শাবান মাসের ফজিলত ও আমল
হিজরি চন্দ্র বর্ষের অষ্টম মাস হলো ‘শাবান’। এই মাসটি বিশেষ মর্যাদা ও ফজিলতপূর্ণ। হিজরতের প্রায় দেড় বছর পর এই মাসেই কিবলা পরিবর্তন হয়; অর্থাৎ পূর্ব কিবলা বাইতুল মুকাদ্দাস এর পরিবর্তে কাবা শরীফ কিবলা হিসেবে ঘোষিত ও নির্ধারিত হয় এই মাসে। “বারবার আপনার আকাশের দিকে মুখমণ্ডল আবর্তন আমি আমি অবশ্যই লক্ষ্য করি। সুতরাং এম কিবলার দিকে আপনাকে প্রবর্তন করে দেবো যাতে আপনি সন্তুষ্ট হন। অতএব আপনি মসজিদুল হারাম (কাবা শরীফ) এর দিকে চেহারা ঘুরান। তোমরা যেখানেই থাকো না কেন ঐ (কাবার) দিকেই মুখ ফিরাও।” (সূরা-২ বাকারা, আয়াত: ১৪৪)। তাই শাবান মাস একদিকে মুসলিম স্বাতন্ত্র ও ইসলামী ঐক্যের মাস, অন্যদিকে কাবা কেন্দ্রিক মুসলিম জাতীয় ঐক্য ও ভ্রাতৃত্ব বোধে উজ্জীবিত হওয়ার মাস।
প্রিয় নবী হযরত মুহাম্মাদ সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এর প্রতি দুরূদ পাঠের নির্দেশনা সম্বলিত অসাধারণ আয়াতটি এই মাসেই অবতীর্ণ হয়। “নিশ্চয়ই আল্লাহ তাআলা নবীজি সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের প্রতি পরিপূর্ণ রহমত বর্ষণ করেন, ফেরেশতাগণ নবীজি সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের জন্য রহমত কামনা করেন; হে মুমিনগণ! তোমরাও তাঁর প্রতি দুরূদ পাঠ করো এবং যথাযথভাবে সালাম পেশ করো।” (সূরা-৩৩ আহযাব, আয়াত: ৫৬)। সুতরাং শাবান মাস হলো নবীজির প্রতি অগাধ ভক্তি শ্রদ্ধ এবং প্রেম ভালোবাসা প্রদর্শনের মাস। তা হবে সুন্নাত অনুশীলনের মাধ্যমে। হজরত আনাস (রা.) বর্ণনা করেন, রসূলুল্লাহ সল্লাল্লাহ আলাইহি ওয়া সাল্লাম আমাকে বলেছেন: ‘হে বৎস! যদি পারো এভাবে সকাল ও সন্ধ্যা পার করো যেনো তোমার অন্তরে কারো প্রতি হিংসা না থাকে; তবে তাই করো।’ অতঃপর বললেন: ‘এটাই আমার সুন্নাত আদর্শ, যে ব্যক্তি আমার সুন্নাত অনুসরণ করলো, সে প্রকৃত পক্ষে আমাকে ভালোবাসলো; যে আমাকে ভালোবাসলো, সে জান্নাতে আমার সাথেই থাকবে।’ (মিশকাতুল মাসাবীহ, তিরমিযী শরীফ: ৩৬ঃ১৭৫)।
শাবান মাসটি অত্যন্ত তাৎপর্যপূর্ণ একটি মাস। আরবিতে এই মাসের পূর্ণ নাম হলো ‘আশ শাবানুল মুআযযম’ অর্থ মহান শাবান মাস। ‘শাবান’ শব্দের অর্থ দূরে ও কাছে, মিলন ও বিচ্ছেদ এবং সংশোধন বা সুশৃঙ্খলা, ফাসাদ বা বিশৃঙ্খলা। শাবান মানে দুটি শাখা বা সাদৃশ্যপূর্ণ ও বৈশাদৃশ্যপূর্ণ। বিপরীতধর্মী দুটি বৈশিষ্ট এর মাঝে বিদ্যমান রয়েছে। এ যেনো একই অঙ্গে দুটি রূপ।
যেমন, দুটি শাখা ভিন্ন হলেও একই কাণ্ড মূলে মিলিত; হাতের পঞ্চ অঙ্গুলী ভিন্ন ভিন্ন কিন্তু একই সাথে কাজ করে। অর্থাৎ ভিন্নতায়ও ঐক্যতা। শাবানের আরেকটি অর্থ হলো মধ্যবর্তী সুষ্ট। যেহেতু এই মাসটি রজব ও রমজানের মধ্যবর্তী তাই এই মাসকে শাবান মাস নামকরণ করা হয়। (লিসানুল আরব, ইবনে মানযূর রহ.)।
রসূলুল্লাহ সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এই মাসে সবচেয়ে বেশি নফল ইবাদাত, নফল রোজা পালন ও নফল নামাজ আদায় করতেন। রজব আল্লাহ তাআলার মাস, শাবান নবীজি সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের মাস; রমজান হলো উম্মতের মাস। রজব মাস হলো ইবাদাতের মাধ্যমে মনের ভূমি কর্ষণের জন্য, শাবান মাস হলো আরো বেশি ইবাদাতের মাধ্যমে মনের জমিতে বীজ বপনের জন্য; রমজান হলো সর্বাধিক ইবাদাত বন্দেগীর মাধ্যমে সফলতার ফসল তোলার জন্য।
