সনাতন ধর্মে পবিত্র মনে করা হয় যেসব গাছ
ছবি- সংগৃহীত
মানুষের প্রাণ ধারণের অমূল্য উপাদান অক্সিজেন। আর অক্সিজেনের আধার গাছ। একই সঙ্গে কার্বন-ডাই অক্সাইড শোষণ করে পরিবেশের ভারসাম্যও ঠিক রাখে গাছ। জীব-বৈচিত্র্য রক্ষা, পরিবেশের ভারসাম্য রক্ষা এবং বৈশ্বিক জলবায়ু পরিবর্তনের ক্ষতিকর প্রভাব থেকে রক্ষা পেতে হলে গাছ লাগানোর কোনো বিকল্প নেই।
শুধু পরিবেশ নয়, ধর্মীয় আচার-অনুষ্ঠানেও রয়েছে গাছের প্রয়োজনীয়তা। বিশেষ করে সনাতন ধর্মে গাছপূজার প্রচলন রয়েছে। শাস্ত্র মতে, যে ব্যক্তি একটি অশ্বত্থ, একটি নিম, ১০টি তেঁতুল, তিনটি কৈথ, তিনটি বেল, তিনটি আমলকি ও পাঁচটি আম গাছ লাগান, তিনি পুণ্যাত্মা। সনাতন ধর্মে পূজনীয় গাছগুলো হলো-
অশ্বত্থ
সনাতন ধর্মে অশ্বত্থ অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ একটি গাছ। এ গাছের গোড়া থেকে শুরু করে পাতা পর্যন্ত দেবদেবীর বাস। গীতাতে, শ্রীকৃষ্ণ বলেছেন, "হে পার্থ, গাছের মধ্যে আমি অশ্বত্থ।" এর প্রতিটি উপাদান যেমন বাকল, পাতা, ফল, বীজ ও শিকড় সবই খুব কার্যকর। প্রায় প্রতিটি হনুমান ও শনি মন্দিরে এই গাছ দেখা যায়। নিজের ও পরিবারের এবং ভবিষ্যৎ প্রজন্মের মঙ্গল কামনায় সপ্তাহের প্রতি শনিবারে এই গাছকে পূজা করা হয়। আবার বিভিন্ন ছোঁয়াচে রোগ ও শত্রুদের হাত থেকে বাঁচতে এ গাছের উপাসনা করা হয়। একে বোধি গাছও (Bodhi Tree) বলা হয়। এই গাছের তলায় বৌদ্ধ ধর্মের প্রতিষ্ঠাতা গৌতম বুদ্ধ ধ্যান করেছিলেন এবং জ্ঞান অর্জন করেছিলেন।
তুলসি গাছ
হিন্দুদের অধিকাংশ ধর্মীয় অনুষ্ঠানে তুলসী পাতা ও গাছ ব্যবহার করা হয়। এই গাছ যদি বাড়ির উঠানে জন্মায়, তবে তা শুভ বলে মনে করা হয়। কারণ,হিন্দু ধর্মে বলা হয়েছে, কৃষ্ণের সেবা করার জন্য বৃন্দাবনে দেবী বিরিন্দা তুলসী পাতা হিসেবে জন্ম নেন। আবার প্রাচীন বেদে উল্লেখ করা হয়েছে যে, তুলসী গাছের কাঠের স্পর্শ একজন ব্যক্তিকে শুদ্ধ করে তুলতে পারে। দেহ, মন ও আবেগকে শুদ্ধ করতে তুলসী পুঁতি দিয়ে তৈরি মালা গলায় পরা প্রয়োজন। এ গাছ ঔষধি ও রোগ নিরাময় বৈশিষ্ট্যের জন্য আয়ুর্বেদেও মূল্যবান।
কলা গাছ
কলা গাছের ফলকে ভগবান বিষ্ণু ও লক্ষ্মীর উদ্দেশে উৎসর্গ করা অত্যন্ত শুভ বলে মনে করা হয়। আবার কলা গাছের পাতা গণেশকে অর্পণ করলে তাও শুভ বলে বিবেচিত হয়। এ গাছের পাতাগুলি বিভিন্ন ধর্মীয় ও আনুষ্ঠানিক প্যান্ডেলগুলি সাজাতে ব্যবহৃত হয়। এ ছাড়া এগুলি খাবার ও প্রসাদ পরিবেশন করতে ব্যবহৃত হয়। বিশেষ করে সপ্তাহের প্রতি বৃহস্পতিবার ধূপ-ধূনো, ফল, ফুল, হলুদ ইত্যাদি দিয়ে এই গাছের উপাসনা করলে পরিবারে সমৃদ্ধি বাড়ে বলে বিশ্বাস করা হয়।
পদ্ম
সনাতন ধর্মে প্রচলিত, প্রত্যেক মানুষের অভ্যন্তরে পদ্মের পবিত্র আত্মা বিদ্যমান। কারণ ধর্মীয় শাস্ত্র অনুযায়ী, ভগবান বিষ্ণুর নাভির ভেতর থেকে জন্ম নেয় পদ্ম, আর ব্রহ্মা পদ্মের কেন্দ্রে বসে থাকেন। তাই সনাতন ধর্মাবলম্বীদের কাছে ফুলটি জীবন, উর্বরতা আর পবিত্রতার প্রতীক। বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বীরাও পদ্ম ফুলকে পবিত্র মনে করে।
বট গাছ
