‘পানামা’ রোগ আতঙ্কে লোকসানের মুখে কলা চাষিরা
টাঙ্গাইলে ‘পানামা’ রোগ আতঙ্কে সম্ভাবনাময় ফসল কলা চাষে আগ্রহ হারাচ্ছে চাষিরা। স্থানীয় কলা চাষিদের কাছে পানামা রোগ একটি ‘অজ্ঞাত ভাইরাস’। এ রোগে আক্রান্ত হলে প্রথমে কলা গাছের পাতা হলুদ হয়। পরে ধীরে ধীরে গাছটি নিস্তেজ হয়ে মারা যায়।
এ অজ্ঞাত ভাইরাসটি বর্তমানে ভয়াবহ আকার ধারণ করছে। প্রথমে ২-৪টি কলা গাছ এ রোগে আক্রান্ত হলেও দ্রুত পুরো বাগানে ছড়িয়ে পড়ছে। গত কয়েক বছরে পানামা আক্রান্তের হার সহনীয় পর্যায়ে থাকলেও দুই বছর ধরে এটা মারাত্মক আকার ধারণ করেছে। ফলে চাষিদের মধ্যে কলা চাষে অনাগ্রহ বাড়ছে। এমন পরিস্থিতিতে কলা চাষে এক প্রকার বিপর্যয় দেখা দিয়েছে।
জানা গেছে, লাল-ধুসর মাটি কলা চাষের জন্য বেশ উপযোগী। মাটির উর্বরতার পাশাপাশি অনুকূল আবহাওয়া কলার উৎপাদন আরও বাড়িয়ে তোলে। জেলার মধুপুর গড়াঞ্চলের মধুপুর, ঘাটাইল, সখীপুর, মির্জাপুর উপজেলার অধিকাংশ কৃষক আনারসের সাথী ফসল হিসেবে কলা চাষ ছিল নিয়মিত অনুষঙ্গ। বাজারে কলার চাহিদা থাকায় কেউ কেউ আনারস বাগানের পাশে বিভিন্ন জাতের কলার চাষ শুরু করেন। কম খরচ ও স্বল্প শ্রমের কলা চাষে লাভের মুখ দেখেন কলা চাষীরা।
আরও জানা গেছে, মধুপুর অঞ্চলে দীর্ঘদিন ধরে আনারসের পাশাপাশি কলা চাষ করছিল স্থানীয় আদিবাসীরাও। এতে অনেকে স্বাবলম্বী হয়েছেন। কলা গাছের পরিত্যক্ত অংশ স্থানীয় কারখানায় প্রসেস করে সুতা ও শো-পিচ তৈরি করা হচ্ছে। হঠাৎ অজ্ঞাত ভাইরাসের (পানামা) আক্রমণে অপার সম্ভাবনাময় কলা চাষে স্থানীয় কৃষকদের মাঝে অনাগ্রহ সৃষ্টি করেছে।
স্থানীয় কলা চাষিদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, প্রতি বিঘা জমিতে ৩৫০ থেকে ৩৮০টি কলা গাছ রোপন করা হয়। একটি কলা গাছে রোপন থেকে বাজারজাত পর্যন্ত ১২০ থেকে ১৯০ টাকা খরচ হয়। প্রতিটি কলার ছড়ি ৩২০ থেকে ৪৩০ টাকায় বিক্রি করা যায়। এ হিসেবে প্রতি বিঘায় প্রায় ৫০ হাজার টাকা কৃষকের লাভ হয়।
বারিকলা-১ ও বারিকলা-২ (আনাজিকলা), অমৃত সাগর, মন্দিরা, মন্দিরা সাগর, সবরি, চম্পা, চিনিচাম্পা, কবরি, মেহের সাগর, বীচি কলা ইত্যাদি জাতের কলা চাষ হয়ে থাকে। পূর্বে স্থানীয় চাহিদা মিটিয়ে দেশের অন্য জেলাগুলোতে বিভিন্ন জাতের কলা রপ্তানি করা যেত। কিন্তু পানামা রোগের কারণে বর্তমানে কলা চাষে ক্রমশ অনাগ্রহ দেখাচ্ছে চাষিরা। কৃষি বিভাগের মতে, গত বছর শুধুমাত্র মধুপুর উপজেলায় ১০ হাজার একর জমিতে কলা চাষ হলেও এবার মাত্র ৭ হাজার একর জমিতে কলা চাষ করা হয়েছে।
সরেজমিনে মধুপুর উপজেলার কলাচাষী শোলাকুড়ির ধরংপাড় গ্রামের শামীম মিয়া, নায়েব আলী, হরিণধরার আ. রশিদ, সোহাগ হোসেন, ফকিরাকুড়ির আনোয়ার হোসেন আনু, নওগাইলের খোকন মিয়া, লটপাড়ার শফিকুল ইসলাম, হাগুরাকুড়ির আনোয়ার হোসেন আলম, চাঁনপুর গ্রামের আবুল কালামসহ অনেকেই জানান, তাদের প্রধান ফসল আনারস। সাথী ফসল হিসেবে তারা কলা চাষ শুরু করেন। কয়েক বছর ভালো ফলন পেলেও গত ২-৩ বছর ধরে কলা গাছে অজ্ঞাত ভাইরাস(পানামা) দেখা দেওয়ায় লোকসান গুনতে হচ্ছে। তাই আগের চেয়ে কলা চাষ কম করছেন।
