কর্মফল নিয়তে নির্ভর
কবিরা গোনাহকারীদের অধিকাংশ যদিও নফসে তাড়িত হয়ে স্বেচ্ছায়, স্বজ্ঞানে গোনাহ করে থাকে তবে তাদের ক্ষুদ্রাংশ কিন্তু পারস্পরিক কখনও সামাজিক, কখনও রাজনৈতিক, কখনও রাষ্ট্রীয় চাপে কবিরা গোনাহ করতে বাধ্য হয়। তাহাজ্জুদগুজারিদের বড় অংশ যদিও আল্লাহর সান্নিধ্য লাভের আশায় রাত জাগরণ করে থাকে। তবে একটা অংশ কিন্তু লোক দেখানো, পদ টিকানোর জন্য তাহাজ্জুদে দাঁড়ায়। যে উদ্দেশ্যেই কবিরা গোনাহ করুক না কেন, গোনাহকারী কিন্তু সমাজরে চোখে ঘৃণ্য। আবার যে উদ্দেশ্যেই তাহাজ্জুদে দাঁড়াক না কেন, দণ্ডায়মান ব্যক্তি কিন্তু সমাজের চোখে পুণ্যবান। আমরা অনেকাংশেই সমাজ, রাজনীতি, রাষ্ট্রনীতির জন্য নিজের আমিত্বকে বিসর্জন দিই আবার ক্রন্দন করি। আমাদের উচিত সব ক্ষেত্রে নিজেদের আমিত্বকে টিকিয়ে রাখা, তবে অহংবোধে নয়। কাল কেয়ামতের মাঠে কিন্তু আপন আমির হিসাব দিতে হবে, সমাজ বা রাষ্ট্রের নয়।
রাসুল (সা.) এরশাদ করেন, ‘নিশ্চয় সব আমলের ফলাফল নিয়তের ওপর নির্ভরশীল।’ সুতরাং প্রত্যেক মানুষ (পরকালে) তাই পাবে যা সে নিয়ত করবে। যে ব্যক্তি আল্লাহ এবং তার রাসুলের উদ্দেশ্যে হিজরত করে, তার হিরজত আল্লাহ এবং তার রাসুলের উদ্দেশেই হবে। আর যে ব্যক্তি দুনিয়া হাসিলের কিংবা কোনো নারীকে বিয়ে করার উদ্দেশ্যে হিজরত করে, তার হিজরত সেই উদ্দেশ্যেই গণ্য হবে যে উদ্দেশ্যে সে হিজরত করেছে। (বোখারি)
এই হাদিসের সঙ্গে একটি ঘটনাও উল্লেখ করা হয়, যখন মুসলমানরা মক্কার কাফের সম্প্রদায়ের দেওয়া জুলুম-নির্যাতন আর কষ্ট সহ্য করতে পারছিল না তখন মহান আল্লাহ তায়ালার হুকুমে হিজরত করে। সবার উদ্দেশ্য ছিল মদিনায় সহজভাবে মহান আল্লাহ ও তার রাসুল (সা.) এর আনুগত্য করা। তাই হিজরত করে মদিনায় গমন করেন। কিন্তু তাদের মাঝে একজন লোক এই কারণে হিজরত করে যে, হিজরতকারীদের মাঝে একজন মহিলা ছিল, ওই মহিলাকে বিয়ে করার জন্য সবার সঙ্গে হিজরত করে। এই কথা রাসুল (সা.) জানার পর তিনি বলেন- ‘যে আল্লাহ ও তার রাসুলের উদ্দেশ্যে হিজরত করেছে তার হিজরত সেই হিসেবেই গণ্য হবে, অর্থাৎ তারা উত্তম বিনিময় পাবে। আর যে দুনিয়া লাভ বা কোনো নারীকে বিয়ে করার জন্য হিজরত করেছে, তার হিজরতও সেভাবেই গ্রহণ করা হবে, পরকালে তার কোনো উত্তম বিনিময় থাকবে না।
পৃথিবীতে মানুষ নানা নিয়তে নানা কাজ করে থাকে। কেউ জ্ঞানার্জন করে নিজেকে জ্ঞানীরূপে জাহির করার জন্য, কেউ লেখালেখি করে নিজেকে লেখকরূপে হাজির করতে, কেউ হজ করে আলহাজ হতে, কেউ দান করে দানবীর হতে, কেউ পীর হয় হাদিয়া পেতে, কেউ দরবেশ হয় ভণ্ডামি করতে। বিচিত্র পৃথিবীতে কাজের ধরন এক, উদ্দেশ্য আরেক।
কেয়ামতের দিন তিনজনকে প্রথমে আগুনে ফেলে দেওয়া হবে। তারা হলো জ্ঞানী, মুজাহিদ ও দাতা। আল্লাহ জ্ঞানী বা আলেমকে প্রশ্ন করবেন, ‘তুমি দুনিয়ায় কী করেছ?’ সে বলবে, ‘আমি আপনার জন্য জ্ঞান অর্জন করেছিলাম ও আপনার সন্তুষ্টির জন্য সেই জ্ঞান দান করেছি।’ তখন তাকে বলা হবে, ‘তুমি মিথ্যা বলেছ। তুমি জ্ঞান অর্জন করেছ যেন তোমাকে জ্ঞানী বলা হয়। তুমি যা চেয়েছিলে তা দুনিয়াতে পেয়ে গিয়েছ।’
