বৌদ্ধ মহাতীর্থ লুম্বিনি
বৌদ্ধ ধর্মের প্রবর্তক সিদ্ধার্থ গৌতম বুদ্ধের জন্মস্থান নেপালের তীর্থভূমি লুম্বিনি। বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বীদের জন্য এক পরম পবিত্র মহাতীর্থ। এই স্থানেই শাক্য বংশের রাজা শুদ্ধোধনের স্ত্রী মহারাণী মায়াদেবী ৫৬৩ খ্রিস্টপূর্বাব্দে সিদ্ধার্থ গৌতমের জন্ম দিয়েছিলেন। যদিও গৌতম বুদ্ধের সঠিক জন্মস্থান নিয়ে পণ্ডিতদের মধ্যে কিছুটা মতভেদ রয়েছে। তবে সর্বসাধারণের কাছে গ্রহণযোগ্য মত হলো–নেপালের লুম্বিনিই গৌতম বুদ্ধের জন্মস্থান। শুধু জন্মগ্রহণই নয়, বোধি প্রাপ্তির পরও সিদ্ধার্থ বুদ্ধ লুম্বিনিতে এসেছিলেন।
১৯৯৭ সালে ইউনেস্কো লুম্বিনিকে বিশ্ব ঐতিহ্যবাহী স্থানের অন্তর্ভুক্ত করে। এখানে রয়েছে বেশকিছু মন্দির, মঠ ও অশোকস্মারক স্তম্ভ। এ ছাড়া একটি পবিত্র পুষ্করিণীও রয়েছে। নেপালের কপিলাবস্তু শহর থেকে ২৫ কিলোমিটার পূর্বে লুম্বিনি অবস্থিত। গৌতম বুদ্ধের সময়কালে কপিলাবস্তু ও দেবদহের মধ্যবর্তী স্থানে লুম্বিনী বন নামে একটি উপবন ও জনপদ ছিল। বৌদ্ধধর্মের ইতিহাসবাহী গ্রন্থ সুত্তা নিপোতায় বলা হয়, শাক্যদের একটি গ্রাম লুম্বিনিয়া জনপদে গৌতম বুদ্ধের জন্ম হয়। বৌদ্ধ পুরাণ অনুযায়ী, গৌতম বুদ্ধের মা মায়াদেবী শাক্য রাজধানী কপিলাবস্তু থেকে তার পৈতৃক বাসগৃহে যাচ্ছিলেন। যাত্রাপথে লুম্বিনি বনে একটি শালগাছের নিচে গৌতম বুদ্ধের জন্ম হয়। বুদ্ধের জন্মের আগে মায়াদেবী এখানে একটি দীঘিতে স্নান করেন। সিদ্ধার্থ গৌতমকেও জন্মের পর এই দীঘিতে স্নান করানো হয়। এই জলাশয়টি পবিত্র পুষ্করিণী হিসেবে খ্যাত।
এখানে রয়েছে মায়াদেবী মন্দির। এই মন্দিরের একটি স্থান চিহ্নিত করা রয়েছে। বলা হয়ে থাকে ওই স্থানেই গৌতম বুদ্ধের জন্ম হয়েছিল। রয়েছে বেশ কয়েকটি প্রাচীন মঠ ও মন্দির, একটি প্রাচীন পবিত্র বোধিবৃক্ষ। প্রাচীন ভারতের বিখ্যাত মৌর্য সম্রাট অশোক এই তীর্থভূমি পরিদর্শনে এসেছিলেন। সম্রাট অশোকের আগমনের স্মারক হিসেবে এখানে একটি অশোক স্তম্ভ স্থাপন করা হয়।
ষষ্ঠ শতকে বিখ্যাত চীনা সন্ন্যাসী ও পর্যটক ফা হিয়েন ভারতীয় উপমহাদেশের বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ স্থান পরিদর্শনের সময় কপিলাবস্তু ও লুম্বিনিতে আসেন। তিনি বিখ্যাত ভ্রমণকাহিনীতে সম্রাট অশোকের স্মারক স্তম্ভের বর্ণনা দেন এবং গৌতম বুদ্ধের জন্মস্থান হিসেবে লুম্বিনির উল্লেখ করেন।
১৮৯৬ সালে নেপালের তত্কালীন শাসক খাদগা সোমেশ্বর রানার উদ্যোগে নেপালী প্রত্নতত্ত্ববিদরা ফা হিয়েনের ভ্রমণকাহিনী, বৌদ্ধপুরাণ ও ইতিহাসগ্রন্থ সুত্ত নিপোতা, বৌদ্ধ ইতিহাস গ্রন্থ মহাবংশসহ অন্যান্য গ্রন্থ এবং বিভিন্ন প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শনের সাহায্যে অশোক স্তম্ভটি খুঁজে বের করেন। আর এর মাধ্যমেই গৌতম বুদ্ধের জন্ম স্থানটি নির্দেশ করা সম্ভব হয়।
বর্তমানে লুম্বিনিতে এক বিশাল এলাকা সংরক্ষিত করে রাখা হয়েছে। এখানে মঠ ও মন্দির ছাড়া কোনো দোকান, হোটেল ও রেস্টুরেন্ট নির্মাণ করে এলাকার ভাবগাম্ভীর্য ক্ষুণ্ণ করা নিষিদ্ধ। এই এলাকা পূর্ব ও পশ্চিম দুই ভাগে ভাগ করে রাখা হয়েছে। পূর্বদিকে রয়েছে থেরাভদিন বা স্থবিরবাদী বৌদ্ধদের মঠ। পশ্চিমদিকে রয়েছে মহাযান ও হীনযানপন্থী বৌদ্ধদের মঠ। প্রাচীন বেশ কয়েকটি মঠের ধ্বংসাবশেষও রয়েছে এখানে। বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বীদের কাছে পরম পবিত্র চারটি তীর্থ স্থানের মধ্যে লুম্বিনি হলো অন্যতম। অন্য তিনটি হলো–কুশিনগর, বুদ্ধগয়া এবং সারনাথ। বুদ্ধ লুম্বিনীতে জন্ম করেন, বুদ্ধগয়ায় বুদ্ধত্ব লাভ করেন, সারনাথে প্রথম ধর্মপ্রচার করেন এবং কুশীনগরে মহাপরিনির্বাণ লাভ করেন। বুদ্ধের চারটি মহৎ ঘটনা এ চারটি স্থানে সংঘটিত হয়েছিল। তাই এ চারটি স্থানকে ‘মহাতীর্থস্থান’ বলা হয়।
/এসএ/