একুশ শতকের কৃষি ও রাজনীতি
কৃষকের মাঠে মাঠে এখন পাকা ধানের গন্ধ। পাকা ধানের গন্ধের চাইতে কৃষকের কাছে সুখকর সংবাদ আর কি হতে পারে। সাম্প্রতিক সময়ে আরো কয়েকটি এমন সুখের সংবাদে ফেসবুক সয়লাব হয়ে আছে সেটা হল ঐতিহ্যবাহী ছাত্র সংগঠন বাংলাদেশ ছাত্রলীগ দেশের দরিদ্র কৃষকদের ধান কেটে ঘরে তুলে দিচ্ছে।
আশা জাগানিয়া এ খবরে আমরা আশাবাদী হতেই পারি। কিন্তু অতীব দুঃখের বিষয় এই যে, যে কৃষক ধান উৎপাদন করছে সেই কৃষকের ধান কাটার আর্থিক সামর্থ্য থাকছে না। কেন থাকছে না নেই এটা ভাববার বিষয়। কৃষির অতি যান্ত্রিকিকরণ, কৃষিপণ্যের ন্যায্যমুল্য নিশ্চিত না হওয়া, উৎপাদন কৌশলের বিবর্তন, কৃষি পণ্যের মূল্য বৃদ্ধি, রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত গ্রহণে দীর্ঘসুত্রিতা ইত্যাদি কারণেই এমনটি হচ্ছে বলে মনে হচ্ছে।
স্বাধীনতা পরবর্তী সময়ে যে খাতগুলোর সমস্যা আজও সমাধান হয়নি বলতে গেলে অবহেলিত সেগুলোর মধ্যে কৃষি খাত অন্যতম। কৃষকের উৎপাদিত পণ্যের ন্যায্য মূল্য অনিশ্চিত, মধ্যস্বত্বভোগীদের দাপটে কৃষি পণ্য বিপণন এর ক্ষেত্রে জমে থাকা সমস্যা, উত্তরাঞ্চলে উৎপাদন মৌসুমে হিমাগারের অভাবে নষ্ট হয়ে যাওয়া আলু কৃষির বড় সমস্যাগুলোর অন্যতম।
উল্টো ধনি ব্যবসায়ীরা ব্যক্তিগত উদ্দ্যেগে তৈরি হিমাগারে আলু সংরক্ষণ করে পাঁচ গুণ লাভ ঘরে তুললেও কৃষক সেই মূল্য ভরা মৌসুমে পায় না। যে হারে কৃষি পণ্য উৎপাদনের উপকরণের দাম বেড়েছে ধানের দাম সেভাবে বাড়েনি কিন্তু সরকার গত মাসে মজুদ ঘাটতি দেখিয়ে ইউরিয়া সার কেজিপ্রতি ৫ টাকা হারে বাড়িয়েছে। অন্যান্য সারও কীটনাশক থেকে শুরু করে উৎপাদিত কৃষি উপকরণের দাম বেড়েছে জ্যামিতিক হারে। কৃষি প্রধান দেশ বাংলাদেশ, কৃষিই দেশের সমৃদ্ধির মূল কারণ। দীর্ঘদিন ধরে এই কৃষকই বাঁচিয়ে রেখেছে গরীব এই দেশটিকে। সমস্যা একটাই এই তথ্যটি যতটা কাগজে-কলমে ততটা বাস্তবে নেই।
প্রত্যেকটা কৃষি পণ্যের দাম গ্রাম থেকে শুরু করে রাজধানীতে মূল্য ব্যবধান প্রায় তিনগুণ। ব্যবসায়ীরা জানিয়েছেন মোড়ে মোড়ে চাঁদা দিতেই তাদের এই পর্বত সমান ব্যবধান তৈরি হয় এতে তাদের আসলে করার কিছুই থাকে না। এই প্রচলিত সমস্যাটাও ন্যায্যমূল্য প্রাপ্তির ক্ষেত্রে সবচেয়ে চড় সমস্যা বলে অনেকেই মনে করে।
কৃষিতে বিগত তিন দশকের রাজনৈতিক সিদ্ধান্তের দিক যদি আমরা বিশ্লেষণ করি তাহলে সেটা যতটা না কৃষকের অনুকূলে ছিল তার চাইতে বেশি ছিল ব্যবসায়ীদের অনুকূলে। চাউলের দাম বেড়েছে দফায় দফায়। আমরা কি জানি এই দাম বাড়ার অতিরিক্ত অর্থ কৃষক কতটুকু পায়? তাদের ধানের দাম আদতে বেড়েছে কিনা?
