তেল নিয়ে তেলেসমাতি
‘নুন আনতে পান্তা ফুরায়’ প্রবাদটির ইংরেজি ‘After meat comes mustard’, অর্থাৎ ‘মাংস খাওয়ার পর সরিষার তেল আসে’। কোথায় নুন-পান্তা আর কোথায় তেল-মাংস! যারা এর রূপান্তরকর্তা তারাই ভালো জানেন এমন অসামঞ্জস্যপূর্ণ রূপান্তরিত বাক্যের মাহাত্ম্য কী? তবে আমরা ভাগ্যবান এই কারণে যে, ওই রূপান্তরিত প্রতীকী উপাদানে আমাদের আবহমান গ্রাম বাংলার বহুল ব্যবহৃত তেল ‘সরিষা’ ঠাঁই পেয়েছে। আজকের নিবন্ধনটির মূল বিষয় সেটিকে নিয়েই।
আমরা জানি, ভোজ্যতেল হিসেবে সরিষা খুব জনপ্রিয়। এ দেশে রান্নাবান্না, গা-গোসলে এটি সবচেয়ে বেশি ব্যবহৃত হয়। দেশের ব্যবহারযোগ্য বিভিন্ন তেল যেমন— সয়াবিন, তিল, সূর্যমুখী, তিসি, রেড়ি ইত্যাদির মধ্যে সরিষার ব্যবহার সর্বাগ্রে। কষ্টের কথা হলো আমাদের ভোজ্যতেলের শতকরা নব্বই ভাগই বিদেশ থেকে আমদানি করতে হয়। তাই দেশে অধিক পরিমাণ সরিষা উৎপাদন করেই আমরা ভোজ্যতেলের চাহিদা কমপক্ষে ৫০ শতাংশ পূরণ করতে পারি। এ দেশের পোলিযুক্ত দোআঁশ মাটি সরিষা চাষের খুব উপযোগী।
বাংলাদেশের কুষ্টিয়া, যশোর, মাগুরা, ঝিনাইদহ, জয়পুরহাট, বগুড়া, নাটোর, নওগাঁ, রাজশাহী, রংপুর, দিনাজপুর এবং নিলফামারী জেলা সরিষা চাষের জন্য খুব উপযোগী। মাটির রকমভেদে ৪/৫টি চাষ করে সরিষা বুনতে হয়। আবার কখনো কাদার উপর সরিষার বীজ ছিটিয়েও চাষ করা হয়। সরিষার দানা ছোট, তাই উৎপাদনের ক্ষেত্রে প্রতি শতকে প্রায় ২৫ থেকে ৩০ গ্রাম বীজ বপন করতে হয়। কার্তিক ও অগ্রহায়ণ মাসের প্রথম সপ্তাহে সরিষার বীজ বোনা হয়। সরিষা চাষের জন্য প্রতি বিঘা জমিতে তিন থেকে চার হাজার টাকা খরচ হয়। সাধারণত দুই মাসে সরিষার ফসল ঘরে তোলা হয়।
আমাদের দেশে তিন ধরনের সরিষার চাষ করা হয়, যথা- টরি, শ্বেত ও রাই। এ ছাড়া বারি-১৪ ও বারি-১৫ হলো উন্নত জাতের দুইটি সরিষা। এ দেশে প্রতি বিঘা জমিতে ৬ থেকে ৭ মণ সরিষা উৎপন্ন হয়। বাংলাদেশের প্রায় ৩ লাখ হেক্টর জমিতে সরিষার চাষাবাদ করা হয় এবং এতে প্রায় আড়াই লাখ টন সরিষা পাওয়া যায়।
