়েছে।
কক্সবাজার সদর থেকে ৭ কিলোমিটার পূর্ব-উত্তরে ঝিলংজা ইউনিয়নের হাজিপাড়া এলাকায় ২৯ একর জমির ওপর নির্মাণ করা হচ্ছে কক্সবাজার আইকনিক রেলস্টেশন। আইকনিক স্টেশনটিকে সৈকতের ঝিনুকের আদলে তৈরি করা হচ্ছে।
আইকনিক রেলস্টেশন ভবনটির আয়তন ১ লাখ ৮২ হাজার বর্গফুট। ছয়তলা এ ভবনটির বিভিন্ন অংশে অবকাঠামো নির্মাণে কাজ চলমান আছে। নির্মাণাধীন এই আইকনিক ভবন ঘেঁষে হচ্ছে রেলওয়ের প্লাটফর্ম। এর পাশেই রেলওয়ের আবাসিক এলাকা গড়ে তোলা হয়েছে। সেখানে আটটি ভবনের কাজ শেষ পর্যায়ে।
স্টেশনটিতে আবাসিক হোটেলের পাশাপাশি ক্যান্টিন, লকার, গাড়ি পার্কিং ইত্যাদি ব্যবস্থা রাখা হয়েছে। দিনে ৪৬ হাজার মানুষ এই স্টেশন দিয়ে আসা-যাওয়া করতে পারবে।
প্রকল্প সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা জানান, চট্টগ্রাম থেকে কক্সবাজার এখন সিঙ্গেল লাইন স্থাপন করা হলেও ভবিষ্যতে ডাবল লাইন স্থাপনের জায়গা অধিগ্রহণ করা আছে। চাহিদা অনুযায়ী যে কোনো সময় এটি ডাবল লাইন করা হবে। তখন সিঙ্গেল লাইন দিয়েও ঢাকা থেকে কক্সবাজার ট্রেনে ৮ ঘন্টায় যাতায়াত করা সম্ভব হবে।
এমএসপি