১ কেজি সুগন্ধি ধান কৃষক সর্বোচ্চ ৪০ থেকে ৪৫ টাকা কেজি দরে বিক্রি করে। কৃষকের সেই ধান যখন চাউল হয়ে ভোক্তা পযার্য়ে পৌছায় তখন সেটার দাম বেড়ে দাঁড়ায় ১৫০ টাকা। এখানে বঞ্চিত, শোষিত কৃষক বরাবরের মত উপকৃত ব্যবসায়ীরা। সরকার সবসময়ই বলে আসছে সে কৃষি বান্ধব। সরকার কি জানে শতকরা ৪% হারে প্রণোদনার কৃষি ঋণ কয়জন কৃষক পায়। পেলেও সেই টাকা হাতে আসা পযর্ন্ত সংশ্লিষ্টদের কতটা তৈল মর্দন করতে হয়।
এভাবেই বিভিন্ন সময় কৃষকের উন্নতির নামের সরাসরি উন্নতি হয়েছে ব্যবসায়ীদের। বাংলাদেশের পাট, মাছ, সবজি, চিংড়ি, ফল রপ্তানির বাজার দিন দিন সংকুচিত হচ্ছে, বিশ্বে নতুন বাজার সন্ধান করে রপ্তানি উদ্যোগ নেওয়ার দাবি কৃষকদের দীর্ঘদিনের। সরকার সেদিকে নজর দেয়নি কোন দিন। মধ্যপ্রাচ্যে বাংলাদেশী কমিউনিটিতে বিক্রি হয় ভারতীয় সবজি । গত ২০১৯ সালে রাশিয়া বাংলাদেশ থেকে সাত থেকে আট লক্ষ টন আলু আমদানির ইচ্ছা পোষণ করলেও সরকার রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত ও আমলাতান্ত্রিক জটিলতার কথা বলে সঠিক সময়ে সেটা করতে পারেনি। ঠিক একই ভাবে ২০১৭ সাল থেকে জাপান ও ইংল্যান্ড খিরশাপাতি আম আমদানির আগ্রহ প্রকাশ করলেও ঝুলে আছে সে প্রক্রিয়া। সরকারি সিদ্ধান্ত থাকলেও বিগত তিন দশকে কোন সরকারই কৃষকেদের এই জমে থাকা সমস্যার সমাধানে এগিয়ে আসেনি। তথাপিও কৃষকদের উদ্ভাবনী শক্তির অবদানে বিগত কয়েক বছরে বাংলাদেশ কৃষি পণ্য উৎপাদনে অভাবনীয় সাফল্য অর্জন করে। ব্যক্তি উদ্যোগের পাশাপশি রাষ্ট্রীয় পৃষ্ঠপোষকতা থাকলে আমরা কম আয়তন নিয়েও আরো বেশি দূর এগোতে পারতাম তবু ও স্বাধীনতার ৫২ বছরে বিশ্ব দরবারে আমাদের কিছু সাফল্য সবার নজর কাড়ে। খাদ্য ও কৃষি সংস্থা এফওএ, বাংলাদেশ ব্যাংক, অর্থমন্ত্রণালয়, ইউএসএ কৃষি বিভাগ ২০২১ সালে একটি আশাব্যঞ্জক পরিসংখ্যান তুলে ধরে সেখানে দেখানো হয় বিশ্বের বেশ কয়েকটি খাতে বাংলাদেশ বিশ্বে শ্রেষ্ঠতম অবস্থান ধরে রেখেছে। বাংলাদেশ সারা পৃথিবীতে ইলিশ উৎপাদনে প্রথম স্থান ধরে রেখেছে, পাট উৎপাদনে অর্জন করেছে দ্বিতীয় অবস্থান। মিঠা পানির মাছ উৎপাদনে তৃতীয়, সবজি উৎপাদনে তৃতীয়, পোশাক রপ্তানিতে দ্বিতীয়, আম উৎপাদনে অষ্টম, কাঁঠাল উৎপাদনে দ্বিতীয়, পেয়ারা উৎপাদনে অষ্টম, ধান উৎপাদনের চতুর্থ, প্রবাসী-আয় অর্জনে অষ্টম। এখানে ভারত প্রথম, দ্বিতীয় আমরা, ভালো করেছি কিন্তু প্রশ্ন হচ্ছে আমাদের কি আরো ভালো করার সুযোগ ছিল না! অবশ্যই ছিল, কিন্তু কেন সেটা হলো না।
ছাত্রলীগের কর্মীরা মাঠে ধান কাটার যে মিডিয়া কাভারেজ আমরা দেখি, দরিদ্র কৃষকের অর্থসাশ্রয় করার যে প্রচেষ্টা আমরা দেখি তার চাইতে বেশি জরুরী কৃষকের সকল জাতীয় সমস্যার সমাধান। এভাবে কৃষকের জমিতে ধান কাটার মায়াকান্না না করে রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত গ্রহণ প্রক্রিয়ায় প্রভাব বিস্তার করে কৃষকের অধিকার প্রতিষ্ঠা বেশি জরুরী। একুশ শতকে ভারত ও চায়নার কৃষির কাছাকাছি যেতে হলে এছাড়া আর কোন গত্যন্তর আছে কি? আর যদি আমরা সঠিক সময়ে সঠিক পরিকল্পনা নিয়ে এখনই সিদ্ধান্ত নিতে না পারি তাহলে উৎপাদনমুখি বিশ্বব্যবস্থায় আমরা দুর্ভিক্ষকে বরণ করে নিতে বাধ্য হবো। সবচেয়ে বড় কথা হলো বিশ্বায়নের এই যুগে কৃষিকে না বাঁচিয়ে বাঁচবো না আমরা, বাঁচবে না আমাদের রাজনীতি, অর্থনীতি কৃষি ও সংস্কৃতি।
লেখক: প্রাবন্ধিক, গল্পকার ও শিক্ষা গবেষক
ডিএসএস/