ফোড়াটি এখন ক্যানসার
খুব সম্ভবত ২০১৭ সালে ফোড়াটি প্রথম উঠতে শুরু করে। আমরা তাকে চুলকে দেই, মিস্টি ব্যথায় লালন করে মজা নিতে থাকি। কিন্তু হায় ফোড়াটি এখন ক্যানসার হয়ে গেছে। সমাজের পুরো শরীরটাকে আস্তে আস্তে ছেঁয়ে ফেলছে। তবুও আমরা খেয়াল করছি না। উৎসাহ দিচ্ছি।
হ্যাঁ, ফোড়াটির নাম আশরাফুল আলম। যে নামের আগে হিরো লাগিয়ে নিজেকে হিরো ভেবে, বানিয়ে নানা রকম ভেলকি, বাঁদর নাচ দেখিয়ে মোটামুটি একটা টাকা পয়সার মালিক হয়ে গেছে। দু-চারজন সাঙ্গপাঙ্গ জুটিয়ে, দামি অথচ কিম্ভুতকিমাকার পোষাক আশাক করে ঘুরে বেড়ায়। যে কোনো ইস্যুতে দৌড়ে যায়, লাইভে কথা বলে।
এসবের কারণে তার গানের নামে যন্ত্রণা উৎপাদন, অভিনয়ের নামে অশ্লীলতা আর বাঁদরের ভেংচি, অশুদ্ধ উচ্চারণের শব্দ দূষণ থেকে মানুষ কিছুটা হলেও মুক্তি পেয়েছে। কবিতার নামে তিনি যা শুরু করেছিলেন তা অব্যাহত থাকলে পৃথিবীর সকল কবিরা এত দিনে আত্মহত্যা করতেন।
যাক! এই জিনিস নিয়ে কথা বলতে চাইনি। তার অনেক ভক্তবৃন্দ তৈরি হয়েছে। মুলধারার গণমাধ্যম এখন তার পেছনে হুমড়ি খেয়ে পড়ে। ওই যে, কারণ একটাই ভাইরাল হওয়া এবং ডলার আয়। এ কারণে প্রথমে কুৎসিত যন্ত্রনাদায়ক ফোড়াকে আমরা আমাদের শরীরের লালন করলাম এখন ক্যানসার হওয়ার পরেও সেটাকে সারানোর বা কেটে ফেলার কোনো লক্ষণ তো দেখছি না। বরং আরও বিস্তৃত লাভ করছে বলেই মনে হচ্ছে।
গত সপ্তাহেই এক প্রগতিশীল লেখিকা হিরোকে নিয়ে একটা লম্বা স্ট্যাটাস দিলেন এবং বললেন, পৃথিবীর তাবৎ মহান মানব ও সৃষ্টিশীলদের সঙ্গে এই হিরোর মিল আছে। আমি পড়ে কিছুটা বিমূঢ় হয়ে গেছি। এই লেখিকা বলেন কি? মাক্সিম গোর্কির জীবনের সঙ্গেও নাকি এর মিল আছে। আমি অসহিষ্ণু হয়ে তার বিবৃতিতে মতামত দিলাম, আফা স্ট্যাগলের নামে লাজ-লজ্জাহীনতা, বেহায়াপনাকে সেলুট জানালেন ঠিক আছে, কিন্তু মাক্সিম গোর্কির সাহিত্যকৃতি আর হিরোর শিল্পকৃতি কি এক জিনিস হলো? তিনি আমাকে রেসিস্ট বলে গাল দিলেন।
ডিকসনারি ঘেঁটে দেখলাম রেসিস্ট অর্থ বর্ণবাদী। এই গালির উদ্দেশ্য, আমি খেটে খাওয়া, মানুষের অবহেলা পাওয়া, কালো কুৎসিত, মানবতাবাদী ও নিম্নশ্রেণির প্রতিনিধি হিরোকে অবহেলা করছি।
হায়রে লেখিকা, আপনি কেন বুঝতে পারছেন না এই লোকের কর্মকে আমি সমালোচনা করছি। তার লেগে থাকাকে নয়। তার অববয়কে নয়।
যা হোক, তাকে নিয়ে এখন কথা বলা যায় না। দেশের বড় বড় দলের লোক, বুদ্ধিজীবী, টকশোতে কথা হচ্ছে তার পক্ষে। হিরো লাইভে এসে হুমকিও দেন। ‘হিরো আলম কি, হামি কি হছি সেটা টকশো গুলন দেখলেই দেইকপার পাবেন। হামা লিয়্যা কত বড় বড় মানুষ কতা কইচ্ছে।’ হয় বাপু তোক লিয়া বড় বড় মানুষ কথা কইচ্চে।
