মাতৃভাষার বিকৃতি রোধের অপরিহার্যতা
একুশ মানে মাথা নোয়াবার নয়, একুশ মানে এগিয়ে যাওয়ার প্রত্যয়। আমরা সেই একমাত্র জাতি, যারা রাষ্ট্রভাষা বাংলার দাবিতে উনিশ শ বায়ান্ন সালের একুশে ফেব্রুয়ারিতে প্রাণ দিয়েছি। প্রাণ দিয়েছে বাঙালি তরুণ ছাত্র-জনতা। বুকের তাজা রক্তে রঞ্জিত হয়েছিল ঢাকার রাজপথ। আমরা জাতি হিসেবে সাহসী আপোসহীন প্রতিবাদী। মাতৃভাষায় অধিকার প্রতিষ্ঠার জন্যে আমাদের অকাতরে জীবন বিলিয়ে দেওয়া পৃথিবীতে এক অনন্য দৃষ্টান্ত হয়ে আছে। সর্বোপরি বাঙালির এই মহান আত্মত্যাগকে গোটা বিশ্ব স্মরণ করে এ দিবস পালনের মাধ্যমে। সারা বিশ্বে একযোগে এক কণ্ঠে গেয়ে বেড়ায় একুশে ফেব্রুয়ারির গান। পৃথিবীর সকল প্রজন্ম জানবে বাঙালির ত্যাগ-তিতিক্ষার কথা, জানবে বাংলাদেশ নামক একটি স্বাধীন জাতিসত্তার কথা। এটি আমাদের গর্ব, বাংলা ভাষা ও বাঙালি জাতির গর্ব।
বাংলাদেশ আজ উন্নয়নশীল রাষ্ট্র। অর্থনৈতিক ভিত্তি দিন দিন নির্ভরযোগ্য হয়ে উঠছে। পেছনে ফিরে তাকানোর সুযোগ নেই মোটেও, আর উন্নতির এই সোপানে এগিয়ে যেতে অমর একুশ এবং রাষ্ট্রভাষা আন্দোলন প্রতি বছর আমাদের বিশেষভাবে উজ্জীবিত করে। কিন্তু পরিতাপের বিষয়, অমর একুশের আজ ৭০ বছর হলেও, রাষ্ট্রভাষা আন্দোলনের প্রধান স্লোগান ‘সর্বস্তরে বাংলা ভাষার প্রয়োগ হোক’ তা বাস্তবায়ন সম্ভব হয়নি। বাংলা ভাষা ব্যবহারে আমাদের যত্ন নেই। শুদ্ধ বাংলায় কথা বলা, বাংলায় শুদ্ধতা বজায় রাখা, এমনকি নব্য প্রজন্মের মাঝে বাংলা ভাষা শেখার প্রতি অনাগ্রহ দিন দিন বেড়েই চলেছে। দেশের সর্বোচ্চ আদালতে এখনো রায় লেখা হয় ঔপনিবেশিক ভাষা ইংরেজিতে। প্রশাসন থেকে শুরু করে দেশের স্কুল-কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়েও দিন দিন ইংরেজি ভাষার আধিপত্য বাড়ছে, আর বাড়ছে বাংলার প্রতি অবজ্ঞা ঔদাসীন্য। এ ধারা অব্যাহত থাকলে বাংলা ভাষার অপমৃত্যু দেখতে পাচ্ছেন ভাষাবিদরা।
এছাড়াও দেশের মাটিতে বড়ো হওয়া প্রজন্ম ইংরেজি টোনে কথা বলতে স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করে। ভাষাকে বিকৃত করে অনায়াসে। তার কারণ; তারা মনপ্রাণে বিশ্বাস করতে শুরু করেছে যে, ভিন্ন ভাষা না শিখলে উন্নত হওয়া যাবে না। এই জন্যে তারা চরমভাবে ইংরেজির প্রতি ঝুঁকছে, এবং রাষ্ট্রও পরোক্ষভাবে তাদের মদদ দিয়ে যাচ্ছে- সবচেয়ে আকর্ষণীয় চাকরি, ব্যবসা বা