তারা বলেন, মধুপুর বনাঞ্চলের জমিতে চাষাবাদ করেন বিধায় তারা ব্যাংক ঋণও পান না। ৬-৭ বছর আগে কলা চাষে লাভ হলেও ক্রমান্বয়ে লোকসান হওয়ায় অনেকে পুঁজি হারিয়ে এনজিও থেকে ঋণ নিয়ে কলাচাষ করে ফের লোকসান গুনেছেন। পানামা রোগে একবার আক্রান্ত হলে ধীরে ধীরে পুরো বাগান নষ্ট হয়ে যায়। তারা স্বল্প পরিসরে কলা চাষ করে কোনও রকমে কলার আবাদ ধরে রেখেছেন। অনেকে বার বার লোকসান দিয়ে আবাদ বন্ধ করে দিয়েছেন।
কৃষকরা বলেন, কৃষি বিভাগ পানামা রোগ প্রতিরোধে প্রাকৃতিক ছাই প্রয়োগের পরামর্শ দিয়ে থাকে। এ ছাড়াও
ছত্রাকনাশক ফুরাডন-৫জি প্রতি গাছে ৫ গ্রাম হারে (প্রতি একরে ১.৫ কেজি) প্রয়োগের পরামর্শ দেন। কিন্তু তাতেও ওই অজ্ঞাত ভাইরাস (পানামা) পুরোপুরি দমন হয় না। বাধ্য হয়ে তারা কলা চাষ থেকে মুখ ফিরিয়ে নিচ্ছেন।
এ বছর কলা গাছের পাতা মরে যাওয়া ও গাছ পচে যাওয়ার রোগ ভয়াবহ আকার ধারণ করছে। এ জন্য পানামা ভাইরাস প্রতিরোধে কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণের মাধ্যমে কলা চাষে বিপর্যয় রোধ করতে কৃষি বিভাগের হস্তক্ষেপ প্রত্যাশা করেছেন তারা ।
কৃষি বিভাগ সূত্র জানায়, আগের ফসলে রোগ থাকলে বা রোগাক্রান্ত গাছ থেকে চারা সংগ্রহ করলে পরের বছর আবার পানামা রোগ হওয়ার সম্ভাবনা থাকে। চারা রোপণের সময় বয়স কম হলে, নিম্নমানের নিস্কাশিত মাটি এবং অধিক আগাছা ও ঘাস ইত্যাদি থাকলে পানামা রোগ হয়ে থাকে। পানামা আক্রান্ত কলা গাছের পুরনো পাতায় হলুদ বর্ণের দাগ দেখা যায়।
এ ছাড়া পুরনো পাতা ক্রমান্বয়ে হলুদ হয়ে যায়, পাতার কিনারা ও বোঁটা ফেটে যায়, লিফব্লেট (মাইজ পাতা) ঝুলে পড়ে শুকিয়ে যায়। কলাগাছের গোড়ার দিকে লম্বালম্বি ভাবে ফেটে যায়। আক্রান্ত গাছ থেকে অস্বাভাবিক থোড় বের হয়। এ ছাড়াও গাছটির রাইজোমের (কান্ড) ভেতর কালচে রঙ দেখা দেয়।
সূত্র মতে, চুন প্রয়োগ করে মাটির জৈব শক্তি বৃদ্ধি করা হলে পানামা রোগ থেকে কলাগাছকে মুক্ত রাখা যেতে পারে।
মধুপুর কলা চাষী সমিতির সভাপতি আব্দুর রহিম ও সাধারণ সম্পাদক মোখলেছুর রহমান মিণ্টু জানান, তাদের সংগঠনের সদস্যদের লাখ লাখ টাকা লোকসান হচ্ছে। বিভিন্ন এনজিও থেকে নেওয়া ঋণ কলা চাষিরা পরিশোধ করতে হিমশিম খাচ্ছে। লোকসানের মুখে পড়ে পুঁজির অভাবে অনেকে এ বছর কলা চাষ করেননি। কলা চাষে লোকাসানের কারণে ওইসব জমিতে এবার অন্য ফসল আবাদ করা হয়েছে।
তারা আরও জানান, কৃষি বিভাগের পরামর্শ ও প্রচেষ্টা তাদের কোনও কাজে আসেনি। এ অঞ্চলের কৃষকদের ৫-৭ কোটি টাকা লোকসান হয়েছে। বাগানের পর বাগান পানামা রোগে বিনষ্ট হয়ে গেছে।
এ ব্যাপারে টাঙ্গাইল কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উপপরিচালক আহসানুল বাশার জানান, কৃষি বিভাগের কর্মীরা সরাসরি মাঠ পর্যায়ে গিয়ে কৃষকদের সমস্যা সমাধানে কাজ করছেন। মূলত একই জমিতে বার বার কলা চাষ করায় মাটির জৈব উপাদান কমে যাচ্ছে। ফলে ফসল উৎপাদনে মারাত্মক প্রভাব পড়ছে।
তিনি আরও জানান, অতিমাত্রায় কীটনাশক ব্যবহার, ভালো বীজ বা চারা সংগ্রহ না করা ও বীজ শোধন করে রোপন করায় চাষিরা ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন। কৃষি বিভাগ মাঠ পর্যায়ে কৃষকদের সঠিক পরামর্শ, জৈব সার ব্যবহার ও কলা চাষে ফুডব্যাগিং পদ্ধতিতে নিরাপদ খাদ্য উৎপাদনে কাজ করছে।
এসআইএইচ