দুটো ভিডিও ক্লিপস আর খবর দেখে তব্দা খেয়ে এই লেখা লিখতে উদ্বুদ্ধ হয়েছি। একটি সংবাদ হচ্ছে, ‘ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে হিরো আলমের ভাস্কর্য স্থাপিত হলো।’ আরে বলে কী? কোথায় কোন জায়গায় স্থাপিত হলো তার ভাস্কর্য? পরে জানতে পারলাম, চারুকলার এক ছাত্র কেসস্টাডি হিসেবে হিরো আলমের খোমা তৈরি করে ওখানে রেখে দিয়েছে। তার সঙ্গে সেলফি তুলে হিরো পুরো নেট দুনিয়াকে অস্থির করে তুলেছে। যেখানে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের নাম ভাঙানো হয়েছে। এত বড় একটা মিথ্যাচার নিয়ে কেউ কোনো কথা বলল না। দেশের বড় বড় মানুষের ভাস্কর্য যেখানে স্থান পায়নি আর সেখানে হিরো আলমের ভাস্কর্য স্থাপন করা হয়েছে- এই খবরটাও মিডিয়া যাচাই করল না। চালিয়ে দিল। হায়রে মিডিয়ার দৈন্যদশা। একটা পচা-বাসি খাবার প্যাকেট করে তারা বেচতে লাগল কয়েক দিন ধরে।
আরেকটা ভিডিও দেখলাম, পরী বাবু নামে এক ব্যক্তিকে হিরো সহায়তা করতে চেয়ে করেননি। সেই লোক ব্যাপক কান্নাকাটি করছে। তার সঙ্গে প্রতারণার গল্প বলছে। যা খেয়াল করলাম ভাইরাল হওয়ার জন্য যেখানে যেমন যা করা দরকার হিরো তাই করে থাকেন। এমন কি ভোট পাবে না জেনেও জাতীয় সংসদ নির্বাচন করে হেরে গিয়ে নেট দুনিয়া গরম করে রাখেন। তার নির্বাচন ক্যারিক্যাচারে শেষমেশ না জাতিসংঘ বিবৃতি দেয়। বড় দলগুলো তাকে নিয়ে টানাহেঁচড়াও শুরু করে। আর ইউটিউবাররা এটা নিয়ে হাজার ধরনের কনটেন্ট তৈরি করলেন। লাভের লাভ উপরি কামাই ওই ডলার।
যা দেখছি, এই হিরো এখন অনেক প্রতারণার গল্প জন্ম দিচ্ছেন। অনেক বিভ্রান্তি ছড়িয়ে আমাদের মনোযোগ আকর্ষণের চেষ্টা করছেন। পরে যা ঘটছে তার উল্টোটাই বেরিয়ে বেরিয়ে আসছে।
কিছুদিন আগে এক মাইক্রোবাস উপহার পেলেন তিনি। পরে দেখা গেল সেটির কাগজপত্র ঠিক নেই দশ বছর ধরে। মালিক ছেড়ে দে মা কেঁদে বাঁচার মতো করে হিরোর হাতে এটা শপে দিয়ে ভার মুক্ত হলেন। এক প্রবাসী তাকে দেড় লাখ টাকা দামের সোনার চেইন দিলেন। পরে দেখা গেল হিরোই জানালেন এটা সোনার নয়। তার সঙ্গে প্রতারণা করা হয়েছে। আবার নিজের নামে একটা ফাউন্ডেশন তৈরি করে অনুদান নেওয়া শুরু করেছেন। একটা ফাউন্ডেশনের গঠন প্রক্রিয়া কী, সরকারের অনুমোদন নিয়েছেন কি না, জয়েনস্টকে নিবন্ধন হলো কি না তার খোঁজ কেউ নিচ্ছে না। টাকা দিচ্ছেন। হিরোর কামাই কিন্তু মন্দ না। আমাদের এসব কায়-কারবারে তার দুই কোটি টাকার বাড়ি কিন্তু ঠিকই উঠেে গেছে। আর বছর বছর বউ পাল্টানোর সুযোগও তিনি পাচ্ছে ফ্রিতে।
তার নোংরামো, প্রতারণা আর উচ্চশ্রেণিতে ওঠার নানা গল্প এখন নেট দুনিয়া ঘুরে বেড়াচ্ছে। তার মিউজিক ভিডিও আপনার দেখেছেন, গান শুনেছেন, কবিতা আবৃত্তি শুনেছেন, সিনেমা দেখেছেন এগুলো কোন পর্যায়ের শিল্প- তা বিচার বিবেচনাবোধ থাকলেই নিজেরাই বলতে পারবেন। তার জন্য বোদ্ধা সমালোচক হওয়ার প্রয়োজন নেই। এই ‘হিরো দেশে বিদেশে বাংলাদেশের একজন হিরো’ হিসেবে যে সংকেত পৌছে দিচ্ছেন তাতে আমরা ছোট হচ্ছি না বড় হচ্ছি আপনারাই ভেবে দেখুন।
টুটুল রহমান: সম্পাদক, অপরূপ বাংলা