খাঁচা
রাতের বেলা সবাই যখন ঘুমিয়ে পড়ে তখন সে ছাঁদ থেকে টুকটাক খাবার সংগ্রহ করে—এই তার অপরাধ। খাবার বলতে তেমন কিছুই না—একটা দুটো কচি সসা, দুটো লাউয়ের ডগা, মিষ্টি কুমড়োর নবীন ফুল—এই সব। নিজের জন্য যতটুকু পারে ছাঁদে বসেই ইচ্ছে মতো খেয়ে নেয় সে। কেননা বাসায় ফিরে অনেক কাজ থাকে তার। দুধের বাচ্চাটাকে স্তন্য দিতে হয়। মরদটা গোস্বা করে থাকে—তার মান ভাঙাতে হয়। বাসায় বসে সে বাচ্চাগুলোকে পাহাড়া দেয়। বিড়াল আর সাপদের থেকে নিরাপদ রাখতে সেও খুব খাটে; সতর্ক থাকে। সে জন্য স্পেশাল কিছু নিতেই হয়। ছোটবোন পোয়াতী সতীনটাও আজকাল আর খাবারের সন্ধানে বেরোতে পারে না। তার জন্যেও কিছু নিয়ে যেতে হয়।
অবশ্য আগে ওরা কেউ বাসার ছাঁদে আসতো না। নিচে থেকেই প্রয়োজনীয় খাবার সংগ্রহ করতো। ছাঁদ থেকে জানালার কার্নিস বেয়ে লাফিয়ে সোজা সজনে গাছটায় উপরে পড়তো। তারপর গাছ বেয়ে সদলবলে নিচে নেমে ড্রেনের ধার দিয়ে কিছুক্ষণ এগোলেই সম্ভু কাকার লন্ড্রির দোকান। পাশেই হরিদার টি স্টল। এখানেই কাকারা ওদের জন্য খাবার স্টোর করে রাখতো—বিস্কুটের ভাঙ্গা টুকরো, পঁচা পাউরুটি, কলা, লাড্ডুর অংশবিশেষ এইসব। ভোরে পৌরসভার পরিচ্ছন্নতাকর্মীরা নিয়ে যাওয়ার আগেই ওরা ওখানে পৌঁছে যেতো। তারপর সবাই মিলে ভোজনের উৎসব শেষে বাসায় ফিরতো। ভালোই চলছিল উৎসবমুখর এই জীবন। ছেলেপুলে নিয়ে বেশ আরামেই দিন কাটছিল। তারপর হঠাৎ এই ছন্দপতন।
সেদিন ছিল শুক্রবার। হঠাৎ দেখা গেলো সকালবেলাটায় দুজন লোক সজনে গাছটার গোড়া খুঁড়ছে। একটু পরেই সজনে গাছটা হুড়মুড় করে পড়ে গেলো। সকাল পেরিয়ে দুপুর হতেই সম্ভুকাকার লন্ড্রীর দোকান, হরিকাকার চায়ের দোকান উধাও! এখন ওখানটাই একটা দশতলা প্রজেক্ট হবে। নিচেয় শোরুম আর উপরে বাসাবাড়ি-ফ্লাট!
ভাবতে ভাবতে নিকট অতীতের কথা মনে হতেই বুকের ভেতরটা মোচড় দিয়ে উঠলো। সেবার আম্ফান ঝড়ে বাবা মা মারা যাওয়ার পর এই সজনে গাছের ডালেই তো প্রথম পরিচয় হয় মরদটার সাথে। এই তো সেদিন ছোট বোনটাকে নিয়ে মরদটার সাথে সে সংসার শুরু করলো।
ছোটবোনটা এখন সতীন। তার প্রতিদ্বন্দ্বী; অংশীদার। মরদটার ভাগ দিতে হয়। সে সব অবশ্য মেনে নিয়েছে সে। মনকে শান্তনা দেয়, মরদটাতো তাকে ছেড়ে চলেও যেতে পারতো—কিন্তু যায় নি তো; তার ঘরেই আছে। প্রফেসর সাহেবের বাসার শয়তান মাগীটা চেষ্টার তো কম করে নি মরদটাকে ভাগানোর। দুবোনের সম্মিলিত প্রচেষ্টায় মাগীটা পারে নি; হার মানে। তাছাড়া এমন পায়ের উপর পা তুলে কাঠানোর সুযোগ কয়টা ধেঁড়ে জীবনে পায়? দুই বোনের এক মরদ তো মানুষের মধ্যেও দেখা যায়।
নানাবিধ ভাবনা চিন্তা বন্দিনীর মাথায় ঘুরপাক খায়। ঘরে দু'দিনের দুধের বাচ্চাটা রয়েছে। ছোটবোন সতীনটাও পোয়াতি। মরদের কথা না হয় বাদই দিলাম। এখন ওদের খাবারের জোগাড় কী করে হবে?
