বড়দিন : মিলনেই আনন্দ
সৃষ্টিকর্তার মহিমা ও ভালোবাসা প্রচারের জন্যই ঈশ্বরপুত্র যিশুখ্রিস্ট পরিত্রাণকর্তা হিসেবে এই ধরাধামে জন্মগ্রহণ করেছিলেন। সাধু যোহনের ভাষায়- ‘ঈশ্বর জগতকে এত ভালোবাসলেন যে, নিজের একমাত্র পুত্রকে দান করলেন’ (যোহন ৩ : ১৬)। আর যিশু মানবদেহ ধারণ করে মর্ত্যের সঙ্গে স্বর্গের এবং মানুষের সঙ্গে ঈশ্বরের ভালোবাসার অপূর্ব মিলন সাধন করলেন। ঈশ্বর যে আমাদের নিঃস্বার্থভাবে ভালোবাসেন, তিনি যে সবসময় আমাদের সঙ্গে আছেন এবং আমাদের সব সময় ক্ষমা করেন- সে সত্যটিই যিশু তার সমগ্র জীবন ও কর্ম দিয়ে আমাদের কাছে প্রচার করেছেন।
পৃথিবীতে মহান ঈশ্বরের অসংখ্য রহস্যলীলার মধ্যে অন্যতম হলো যিশুখ্রিস্টের জন্মের ঘটনা। খ্রিস্ট ধর্মাবলম্বীদের পবিত্র ধর্মগ্রন্থ বাইবেলের বর্ণনা অনুযায়ী অত্যাচারী শাসক হেরোদ রাজার শাসনাধীন জেরুজালেমের বেথেলহেমে মাতা মেরির গর্ভে জন্মগ্রহণ করেন যিশুখ্রিষ্ট। মাতা মেরি ছিলেন ইসরায়েলের নাজারেথবাসী যোসেফের বাগদত্তা। সৎ, ধর্মপ্রাণ ও সাধু এই মানুষটি পেশায় ছিলেন কাঠমিস্ত্রি। একদিন স্বর্গদূতের কাছ থেকে মেরি জানতে পারেন, মানুষকে মুক্তির পথ দেখাতে তাঁর গর্ভে ঈশ্বরের পুত্র আসছেন। স্বর্গদূতের এ কথা শুনে দারুণভাবে বিচলিত হন মেরি। তিনি তাঁকে বলেন, ‘এটি কিভাবে সম্ভব! আমার তো বিয়ে হয়নি।’ স্বর্গদূত মেরিকে বলেন, ‘পবিত্র আত্মা তাঁর ওপর অধিষ্ঠিত হবেন এবং তার প্রভাবেই মেরি গর্ভবতী হবেন এবং তাঁর ছেলে হবে। বাইবেলের মথি লিখিত সুসমাচার থেকে জানা যায়, ‘পবিত্র আত্মা থেকে মরিয়ম গর্ভবতী হয়েছিলেন।’ (মথি, ১:২০)।
অন্যদিকে মেরির বাগদত্তা স্বামী যোসেফ যখন জানতে পারেন মেরি সন্তানসম্ভবা, তখন তাঁকে আর বিয়ে না করার সিদ্ধান্ত নেন। কিন্তু ঈশ্বরের দূত তাঁকে স্বপ্নে দেখা দিয়ে বলেন, ‘মেরি গর্ভবতী হয়েছে পবিত্র আত্মার প্রভাবে এবং তাঁর যে সন্তান হবে তা ঈশ্বরের পরিকল্পনায়। যোসেফ যেন মেরিকে সন্দেহ না করে গ্রহণ করে।’ তখন যোসেফ দূতের কথামতো মেরিকে বিয়ে করেন। তবে সন্তান না হওয়া পর্যন্ত তাঁকে স্পর্শ করা থেকে বিরত থাকেন। (মথি ১:২৫)।