রাসুলুল্লাহ সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম রজব ও শাবান মাস ব্যাপী এ দোয়াটি বেশি বেশি পড়তেন: ‘আল্লাহুম্মা বারিক লানা ফী রজব ওয়া শাবান, ওয়া বাল্লিগনা রমাদান’। অর্থ: ‘হে আল্লাহ! রজব মাস ও শাবান মাস আমাদের জন্য বরকতময় করুন; রমজান আমাদের নসীব করুন।’ (মুসনাদে আহমাদ ইবনে হাম্বল রহ., প্রথম খণ্ড: ২৫৯, বায়হাকী, শুআবুল ঈমান, ৩ঃ৩৭৫)।
এই শাবান মাসের চৌদ্দ তারিখ দিবাগত পনের তারিখের রাতকে ‘শবে বরাত’ বলা হয়। শবে বরাত কথাটি ফারসী। শব মানে রাত বা রজনী আর বারাত মানে মুক্তি সুতরাং শবে বরাত অর্থ হলো মুক্তির রাত। ‘শবে বরাত’ এর আরবী হলো ‘লাইলাতুল বারাআত’ তথা মক্তির রজনী। হাদীস শরীফে যাকে ‘নিসফ শাবান’ বা শাবান মাসের মধ্য দিবসের রজনী বলা হয়েছে। ভারতীয় উপমহাদেশ ও পারস্যসহ পৃথিবীর অনেক দেশের ফারসী উর্দূ বাংলা ও হিন্দীসহ নানা ভাষাভাষী মানুষের কাছে এটি ‘শবে বরাত’ নামেই সমধিক পরিচিত।
এ প্রসঙ্গে কুরআনুল কারীমে আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তাআলা বলেন: “শপথ! উজ্জল কিতাবের, নিশ্চয় আমি তা নাযিল করেছি এক বরকতময় রাতে; নিশ্চয় আমি ছিলাম সতর্ককারী। যাতে সকল গুরুত্বপূর্ণ বিষয় নির্ধারিত হয়। এ নির্দেশ আমার তরফ থেকে, নিশ্চয় আমিই দূত পাঠিয়ে থাকি। এ হলো আপনার প্রভুর দয়া, নিশ্চয় তিনি সব শোনেন ও সব জানেন। তিনি নভোমণ্ডল ভূমণ্ডল ও এ উভয়ের মাঝে যা আছে সে সবের রব। যদি তোমরা নিশ্চিত বিশ্বাস কর, তিনি ছাড়া কোন মাবুদ নেই, তিনি জীবন ও মৃত্যু দেন, তিনিই তোমাদের পরওয়ারদিগার আর তোমাদের পূর্ব পুরুষদেরও। তবুও তারা সংশয়ে রঙ্গ করে। তবে অপেক্ষা কর সে দিনের, যেদিন আকাশ সুষ্পষ্টভাবে ধূমধাচ্ছন্ন হবে।” (সূরা-৪৪ দুখান, আয়াত: ১-১০)। অনেক মুফাসসিরীন বলেন: এখানে ‘লাইলাতুম মুবারাকা’ বা বরকতময় রজনী বলে শাবান মাসের পূর্ণিমা রাতকেই বুঝানো হয়েছে। (তাফসীরে মাযহারী, রূহুল মাআনী ও রূহুল বায়ান)। প্রখ্যাত মুফাসসিরে কুরআন মুফতী মুহাম্মাদ শফী (র.) তাফসীর গ্রন্থ মাআরিফুল কুরআনে উল্লেখ করেছেন, ‘হজরত ইকরিমাহ (রা.) প্রমূখ কয়েকজন তাফসীরবিদ সাহাবী (রা.) থেকে বর্ণিত আছে, সূরা দুখান এর দ্বিতীয় আয়াতে বরকতের রাত্রি বলে শবে বরাত অর্থাৎ শাবান মাসের পনের তারিখের রাত্রিকে বোঝানো হয়েছে।’ (তাফসীরে মাআরিফুল কুরআন, সূরা দুখান, আয়াত: ২)।
শাবান মাস ইবাদাতের জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ সময়। নফল রোজা, নফল নামাজ, কুরআন তিলাওয়াত, দুরূদ শরীফ, জিকির আযকার, তাসবীহ তাহলীল, দোয়া কালাম, দান সদাকাহ খয়রাত, উমরাহ হজ ইত্যাদির মাধ্যমে এই মাসকে সার্থক ও সাফল্যময় করা যায়।
সাধারণত প্রতি সপ্তাহের সোমবার ও বৃহস্পতিবার রোজা রাখা সুন্নাত। প্রতি আরবি মাসের তেরো, চৌদ্দ ও পনেরো তারিখ আইয়ামে বীদে’র রোজা পালন করাও সুন্নাত। চান্দ্র মাসের পহেলা তারিখ, দশ তারিখ, বিশ তারিখ এবং ঊনত্রিশ ও ত্রিশ তারিখ রয়েছে নফল রোজা। এছাড়াও নফল ইবাদাতের জন্য কোনো সময় ও দিন তারিখ নির্ধারণ ছাড়া যতো বেশি সম্ভব তা করা যায় এবং করা উচিৎ। সাথে সাথে সযত্ম সতর্ক থাকতে হবে যেনো কোনো ফরজ ওয়াজিব ছুটে না যায়।
রমজানের পূর্ব প্রস্তুতি হিসেবে শাবান মাসের তারিখের হিসাব রাখা বিশেষ জরুরি সুন্নাত আমল। হাদীস শরীফে নবীজি সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেন: ‘তোমরা রমজানের জন্য শাবানের চাঁদের হিসাব রাখো।’ (সিলসিলাতুস সহীহাহ, আলবানী, খণ্ড: ২, পৃষ্ঠা: ১০৩)।
লেখক: প্রতিষ্ঠাতা-সভাপতি: শেখ ছাদী (র.) ফাউন্ডেশন বাংলাদেশ