হাটখোলা বাজারটাও তো অনেক দূরে। তাছাড়া অত দূরে যাওয়াটাও বেশ ঝুকিপূর্ণ। পৌরসভার কাউন্সিলর তোফাজ্জেলের বাসার মেচি বিড়ালটা একটা ঘাতক; অসভ্য জানোয়ার। আমরা কি তোদের কোনো ক্ষতি করেছি কখনো; যে দেখলেই তেড়ে আসিস। ধরে ধরে মারিস। সাহেব তোদের দুধ কলা দিয়ে পোষে ঠিক আছে। তাই বলে কি, সাহেবদের মন রক্ষায় তোদের নিরীহ প্রাণি হত্যা করতে হবে? আমাদের কোনো সাহেব বিবি ওমন দুধ কলা দিয়ে পুষলেও আমরা তোদের মতো ওমন হন্তারক হতাম না!
গৃহস্বামীটি কবি মানুষ। আত্মভোলা। গৃহিনী মহাশয়া ডাক্তার। তবে তাঁরা এতটা প্রতিশোধ পরায়ণ হবে একদমই ভাবনায় আসে নি কখনো। বাবাগো, তোমাদের তো টাকা-পয়সার তেমন অভাব নেই! তবে এত কৃপণতা কেন তোমাদের? ইঁদুরেরা না হয় শসা গাছের দুটো ডগা আর একটা কচি শসাই খেয়েছে তাতে কি তোমরা ফতুর হয়ে গেছো! ঠিক মতো বাজার ঘাটও তোমরা করো না যে রান্নাঘরে ঢুকে একটু আধটু কাটাকুটি খেয়ে আসবো। পাশের বাসার প্রফেসর সাহেব বাজার থেকে কত সবজি বাজার করে আনে—মিষ্টি কুমড়ো, লাউ, টমেটো, ঝিঙে, লাউয়ের ডগা কত কি! অথচ তোমরা দুজন বাইরেই যেতে চাও না। শুধু বাসার ছাঁদ নিয়ে পড়ে থাকো। কে যে তোমাদের ছাঁদ বাগানের ধারণা দিলো! ছাঁদে লাউ, মিষ্টি কুমড়ো, বেগুন, সসা, টমেটো সব চাষ করা যায়। প্রথম প্রথম তোমাদের এসব কাজ খুবই আপত্তিকর মনে হলেও পরে মনে হলো—না, এসব তো তোমরা আমাদের জন্যই করছো। আমরা য়াঁরা নিরাপত্তার খাতিরে ছাঁদবাসী তাদের খাদ্যের প্রয়োজনীয়তা বিবেচনা করে তোমরা এত ভালো একটা প্রজেক্ট হাতে নিয়েছো—ভাবতেই বেশ গর্ব হয়েছিল। অবশ্য এসব বুঝতেও বেশ সময় লেগেছিল। তারপর একদিন দেখা গেল ব্যাপারটা আসলে তা না। একদিন বেগুন গাছ লাগাতে লাগাতে কবি ডাক্তার ম্যামকে বলছেন, বাঁচতে হলে আমাদের কীটনাশকমুক্ত সবজিই খেতে হবে। বাজারের সব সবজিতেইতো কীটনাশক। এখন থেকে ছাঁদে নিজেরাই বিষমুক্ত সবজি উৎপাদন করবো। দু'জনের ব্যাপক উৎসাহ দেখে বেশ ভালো লাগলো।
অনেকক্ষণ খাঁচায় বন্দি থেকে এই সব ভাবতে ভাবতে তার মধ্যে ঝিমুনির ভাব আসে। ঝিমুনির মধ্যেই গতকালের কথা মনে হয়—ছাঁদ থেকে পেট পুরে খেয়ে নিয়ে খুশী মনে বাসায় ফিরে দেখে সকলেই অঘোরে ঘুমোচ্ছো। সকালে বাচ্চা দুটো একটু বেশী দুধ খেয়ে ফেলেছিল। অনেক সময় ঘুমোবে। পোয়াতী সতীনটা প্রতিবেশী নানীর বাড়িতে গেছে ঝাঁড়ফুক নিতে! মরদটা পিট পিট করে তাকাচ্ছে। কুই কুই করে কাছে ডাকতেই খুশী মনে সে মরদের পাশে শুয়ে পড়ে।
ডিএসএস/