বটগাছকে বলা হয় ভক্তদের জন্যে ঈশ্বরের দেওয়া আশ্রয়স্থল। বহু প্রাচীন ভারতীয় গ্রন্থ ও শাস্ত্রে উল্লেখ করা হয়েছে যে, বটগাছ ঐশ্বরিক স্রষ্টাকে উপস্থাপন করে এবং মানব জীবনের দীর্ঘায়ু কামনার প্রতীক হিসেবে পূজিত হয়। গাছটি 'বট বৃক্ষ' নামেও পরিচিত। এই গাছ উর্বরতার প্রতীক তাই অনেকে বিশ্বাস করেন, এই গাছের পূজা করলে গর্ভধারণের ক্ষেত্রে নিঃসন্তান দম্পতির সহায়তা হতে পারে। বট গাছ কেটে ফেলা অশুভ বলে মনে করা হয়।
বেল গাছ
সনাতন ধর্মে বেল গাছের সঙ্গে শিব ওতোপ্রতোভাবে জড়িত। বিশ্বাস করা হয়, এর পাতা ও ফল দিয়ে পূজা করলে দেবাদিদেব সন্তুষ্ট হন। বেল গাছের ত্রিনেত্র বিশিষ্ট পাতা অত্যন্ত শুভ বলে মনে করা হয়। তিন ভগবান - ব্রহ্মা, বিষ্ণু ও মহেশ্বর বা শিব যথাক্রমে সৃষ্টি, সংরক্ষণ ও ধ্বংসের প্রতীক। এই পাতাগুলি শিবের তিনটি চোখ হিসেবেও বিবেচিত হয়। এছাড়া, এ গাছের সমস্ত অংশে ঔষধি গুণ রয়েছে। এটি আয়ুর্বেদিক ওষুধ তৈরিতে বেশি ব্যবহৃত হয়।
অশোক গাছ
একটি মাঝারি আকৃতির চিরসবুজ ছায়াদানকারী বৃক্ষ। সুন্দর, সুগন্ধযুক্ত লাল ও হলুদ ফুল ধারণ করে গাছটি। এটিও সনাতন ধর্মে একটি পবিত্র গাছ হিসেবে বিবেচিত হয়। শুধু সনাতন ধর্ম নয়, বৌদ্ধ ও জৈন ধর্মেও এটিকে পবিত্র গাছ হিসেবে মানা হয়। এ গাছের সমস্ত অংশে ঔষধি গুণ রয়েছে। যেমন - স্নায়ুগত রোগ, অর্শ্ব, চর্ম রোগ ইত্যাদিতে খুবই উপকারী।
চন্দন গাছ
চন্দন গাছ সবচেয়ে পবিত্র গাছ হিসেবে বিবেচিত হয় সনাতন ধর্মে। ভারতবর্ষে সমস্ত পূজা অনুষ্ঠানে এটি ব্যবহৃত হয়। তবে চন্দন গাছ সেই অর্থে ব্যবহৃত না হলেও মূলত এর কাঠ ব্যবহৃত হয়, যা অত্যন্ত সুগন্ধযুক্ত। চন্দন কাঠ গুঁড়ো করে পূজায় ব্যবহার করা হয়। ভক্তদের কপাল তিলক কাটতেও ব্যবহৃত হয়; যা ধর্মীয় তাৎপর্য বহন করে।
নিম গাছ
শাস্ত্রে নিম গাছকে বিশেষ গুরুত্ব দেওয়া হয়। নিমের কাঠ থেকে শুরু করে পাতা- সব কিছুরই নিজস্ব গুরুত্ব রয়েছে। আবার দক্ষিণ দিককে মঙ্গলের দিক মনে করা হয়। নিম গাছ মঙ্গলের পরিস্থিতি নির্ধারণ করে। মঙ্গল শুভ প্রভাব দেবে না কি, অশুভ প্রভাব বিস্তার করবে, তা নিম গাছের পরিস্থিতি দেখে জানা যায়। দক্ষিণ দিকে নিমের বড় গাছ থাকা উচিত। দক্ষিণমুখী বাড়ির প্রবেশদ্বারের দ্বিগুণ দূরত্বে নিমের সবুজ গাছ থাকলে বা দ্বিগুণ বড় বাড়ি থাকলে দক্ষিণ দিকের প্রভাব কমে যায়।
আমলকি
আমলকি স্বাস্থ্যের পক্ষে অত্যন্ত উপকারী। আবার একাদশী তিথিতে আমলকির পূজা করলে বিষ্ণুর আশীর্বাদ লাভ করা যায়। আমলকি নবমীর দিনে এ গাছের পূজা বিশেষ ফলদায়ী।
শমি
এ গাছের পূজা করলে শনির আশীর্বাদ পাবেন। প্রতি শনিবার শমি গাছের তলায় সরষের তেলের প্রদীপ জ্বালালে শনি প্রসন্ন হন এবং জীবনের সমস্ত কষ্ট দূর হয়। এর প্রভাবে সুখ-সমৃদ্ধি বজায় থাকে। এ ছাড়া শমির পাতা শিবকে অর্পণ করলে তিনি প্রসন্ন হন।
আম
আবার সনাতন ধর্মে কোনো মঙ্গল অনুষ্ঠানে আম পাতার ব্যবহার লক্ষ করা যায়। লক্ষ্মী পূজায় আমপাতার ব্যবহার করা হয়। আবার বিবাহ বা অন্য কোনো মঙ্গল অনুষ্ঠানে দরজা আমপাতা দিয়ে সাজানো হয়। এমনকি নিয়ম-আচারের আমপল্লবের ব্যবহার লক্ষ করা যায়। শাস্ত্র অনুযায়ী, ৫ অথবা তার চেয়ে বেশি আম গাছ রোপণ এবং তার যত্ন করলে দুর্লভ যজ্ঞের ফল লাভ করা যায়।
এমএস/এসএন