অন্যান্য সুযোগ ভোগ করাটা সহজ করে দিয়ে। অন্যদিকে বৈষম্যের শিকার হচ্ছে সাধারণ স্কুল-কলেজ বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা। এমন বৈষম্য থেকে রক্ষা পেতে সাধারণ শ্রেণির মানুষের মধ্যেও ইংরেজির প্রতি আগ্রহ তৈরি হচ্ছে এবং পক্ষান্তরে বাংলার প্রতি তৈরি হচ্ছে অবহেলা ও উপেক্ষা। আমরা কি জাপানি, জার্মানি, চাইনিজ জাতিদের দিকে তাকাতে পারি না, তারা তো ভাষার জন্যে রক্ত দেয়নি। আজ তারা নিজ ভাষা চর্চার করে, নিজ ভাষায় কথা বলেই নিজেদেরকে বিশ্বে সব থেকে উন্নত জাতি হিসাবে গড়ে তুলেছে। চীনা বা জাপানির মতো জটিল চিত্রলিপির ভাষায় যদি উন্নত জ্ঞান-বিজ্ঞান-প্রযুক্তির চর্চা চলতে পারে, মহাকাশ গবেষণা ও আণবিক গবেষণা চলতে পারে, তাহলে বাংলার মতো উন্নত ভাষায় তা চলবে না কেন? সেখানে মাতৃভাষার বদলে বিজাতীয় ভাষা ইংরেজির প্রয়োজন হবে কেন? মূলত, সর্বস্তরে বাংলা ভাষা প্রয়োগের বিষয় আসলেই একশ্রেণীর কাছে বড়ো অনীহা কাজ করে। কোথায় যেন এক ধরনের হীনমন্যতা। কেন এমন করা হয়? এসব প্রশ্নের কোনো জবাব নেই!
১৯৭৮ সালের আইন অনুযায়ী সরকারি অফিস, আদালত, আধা সরকারি, স্বায়ত্তশাসিত প্রতিষ্ঠান বিদেশের সঙ্গে যোগাযোগের প্রয়োজন ছাড়া অন্য যে কোনো নথি ও চিঠিপত্র, আইন-আদালতের সওয়াল-জবাব এবং অন্যান্য আইনানুগ কার্যাবলি বাংলায় লেখা বাধ্যতামূলক করা হয়। এমনকি উল্লিখিত কর্মস্থলে যদি কোনো ব্যক্তি বাংলা ভাষা ছাড়া অন্য কোনো ভাষায় আবেদন বা আপিল করেন, সেটা বেআইনি ও অকার্যকর বলে গণ্য হবে। কিন্তু তার বাস্তবায়নের নযির এই পর্যন্ত কোথাও মিলেনি। বিপরীতে ঢাকা রাজধানীর অলিগলি সহ দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলেও সরকারি-বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের সাইনবোর্ড, ব্যানার, পোস্টারেও বানানরীতি যত্ন নেই। কোথাও বিদেশি শব্দ লেখা হয়েছে বাংলায়। আবার কোথাও অহেতুক বাংলা শব্দকে ইংরেজিতে লেখা হয়েছে। আবার ইংরেজি নাম লেখা হয়েছে বাংলা হরফে। স্টাইল শো, স্টার ফ্যাশন, সেঞ্চুরি, টপ ফ্যাশন, ক্যাটস আই, মনসুন, চাংপাই, ইয়ামী-ইয়ামী ইত্যাদি। ভাষা আন্দোলনের সত্তর বছর পরও ভুল বানানের ছড়াছড়ি সর্বত্র। যুগের পর যুগ নানাভাবে এ বিষয়ে কথা উঠলেও বিপরীতে বাংলার অবমাননা উত্তরোত্তর বেড়ে চলেছে।