তখন আদেশ করা হবে সেই জ্ঞানীকে দোজখে ফেলে দেওয়ার জন্য। দানকারী ব্যক্তিকে আল্লাহ প্রশ্ন করবেন, ‘তুমি দুনিয়ায় কী করেছ?’ সে বলবে, ‘আমি আপনার জন্য হালালভাবে সম্পদ অর্জন করেছিলাম ও আপনার পথে তা দান করেছি।’ তখন তাকে বলা হবে, ‘তুমি মিথ্যা বলেছ। তুমি সম্পদ দান করেছ যেন তোমাকে দাতা বলা হয়।’ তুমি যা চেয়েছিলে তা দুনিয়াতে পেয়ে গিয়েছ। তখন আদেশ করা হবে সেই দাতাকে দোজখে ফেলে দেওয়ার জন্য। মুজাহিদকে প্রশ্ন করা হবে, ‘তুমি দুনিয়ায় কী করেছিলে?’ সে বলবে, ‘আমি আপনার জন্য মৃত্যু না হওয়া পর্যন্ত লড়াই করেছিলাম।’
তখন তাকে বলা হবে, ‘তুমি মিথ্যাবাদী। তুমি এজন্য লড়াই করেছ, যেন তোমাকে বীর যোদ্ধা বলা হয় ও তাই হয়েছে। তুমি দুনিয়াতেই তোমার পুরস্কার পেয়ে গিয়েছ।’ এরপর তাকে দোজখে ফেলে দেওয়ার আদেশ দেওয়া হবে। মানুষ প্রচুর আমল করতে পারে; কিন্তু কবুলের প্রশ্ন আসবে ওইসব আমলে যেখানে ইখলাস আছে। যে আমলে ইখলাস নেই, তাতে কবুলের প্রশ্নই আসবে না। কারণ কবুল শুধু ওই আমলের সঙ্গে খাস করে দেওয়া হয়েছে যেখানে ইখলাসের ভারি উপস্থিতি আছে।
মোদ্দাকথা হলো, মানুষ যে কাজ করে, তা অন্তত তিনটি স্তরে সম্পাদিত হয় মানুষের অন্তরে। অন্তরের এই তিনটি ধাপ অতিক্রম না করে কোনো কাজই হওয়া সম্ভব নয়। কারও মনে যে কাজের কোনো ধারণাই নেই, যে কাজ সম্পর্কে কোনো জ্ঞান রাখে না, যে কাজ করার সিদ্ধান্ত অন্তরে নেই- তার পক্ষে সে কাজ করা কোনোক্রমেই সম্ভব নয়। মনের তিনটি স্তরের চূড়ান্ত স্তর বা শেষ স্তর হলো নিয়ত। সব কাজের ক্ষেত্রে এই নিয়তটাই মূল বিষয়। কারণ নিয়তটাই কাজ সম্পন্ন করার ক্ষেত্রে আসল চালিকাশক্তি। আর নিজের কাজটাকে একমাত্র আল্লাহর উদ্দেশ্যে নিবেদন করার নাম হলো ইখলাস এবং ইখলাস ইমানের অংশবিশেষ। মোমিন ব্যক্তির জীবনের প্রতিটি কাজ হতে হবে একমাত্র মহান স্রষ্টা আল্লাহর উদ্দেশ্যে নিবেদিত। এটাই ইখলাসের সার কথা। এ কথার অর্থ এটা নয় যে, জীবনের প্রয়োজনকে উপেক্ষা করে সারাক্ষণ নামাজ, রোজা, তাসবিহ, তেলাওয়াত নিয়ে পড়ে থাকতে হবে।
মনে রাখা দরকার, মানুষকে সৃষ্টি করেছেন আল্লাহ। আর আল্লাহই মানুষের জীবনকে প্রয়োজনের মুখাপেক্ষী করেছেন। তাই জীবন ও জগতের গতির সঙ্গে সামঞ্জস্য বিধানের নামই প্রকৃত ধার্মিকতা। নিজের প্রয়োজনে কাজটাকে মহান আল্লাহর বাতলে দেওয়া পথ ও পন্থায় সম্পন্ন করা এবং তাতে একমাত্র আল্লাহর সন্তুষ্টি বিধানের নিয়ত করাই ইখলাস। নিজের জীবনের কার্যাবলিকে মহান আল্লাহর সন্তুষ্টি বিধানের জন্য করার মধ্যেই ঈমানের সব থেকে বড় পরিচয়। মহান আল্লাহ বান্দার আমলের বাহ্যিক আড়ম্বরের প্রতি বিন্দুমাত্র লক্ষ্য করেন না। বান্দার অন্তরের নিখাঁদ ইখলাসটুকুই আল্লাহ রাব্বুল আলামিনের একমাত্র কাম্য। এরশাদ হয়েছে, ‘বলে দাও, আমার নামাজ, আমার কোরবানি, আমার জীবন, আমার মরণ একমাত্র সমগ্র জগতের প্রতিপালক আল্লাহর জন্য নিবেদিত, তার কোনো শরিক নেই। আমি এ বিষয়েই আদিষ্ট হয়েছি এবং আমিই প্রথম আনুগত্যকারী।’ (সুরা আনআম : ১৬২-১৬৩)। মোমিন বান্দা তার আমলের সওয়াব বা পুরস্কার কতটুকু পাবে সেটা নির্ভর করে তার নিয়তের ওপর। অর্থাৎ নিয়ত দ্বারাই আমলের মান নির্ধারিত হয়। রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, ‘নিশ্চয়ই আমলের বিনিময় বা সওয়াব নির্ধারিত হবে নিয়তের ভিত্তিতে। আর প্রত্যেক ব্যক্তি সেরকমই সওয়াব পাবে যেরকম সে নিয়ত করেছে।’ (বোখারি)। ‘ইন্নামাল আলামু বিন্নিয়্যাত।’ নিয়তগুণে কর্ম- হাদিসটি বিশেষভাবে ইবাদতের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য। কারণ ছোট্ট একটা ভালো কাজ নিয়তের কারণে সীমাহীন সওয়াব এনে দেয়। আবার অনেক বড় ইবাদাতও গোনাহের কারণ হয়ে দাঁড়ায়।
হজরত আবু উমামা বাহেলী (রা.) থেকে বর্ণিত, রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, ‘মহান আল্লাহ কেবল বান্দার সে আমলকেই গ্রহণ করবেন, যা একমাত্র তাঁর উদ্দেশ্যে নিবেদিত এবং যে আমলটা শুধু আল্লাহর সন্তুষ্টি লাভের উদ্দেশ্যে করা হয়েছে।’ (নাসায়ি)।
হজরত আবু হুরায়রা (রা.) একটা হাদিস বর্ণনা করেছেন, রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, ‘আল্লাহ তায়ালা তোমাদের চেহারা ও সম্পদ দেখেন না, তিনি দেখেন তোমাদের অন্তর এবং তোমাদের আমল।’ (মুসলিম)। নিয়তের যে বিশুদ্ধতা বান্দার আমলকে আল্লাহর দরবারে গ্রহণযোগ্য করে তোলে, সেটা বান্দার ঈমানের অংশ। এ বিষয়টি একটি হাদিসে স্পষ্ট উল্লেখ করা হয়েছে।
হজরত আবু ফেরাছ (রা.) থেকে বর্ণিত, (আবু ফেরাছ ছিলেন আসলাম গোত্রের লোক) তিনি বলেছেন, এক ব্যক্তি জিজ্ঞাসা করল, ‘হে আল্লাহর রাসুল! ইমান কি?’ উত্তরে রাসুলুল্লাহ (সা.) বললেন, ‘ইখলাসই হলো ঈমান’ (বায়হাকি)। এক হাদিসে রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, ‘মোমিন ব্যক্তির নিয়ত, তার আমল অপেক্ষা উত্তম।’
আসলে নিয়ত হলো অন্তরের আমল। আর নামাজ, রোজা, হজ, জাকাতসহ যাবতীয় ইবাদত অঙ্গ-প্রত্যঙ্গের আমল। অঙ্গ-প্রত্যঙ্গের আমল অন্তরের আমলকেই প্রকাশ করে। অন্তরের আমল হয় আগে এবং অন্তরের আমলের পথ ধরেই আসে অঙ্গ-প্রত্যঙ্গের আমল। তাই অন্তরের আমল তথা নিয়তের মূল্যই বেশি। আর মহান আল্লাহ বান্দাকে এই অন্তরের আমলকেই পরিশুদ্ধ করতে আদেশ করেছেন। এরশাদ হয়েছে, ‘তারা তো কেবল ইখলাসের সঙ্গে আল্লাহর ইবাদাত করতে, একনিষ্ঠভাবে নামাজ কায়েম করতে, জাকাত প্রদান করতে আদিষ্ট হয়েছে। আর এটাই খাঁটি ধর্ম।’ (সুরা আল বায়্যিনাহ : ৬)। মহান প্রভু আমাদেরকে নিয়তের বিশুদ্ধতাপূর্বক আমল করার তৌফিক দান করুন। আমিন।
লেখক:
মুহাম্মদ ইয়াসিন আরাফাত ত্বোহা
শিক্ষার্থী,ইসলামি বিশ্ববিদ্যালয়, কুষ্টিয়া