সরিষার তেলে 'গ্লুকোসাইনোলেট' নামক রাসায়নিক উপাদান আছে যা মাইক্রোব ও ব্যাকটেরিয়াকে নির্মূল করে। এতে ৬-১০ শতাংশ ফ্যাটি এসিড থাকে। এ ছাড়াও সরিষার তেলে ক্যালসিয়াম, ম্যাগনেশিয়াম, পটাসিয়াম, আয়রন, ফসফরাস ও সালফার থাকে। সরিষাতে বিদ্যমান ভিটামিন, মিনারেল ও পুষ্টি উপাদান চুলের অকালপক্বতা দূর করে এবং তা বৃদ্ধিতে সাহায্য করে। হৃদরোগের ঝুঁকি কমাতে সরিষার তেল ৭০% কাজ করে। সর্দি, কাশি বা যে কোনো শারীরিক ব্যথা থেকে রেহাই পেতে সরিষার তেলের মালিশ খুব সাহায্য করে। এ তেল নিয়মিত গায়ে মাখলে এবং নাকে দিলে শরীর ঝরঝরে হয়, শ্বাসনালী পরিষ্কার থাকে এবং শরীরের তাপমাত্রা বৃদ্ধি পায়। এটি এতোই সক্রিয় যে, খাঁটি সরিষার তেল ফ্রিজে রাখলে কখনো জমবে না। সরিষার বীজে ৪০-৪৪ শতাংশ তেল থাকে। এবং প্রতি তিন কেজি সরিষা থেকে এক কেজি তেল উৎপন্ন হয়। সেই হিসেবে এক মণ বা ৪০ কেজি সরিষা থেকে ১৩/১৪ কেজি তেল পাওয়া যায়। তেল পেষার যন্ত্রকে ঘানি বা ঘানিকল বলে। যারা তেল পিষে তাদের ‘কলু’ বলে।
আগেকার দিনে কলুরা ঘানি টানার জন্য চোখ বাঁধানো বলদ গরু ব্যবহার করত। অর্থাৎ মনে হয় শুধু ঘানি টানার জন্যই কলুর বলদ। এক সময় সশ্রম কারাদণ্ডপ্রাপ্ত বন্দীদের দিয়ে ঘানি ঘুরানো হতো। কোনো ব্যক্তি জেলে গেলে শাস্তি স্বরুপ তাকে ঘানি ঘুরাতে হতো। এজন্য ‘জেলের ঘানি’ বলেও বাংলায় একটি কথা আছে।
সরিষা ফুল আমাদের খুব প্রিয়। শীতের বিকালে সোনা ভরা রোদে হলুদাভ সরিষা ফুলের সমারোহে মন জুড়াতে কার না ভালো লাগে! স্নিগ্ধ বাতাস সরিষার গন্ধ ভাসা বিকালে মনকে ভরে তুলে। অনেক দূর থেকে সরিষা ফুলের গন্ধ নাকে বিঁধে। তখন ফুলপ্রেমিরা হলুদ বরণ বিস্তৃত সরিষার মাঠে মৌমাছির গুঞ্জন শুনে ক্ষণিকের জন্য এক স্বপ্নিল রাজ্যে হারিয়ে যায়। কারো চুলের বেনীতে আস্ত একটা সরিষা ফুলের কাণ্ড শোভা পায়। এ সময় ফুলে ফুলে মধু আহরণে মৌমাছি, প্রজাপতিরা গুঞ্জন ধরে। সরিষা ফুল থেকে প্রাকৃতিক এবং কৃত্রিম উপায়ে মধু সংগ্রহ করা হয়। শীতকালে সরিষা ফুলের মধু খুব জনপ্রিয়। সরিষার জমি অত্যন্ত উর্বরতাসম্পন্ন বলে সেখানে ধানের ফসল খুব ভালো হয়। সয়াবিন, পাম ওয়েল এর বিকল্প হিসেবে সরিষার তেল অতুলনীয়। খাঁটি সরিষার তেল থেরাপি; একটি মহৌষধ। তাই মনে বলে–
‘মাঠে করলে সরিষা চাষ
মনের শান্তি বারো মাস’।
কৃষিপ্রধান বাংলাদেশে স্বল্প সময়ের একটি শস্য সরিষা। যথাযথ সরিষা চাষে আমরা আর্থিকভাবে লাভবান হতে পারি, পরনির্ভরশীলতা কমাতে পারি এবং ভোজ্যতেলের চাহিদা মেটাতে পারি।
এম এ রাজ্জাক: সহকারী অধ্যাপক, কেশরহাট মহিলা কলেজ, মোহনপুর, রাজশাহী
আরএ/