মেরির সন্তান প্রসবের সময় ঘনিয়ে আসে। সে সময় রোমান সম্রাট অগাস্টাস সিজার আদমশুমারি করেন। তিনি নির্দেশ দেন যার যার পিতৃপুরুষের শহরে গিয়ে নাম লিপিবদ্ধ করতে হবে। যোসেফের পিতৃপুরুষরা ছিলেন যিহুদিয়ার বেথেলহেমের অধিবাসী। তাই যোসেফ তাঁর সন্তানসম্ভবা স্ত্রী মেরিকে নিয়ে নাম লেখাতে সেখানে যান। কিন্তু নাম লেখাতে প্রচুর লোক আসায় তাঁরা থাকার জন্য কোনো জায়গা পেলেন না। পরে একজন লোক তাঁদের গোয়ালঘরে থাকতে দিলেন। সেখানেই মেরি সন্তান প্রসব করেন এবং কাপড়ে জড়িয়ে যাবপাত্রে (যে পাত্রে পশুদের ঘাস, খড় বা পানি খেতে দেওয়া হয়) রাখলেন। স্বর্গদূতের কথামতো যোসেফ শিশুটির নাম রাখলেন যিশু। এভাবে এক অলৌকিক ঘটনার মধ্য দিয়ে বিশ্বজগতে মানব দেহ ধারণ করলেন ঈশ্বরপুত্র যিশু।
যিশু ছিলেন ঈশ্বরের পুত্র। তাঁর অপর একটি নাম হলো ‘ইম্মানুয়েল’, যার অর্থ, ‘ঈশ্বর আমাদের সঙ্গে’। ঈশ্বরপুত্র হয়েও যিশু নিজে যন্ত্রণাময় ক্রশীয় মৃত্যু ধারণ করে সমগ্র মানবজাতিকে মুক্তির আলোয় উদ্ভাসিত করেছেন। পৃথিবীতে এই মুক্তিদাতার আর্বিভাব ঘটেছিল শান্তি, একতা, মিলন ও ভালোবাসার রাজ্য প্রতিষ্ঠা করতে। তাই এই মহান পরিত্রাণকর্তার জন্মক্ষণ তথা বড়দিন উপলক্ষে সমগ্র বিশ্বের খ্রিস্টবিশ্বাসীরা মুক্তি আর মিলনের আনন্দে মেতে ওঠে।
অনেক সময় আমরা আনন্দ ও সুখ শব্দ দুটিকে একই অর্থে ব্যবহার করি। কিন্তু আধ্যাত্মিক অর্থে আনন্দ শব্দটি একটি বিশেষ তাৎপর্য বহন করে। কারণ সুখের সঙ্গে জাগতিক অর্থ-সম্পদের বিষয়টি জড়িত থাকে। অর্থাৎ জাগতিক অর্থ-সম্পদ দিয়ে আমরা সুখের মাপকাঠি নির্ধারণ করি। কিন্তু আনন্দ শব্দটি একেবারেই ঐশ্বরিক। আমরা যখন ঈশ্বরের সান্নিধ্য লাভ করি, তার নিঃস্বার্থ ভালোবাসা উপলব্ধি করি তখন আনন্দিত হই। আর যিশুখ্রিস্ট বিশ্বের ধনী-দরিদ্র নির্বিশেষে সকল মানুষের মধ্যে এই আনন্দের বার্তা নিয়ে এসেছিলেন। তিনি আমাদের ঈশ্বরের সান্নিধ্য লাভের পথ প্রদর্শন করেছেন, ঈশ্বরের ভালোবাসা আমাদের কাছে প্রকাশ করেছেন। এজন্য বড়দিনে আমরা ঈশ্বরের সঙ্গে একাত্ম হওয়ার আশায় আনন্দে মেতে উঠি।
বড়দিন আমাদের প্রেমের শিক্ষা দেয়। যোহন ৩:১৬ পদের আলোকে- মানুষের কোনো ধর্ম কর্মের ফল নয়, প্রার্থনার বা কোনো যাচঞার ফল নয়। ঈশ্বর স্ব-ইচ্ছায় আমাদের পরিত্রাণের জন্য নিজ প্রিয়পুত্রকে দান করলেন। মানুষের উচিত ঈশ্বরের প্রেমের প্রতি সাড়া দেওয়া। প্রকৃত প্রেম স্বর্গ থেকে আসে (১ করিন্থীয় ১৩ অধ্যায়)। ঈশ্বর আমাদের কাছে যিশুখ্রিস্টকে উপহার হিসেবে পাঠিয়েছেন। তাই বড়দিনের মধ্য দিয়ে আমরা একে অন্যের জীবনে উপহার হয়ে উঠি। একে অন্যের শান্তির কারণ হয়ে উঠি।
