ঘূর্ণিঝড় আক্রান্তদের পাশে দাঁড়ানো ইবাদত
ঘূর্ণিঝড় ‘অশনি’ সরাসরি বাংলাদেশে আঘাত করেনি, করেছে ভারতের ওড়িশায়। তবে বাংলাদেশে এর যা প্রভাব পড়েছে, এতেই দুর্বিষহ হয়ে উঠেছে উপকূলের বহু মানুষের জীবন। ঘূর্ণিঝড়ের দাপটে নদীর পানি বেড়ে প্লাবিত হয়েছে উপকূল। এর আগে সিডর, আইলা, আম্ফান ও ইয়াস উপকূলে ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি করে।
ঘূর্ণিঝড়, বন্যা, অতিবৃষ্টি প্রভৃতি প্রাকৃতিক দুর্যোগে মানুষকে প্রায়ই পড়তে হয়। এসব প্রাকৃতিক দুর্যোগ প্রকৃতির নিজস্ব কোনো সৃষ্টি নয়। বরং জল-স্থল, চন্দ্র-সূর্য, আলো-বাতাস তথা প্রকৃতির প্রতিটি উপাদানে যা কিছু ঘটে, সেগুলো মহান আল্লাহর সূক্ষ্ম পরিকল্পনারই অংশ। দুর্যোগ-দুর্ঘটনাও তার ইচ্ছারই বহিঃপ্রকাশ। বিপর্যয়ের জন্য দায়ী মানুষের কৃতকর্ম। সমাজে অন্যায়-অনাচার বেড়ে গেলেই প্রাকৃতিক দুর্যোগের আশঙ্কা দেখা দেয়। তবে দুর্যোগ শুধু পাপের কারণেই হয়–তা নয়; এর মাধ্যমে কখনো কখনো মানুষকে পরীক্ষাও করা হয়। তাই যে কোনো দুর্যোগে ধৈর্য ধরতে বলা হয়েছে পবিত্র কোরআনে। কোরআনে বলা হয়েছে, ‘নিশ্চয়ই আমি (আল্লাহ) তোমাদের ভয়, ক্ষুধা এবং ধন-সম্পদ, জীবন ও ফল-ফসলের ক্ষয়ক্ষতি দ্বারা অবশ্যই পরীক্ষা করব। তুমি ধৈর্যশীলদের শুভ সংবাদ দাও, যারা তাদের ওপর বিপদ আপতিত হলে বলে, আমরা তো আল্লাহরই জন্য এবং নিশ্চিতভাবে তাঁর দিকেই প্রত্যাবর্তনকারী।’ (সুরা বাকারা: আয়াত ১৫৫-১৫৬)
প্রাকৃতিক দুর্যোগ-দুর্বিপাক অনেক সময় মানুষকে জীবনের কঠিন বাস্তবতার মুখোমুখি করে মহৎ প্রাণ ও ধর্মভীরু করে তোলে। যখনই কোনো বিপদ-আপদ পৃথিবীতে নেমে আসে, তখন মানুষ আল্লাহর ভয়ে ভীতসন্ত্রস্ত হয়ে আত্মবিশ্লেষণের সুযোগ পায়। আল্লাহ বিপদগ্রস্থদের নানাভাবে সাহায্য করে থাকেন। একই সঙ্গে সামর্থ্যবান মানুষদের আদেশ করেন–দুর্যোগগ্রস্ত মানুষের পাশে দাঁড়ানোর।
অতিবৃষ্টি, ঝড়, বন্যা প্রভৃতি প্রাকৃতিক বিপর্যয়ের মুহূর্তে অসহায় মানবতার পাশে দাঁড়ানো দলমত-নির্বিশেষে সব শ্রেণি-পেশার ধর্মপ্রাণ মানুষের অবশ্য কর্তব্য। এটি ইবাদতেরই অংশ। রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, ‘যে ব্যক্তি আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্য দুনিয়াতে মানুষকে খাদ্য দান করেছে, সেদিন তাকে খাদ্য দান করা হবে। যে আল্লাহকে খুশি করার জন্য মানুষকে পানি পান করিয়েছে, তাকে সেদিন পানি পান করিয়ে তার পিপাসা দূর করা হবে। যে মানুষকে বস্ত্র দান করেছে, তাকে সেদিন বস্ত্র পরিধান করিয়ে তার লজ্জা নিবারণ করা হবে।’ (আবু দাউদ)
রাসুলুল্লাহ (সা.) দিকনির্দেশনা প্রদান করে বলেছেন, ‘তোমরা ক্ষুধার্তকে খাদ্য দাও, অসুস্থ বা রুগ্ণ ব্যক্তির সেবা করো এবং বন্দিকে মুক্ত করো অথবা ঋণের দায়ে আবদ্ধ ব্যক্তিকে ঋণমুক্ত করো।’ (বুখারি)
‘মানুষের প্রয়োজনে মানুষ’ ইসলামের অন্যতম স্লোগান। প্রতিবেশীকে অভুক্ত রেখে পূর্ণ আহারকারীর ঈমানকে বলা হয়েছে ত্রুটিপূর্ণ ও অসম্পূর্ণ। মহানবী (সা.) ইরশাদ করেন, ‘ওই ব্যক্তি পরিপূর্ণ মুমিন নয়, যে তৃপ্তি সহকারে আহার করে অথচ তার প্রতিবেশী থাকে ক্ষুধার্ত। (শুয়াবুল ঈমান, হাদিস: ৫৬৬০)
রাসুল (সা.) একদিন আবু যরকে (রা.) বললেন, ‘হে আবু যর! তুমি যখন তরকারি পাকাও, তখন তাতে একটু বেশি পানি দিয়ে ঝোলটা বাড়িয়ে নিও এবং তোমার প্রতিবেশীকে তা পৌঁছে দিও।’ (মুসলিম, হাদিস: ৬৮৫৫)।
রাসুল (সা.) সব মুসলমানকে একটা দেহের সঙ্গে তুলনা করে বলেছেন, ‘পারস্পরিক ভালোবাসা, দয়া-মায়া ও স্নেহ-মমতার দিক থেকে গোটা মুসলিম সমাজ একটি দেহের সমতুল্য। যদি দেহের কোনো বিশেষ অঙ্গ অসুস্থ হয়ে পড়ে, তা হলে অন্যান্য অঙ্গ-প্রত্যঙ্গেও তা অনুভূত হয়; সেটা জাগ্রত অবস্থায়ই হোক কিংবা জ্বরাক্রান্ত অবস্থায়।’ (মুসলিম, হাদিস: ৬৭৫১)
যে ব্যক্তি শুধু প্রথাগত ইবাদত করেন; কিন্তু বিপদগ্রস্ত ও দুস্থ মানবতার কল্যাণের জন্য দান-খয়রাত, জাকাত-সদকা, ত্যাগ-তিতিক্ষা ও সাহায্য-সহযোগিতায় এগিয়ে আসেন না; তিনি আল্লাহ ও তাঁর রাসুলের কাছে কখনই প্রিয়ভাজন হতে পারবেন না। বৈধ সম্পদ থেকে দরিদ্র ব্যক্তিকে দানের সওয়াব সম্পর্কে নবী করিম (সা.) বলেছেন, ‘কেউ হালাল উপার্জন থেকে দান করলে আল্লাহ নিজে সেই দান গ্রহণ করেন, সেটি উত্তমরূপে সংরক্ষণ করেন। একসময় সেই দানের সওয়াব পাহাড়তুল্য হয়ে যায়।’ (বুখারি ও মুসলিম)
এসএ/