এ ছাড়া এখন ইংলিশ মিডিয়ামের ছাত্রছাত্রীর বাংলা শুনলে এটা যে তাদের মাতৃভাষা তা মনে হয় না। কোনো কোনো গণমাধ্যম বা বিজ্ঞাপনে এখন ইংরেজি-বাংলা-হিন্দি-আঞ্চলিক ভাষা মিশিয়ে যে কী বলা হচ্ছে, তার সংজ্ঞা দেওয়া দুষ্কর। তরুণেরা এখন যে ভাষার দিকে ঝুঁকছে, তা না প্রমিত, না বিশেষ কোনো আঞ্চলিক ভাষা। এর সঙ্গে যুক্ত হচ্ছে এসএমএস এবং ই-মেইলের অসম্পূর্ণ শব্দ ও বাক্যের যথেচ্ছ ব্যবহার। ব্যাকরণ, বানান ও প্রথাকে তুচ্ছ করার এই প্রবণতা আত্মহননের সমতুল্য বলে ভাবছেন প্রবীণ বাণীসাধকেরা। মূলত মায়ের ভাষার চর্চাটা পরিবার থেকে উৎসাহিত করতে হবে। এই একুশ আমাদের কেবল গৌরবোজ্জ্বল অতীতকে মনে করিয়ে দেয়না, দেয় সাবধান বাণীও। মনে করিয়ে দেয় ভাষার স্বাভাবিক মৃত্যুর ইতিহাস। ভাষাবিদেরা লক্ষ করেছেন যে গত শতাব্দী থেকে বিপন্ন কিংবা মৃত ভাষার সংখ্যা আশঙ্কাজনক হারে বেড়ে গেছে। এক পরিসংখ্যান অনুযায়ী মোট ৪২ হাজার ১৯২টি ভাষার মধ্যে পৃথিবীতে এখন মাত্র ছয় হাজার ভাষা জীবিত। এবং এখন যে হারে ভাষা অবলুপ্ত হচ্ছে, তাতে আগামী ১০০ বছরে ৫০ শতাংশ ভাষা হারিয়ে যাবে। অর্থাৎ, প্রতি দুই সপ্তাহে মৃত্যু হবে অন্তত একটি ভাষা।
সুতরাং বিশ্বায়নের এই যুগে বাইরের আক্রমণ সম্পর্কে যেমন সজাগ থাকতে হয়, তেমনি ঔদাসীন্য ঝেড়ে মাতৃভাষা পরিচর্যায় আরও অনেক বেশি যত্নশীল হওয়ারও কোনো বিকল্প নেই। মানবদেহ যেমন প্রতিদিন খাদ্য ও যত্ন দাবি করে, ভাষাও তেমনি কেবল হৃদয়ে সীমাবদ্ধ নয়, কথায়, কাজে সর্ব হালতে জড়িয়ে নিতে হবে। অনতিবিলম্বে বাংলা ভাষা চর্চা না করার দীনতা পরিহার করতে হবে সবার। কেবল ফেব্রুয়ারি মাস নয়,মায়ের ভাষা বাঁচানোর তাগিদ বছর জুড়ে থাকতে হবে। ভিনদেশী ভাষা চর্চা সংকুচিত করতে হবে। যদি ভাষার প্রতি আমাদের এমন অপ্রত্যাশিত দৃষ্টিভঙ্গির পরিবর্তন না আনি সামনে পুরা জাতির জন্যে কঠিন পরীক্ষা অপেক্ষা করছে। যদি বাঙালি জাতি তার মাতৃভাষা হারিয়ে ফেলে, তাহলে তার পূর্বপুরুষের অর্জিত অমূল্য সেই ভান্ডারের দ্বার শুধু তার জন্যই নয়, পুরো মানবজাতির জন্য চিরতরে রুদ্ধ হয়ে যাবে। পরিশেষে বলি, একুশের শীর্ষ দাবি সর্বস্তরে বাংলা ভাষার প্রচলন হোক। জাতি ধর্ম বর্ণ নির্বিশেষে সর্বমহলে নেওয়া হোক মাতৃভাষা বিকৃতি রোধের অঙ্গীকার।
লেখক: এম. আতহার নূর
শিক্ষার্থী, আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগ, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়
এসএ/