বড়দিন আমাদের শান্তি ও আনন্দ দান করে। ইলিশাবেৎ যখন মরিয়মের কাছ থেকে যীশুর আগমন বার্তা শুনেছিলেন তখন যোহন বাপ্তাইজ আনন্দে নেচে উঠেছিল। শিমিয়ন যিরুজালেম মন্দিরে শিশু যীশুকে কোলে তুলে নিয়ে আনন্দে বলে উঠেছিল, `আমার নয়ন যুগল পরিত্রাণ দেখিতে পাইল' (লূক ২:১০)। তাই যখন আমরা পাপের জীবন ত্যাগ করে খ্রিস্টকে মুক্তিদাতা ও পরিত্রাণকর্তা বলে গ্রহণ করি তখনই আমরা পরিত্রাণের আনন্দ উপলদ্ধি করি।
বড়দিন আমাদের পরিত্রাণের নিশ্চয়তা দেয়। প্রেরিত ৪:১২পদে- ‘আকাশের নিচে, মনুষ্যদের মাঝে আর কোনো নাম নাই, যে নামে পরিত্রাণ পাইতে পারি।’ কিন্তু মানুষ যখন পাপের সাগরে হাবুডুবু খাচ্ছিল, মুক্তি লাভের সকল পথ যখন রুদ্ধ হয়ে গিয়েছিল তখন যীশুর জন্মের মধ্য দিয়ে মানুষ পরিত্রাণের পথ খুঁজে পেল। যীশু আমাদের পাপের শাস্তি নিজের স্কন্ধে নিয়ে ক্রুশীয় মৃত্যুকে বরণ করলেন। কবর প্রাপ্ত হলেন, ৩ দিন পরে মৃত্যুকে জয় করে কবর থেকে পুনরুত্থিত হয়ে প্রায়শ্চিত্ত সাধনের মধ্য দিয়ে আমাদের জন্য পরিত্রাণের সুযোগ করে দিলেন। যেন আমরা পাপ থেকে পরিত্রাণ লাভ করি। যোহন ১:২৯ পদে, ‘ঐ দেখ, ঈশ্বরের মেষ শাবক, যিনি জগতের পাপভার লইয়া যান।’ এ জগতে অনেক ধর্ম প্রবর্তক, অনেক ভাববাদী কিংবা মহাপুরুষ এসেছেন যারা মানুষের নিকট মুক্তির বাণী প্রচার করেছেন, কিন্তু কেউ বলতে পারেনি আমার কাছে এস, আমি তোমাদের মুক্তি দেব, পাপ সকল ক্ষমা করে পরিত্রাণ দেব। কেবল প্রভু যীশুই মানুষের পাপ ক্ষমা করেছেন এবং পরিত্রাণ দিতে চেয়েছেন। তাই আমরা বড়দিনে পরিত্রাণের আশায় আনন্দে মেতে উঠি।
বড়দিন আমাদের বিশ্ব ভ্রাতৃত্বের শিক্ষা দেয়। যারা যিশুর ভালোবাসার আহ্বানে সাড়া দিয়ে ঈশ্বরের ভালোবাসায় সিক্ত হন তারা পরস্পরের সঙ্গে আবদ্ধ হন, পরস্পর পরস্পরের ভাইবোন হয়ে ওঠেন। কেননা ঈশ্বর হলেন আমাদের সৃষ্টিকর্তা, তিনি আমাদের পিতাস্বরূপ। যখন আমরা ঈশ্বরকে পিতা বলে সম্বোধন করি তখন সমগ্র বিশ্ব একটা মানব পরিবার হয়ে ওঠে। আর আমরা সেই পরিবারে একে অপরের ভাইবোন হয়ে উঠি। বিশ্বব্যাপী এই করোনাকালীন সময়ে আমরা আমাদের অনেক নিকট আত্মীকে হারিয়েছি। অনেকে চাকরি হারিয়েছে। অর্থনৈতিক, সামাজিক ও মানসিকভাবে বিপর্যস্ত হয়ে পড়েছে। এই অবস্থায় যিশুর শিক্ষাকে হৃদয়ে ধারণ করে আমরা যদি সে সকল মানুষের পাশে দাড়াতে পারি, মানুষকে মানুষ হিসেবে ভালোবাসতে পারি, অন্তরের সাথে অন্তরের মিলন স্থাপন করতে পারি তবেই বড়দিনের আনন্দ সার্থক হবে।
লেখক : অধ্যক্ষ, নটর ডেম কলেজ, ঢাকা
/এএন