রাবি ক্যাম্পাসের সেই নজীরবিহীন দুর্ঘটনা ও শহিদ হিমেল
হিমেল বেঁচে থাকলে হয়তো ভালো একটি কর্মের মাধ্যমে উপার্জনে যুক্ত হতো। মমতাময়ী মায়ের চিকিৎসা এবং আরাম-আয়েশের ব্যবস্থা করতো। হয়তো বিয়ে করত। একমাত্র ছেলে ও ছেলের বউকে কাছে পেয়ে হয়তো মা আনন্দে আত্মহারা হতেন। ভাগ্যের নির্মম পরিহাস! মাকে রেখে চলে গেল হিমেল।
হিমেলের চিরআপনজন ও আমাদের শ্রদ্ধেয় সেই মায়ের নিয়মিত খোঁজখবর নেওয়ার পাশাপাশি চিকিৎসা ও জীবিকা নির্বাহের জন্য প্রতি মাসে ৩৫ হাজার টাকা করে আজীবন ভাতা দেবে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ। এমন উদ্যোগ ও সিদ্ধান্ত নিঃসন্দেহে প্রশংসার দাবি রাখে।
হিমেলকে ফিরিয়ে দেওয়ার মাধ্যমে তার মমতাময়ী মায়ের সন্তুষ্টি অর্জন করা দুনিয়ার কারও পক্ষে সম্ভব নয়। এ ছাড়াও সড়ক দুর্ঘটনার পর শিক্ষার্থীদের দাবি মেনে নেওয়ার পাশাপাশি হিমেলের কফিন নিয়ে নাটোরে গিয়ে তার মাকে সান্ত্বনা দেওয়ায় মাধ্যমে উপাচার্য অধ্যাপক গোলাম সাব্বির সাত্তার দারুণ ভূমিকা পালন করেছেন। এতে শিক্ষার্থীদের ক্ষোভ অনেকাংশেই কমে যায়।
হিমেলের নামে ভবনের নামকরণ
রাজশাহী বিদ্যালয়ের ভবনগুলো যাদের নামে নামকরণ করা হয়েছে, তাদের প্রত্যেকেই খ্যাতিমান ব্যক্তিত্ব এবং একেকজন একেকটা ইতিহাস। তারা প্রত্যেকেই অসাধারণ ব্যক্তিত্বের অধিকারী ছিলেন। যে কারণে বিভিন্ন সময় তাদের স্মরণে বিভিন্ন প্রকাশনাও বের হয়।
হিমেল তেমন কেউ না হলেও তার সবচেয়ে বড় পরিচয় সে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র, যেমন আমরাও। হিমেল সড়ক দুর্ঘটনায় নিহত একজন শহিদ। স্বেচ্ছায় দেশ ও মানুষের স্বার্থে সে নিজের জীবন বিলিয়ে দেয়নি। অথবা দেশ ও মানুষের বৃহৎ কোনো স্বার্থের পক্ষে অবস্থান করায় কোনো শত্রুপক্ষ তার প্রাণ কেড়ে নেয়নি।
তবে দেশে সড়ক দুর্ঘটনায় প্রাণ হারানো মানুষের সংখ্যা প্রতিনিয়তই বাড়ছে। এ ক্ষেত্রে অনুন্নত ও দুই লেনের সড়ক, অদক্ষ ও উগ্রপন্থী চালক এবং বিআরটিএ ও ট্রাফিক পুলিশ বিভাগের অপব্যবস্থাপনা অবশ্যই দায়ী। যে কারণে নিরাপদ সড়ক আন্দোলন, বাংলাদেশের জনগণের জাতীয় আন্দোলনে পরিণত হয়েছে।
আর এই আন্দোলনকে আরও শক্তিশালী ও কার্যকর করতে হিমেলের জীবনদান নিঃসন্দেহে স্মরণীয় হয়ে থাকার দাবি রাখে। কারণ আমাদের নিরাপদ ক্যাম্পাসেও সড়ক দুর্ঘটনার ঘটনা ঘটতে পারে, এটা ছিল অকল্পনীয় ও অপ্রত্যাশিত। রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষের গাফিলতির কারণেই এমন নজীরবিহীন ঘটনার সূত্রপাত হলো। এ ক্ষেত্রে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ কোনোভাবে দায় এড়াতে পারে না।
তবে আমরা শিক্ষার্থীরা যারা উশৃঙ্খলভাবে ক্যাম্পাসে অথবা ক্যাম্পাসের বাইরে ড্রাইভিং করছি, তারাও প্রশ্নবিদ্ধ নই কি?
রাবি ক্যাম্পাসে ঘটে যাওয়া এই সড়ক দুর্ঘটনায় নিহত মাহমুদ হাবিব হিমেলের জীবন যেমন তার মা, আত্মীয়-স্বজন এবং আমাদের জন্য অপূরণীয় ক্ষতি; তেমনি আমাদের আন্দোলনে বিধ্বস্ত পাঁচটি ট্রাকের মালিক ও চালকের জন্যও হয়তো অপূরণীয় ক্ষতি। ট্রাকগুলোই হয়তো ছিল তাদের পারিবারিক জীবিকা নির্বাহের মূল হাতিয়ার।
যা-ই হোক, সচেতনতাই প্রতিকার। সচেতন হতে হলে শিক্ষার বিকল্প নেই; কিন্তু কারও প্রাণহানি অথবা অপূরণীয় কোনো ক্ষতিসাধনের পর শিক্ষা নেওয়ার প্রথা থেকে আমাদের বেরিয়ে আসতে হবে। ক্ষয়ক্ষতির আগেই সতর্কতা ও সচেতনতার পরিচয় দিতে হবে, আমাদের প্রত্যেককেই।
প্রসঙ্গত, গত ১ ফেব্রুয়ারি রাত ৯টার দিকে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের শহীদ হবিবুর রহমান হলের সামনে ট্রাকচাপায় গ্রাফিক ডিজাইন, কারুশিল্প ও শিল্পকলার ইতিহাস বিভাগের চতুর্থ বর্ষের ছাত্র মাহমুদ হাবিব হিমেল নিহত হন। তিনি শহীদ শামসুজ্জোহা হলের আবাসিক ছাত্র ছিলেন। রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় ড্রামা অ্যাসোসিয়েশনের (রুডা) সাধারণ সম্পাদক ও কেন্দ্রীয় সাংস্কৃতিক জোটের দপ্তর সম্পাদক পদে দায়িত্ব পালন করছিলেন তিনি। ওই দুর্ঘটনায় সিরামিক ও ভাস্কর্য বিভাগের চতুর্থ বর্ষের ছাত্র রায়হান প্রামাণিক আহত হন।
লেখক: রাকিব হোসেন আপ্র
শিক্ষার্থী, গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগ, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়
এসএ/