উর্দু ও জিন্নাহ’র স্ট্যান্টবাজি
মুহাম্মদ আলী জিন্নাহ। পাকিস্তান যাকে উপাধি দিয়েছে কায়েদে আজম (মহান নেতা) ও বাবায়ে কওম (জাতির পিতা)। যদিও পাকিস্তান তাকে আদর্শ হিসাবে মানে, কিন্তু ইতিহাস সাক্ষ্য দেয় জিন্নাহ ছিলেন একজন আত্ম-অহংকারী এবং বহুরূপী। যিনি তার ব্যক্তিগত এবং রাজনৈতিক জীবনে স্ট্যান্টবাজি করেছেন।
জানাযায়, জিন্নাহর মাতৃভাষা ছিল গুজরাটি। তার পরিবার শিয়া ইসমাইলি মতের অনুসারী ছিল। আফগানিস্তানের কারাকুল টুপি ছিল জিন্নাহ'র পছন্দ। যা পরে জিন্নাহ টুপি নামে গোটা পাকিস্তানে ব্র্যান্ডে পরিনত হয়।
জিন্নাহর মাতৃভাষা ছিল গুজরাটি। অথচ ১৯৪৮ সালের ২১ মার্চ ঐতিহাসিক রেসকোর্স ময়দানে মুহাম্মদ আলী জিন্নাহ উর্দুকে সমগ্র পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা হিসেবে চাপিয়ে দিতে চেয়েছিলেন যেখানে প্রায় সাড়ে চার কোটি অর্থাৎ পাকিস্তানের মোট জনসংখ্যার ৫৬ শতাংশ জগনণের মাতৃভাষা ছিল বাংলা।
১৯৪৮ সালে পাকিস্তান সরকার বাংলাদেশকে (তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তান) ইসলামীকরণ তথা আরবিকরণের অংশ হিসেবে ঘোষণা করে যে, উর্দুই হবে পাকিস্তানের একমাত্র রাষ্ট্রভাষা, পাশাপাশি বিকল্প হিসেবে আরবি হরফে বাংলা লিখন অথবা সমগ্র পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা আরবি করারও প্রস্তাব দেওয়া হয়। অথচ ১৯৪৭ সালে দ্বিজাতি তত্ত্বের ভিত্তিতে ভাগ হওয়া 'ব্রিটিশ ভারত' পাকিস্তান ও ভারত নামে দুটি স্বাধীন রাষ্ট্রে পরিণত হয়। পাকিস্তানের ছিল দুইটি অংশ। যার এক অংশের নাম ছিল পূর্ব বাংলা। যেই নাম ১৯৫৫ সালে পূর্ব পাকিস্তান নামকরণ করা হয়। এবং অপর অংশ পশ্চিম পাকিস্তান।
এই দুই অংশের মাঝে দূরত্বের ব্যবধান ছিল দুই হাজার কিলোমিটারের অধিক। দুটি অংশের মধ্যে সাংস্কৃতিক, ভৌগোলিক ও ভাষাগত দিক থেকে অনেকগুলো মৌলিক পার্থক্য বিরাজমান ছিল। অথচ কেবল মাত্র রাজিনীতিকরণ ও ক্ষমতা কুক্ষিগত করতে এক অংশের শাসকরা শোষণের চরম সীমায় পৌঁছে গিয়েছিলেন। যার প্রভাব পড়েছিল জনগনের ভাষায়, জনগণের জীবনে ও জনগণের পেটে।
যে জিন্নাহ উর্দুকে রাষ্ট্রভাষা করতে চেয়েছিলেন সেই জিন্নাহ নিজেই আসলে উর্দু ভাষাভাষী ছিলেন না। তার মাতৃভাষা ছিল গুজরাটি। জিন্নাহ ছিলেন তার বাবা মায়ের চার পুত্র ও তিন কন্যার মধ্যে দ্বিতীয় সন্তান। তার বাবা মা দুজনেই ছিলেন গুজরাটিভাষী। তার বাবার নাম জিন্নাহভাই পুনজা ও মায়ের নাম মিঠাবাই। তার বাবা ছিলেন একজন গুজরাটি ব্যবসায়ী। গোন্ডাল রাজ্যের পিনালি গ্রামে তার পরিবারের আদিনিবাস ছিল।
তার পরিবার শিয়া ইসমাইলি মতের অনুসারী ছিল। তবে জিন্নাহ নির্দিষ্ট মতের অনুগামী ছিলেন না। তিনি সাধারণভাবে মুসলিম পরিচয় গ্রহণ করেন। বিয়ের পর জিন্নাহভাই পুনজা ১৮৭৫ সালে করাচিতে বসবাস শুরু করেন। তাদের সন্তানরা গুজরাটি ভাষার পাশাপাশি কুচি, সিন্ধি ও ইংরেজিতে কথা বলে শেখেন।
জিন্নাহ'র প্রথম স্ত্রী এমিবাই জিন্নাহ। জিন্নাহ লন্ডনে থাকার সময় তার মা ও প্রথম স্ত্রী দুজনের মৃত্যু হয়। ইংল্যান্ডে ছাত্র থাকাবস্থায় অন্যান্য ভবিষ্যত ভারতীয় স্বাধীনতা নেতৃবৃন্দের মত জিন্নাহও ১৯ শতকের ব্রিটিশ উদারতাবাদ কর্তৃক প্রভাবিত হন। পাশ্চাত্য জগৎ জিন্নাহর রাজনৈতিক চিন্তা ছাড়াও ব্যক্তিজীবনেও প্রভাব ফেলে। তিনি ভারতীয় রীতির বদলে পাশ্চাত্য ধাচের পোশাক পড়তেন। পরবর্তী জীবনে তিনি কারাকুল টুপি পড়া শুরু করেন যা “জিন্নাহ টুপি” নামে জনপ্রিয় হয়ে উঠে।
১৯১৮ সালে জিন্নাহ তার চেয়ে ২৪ বছরের ছোট দ্বিতীয় স্ত্রী রতনবাই পেটিটকে বিয়ে করেন। রতনবাই ছিলেন জিন্নাহর বন্ধু অভিজাত পারসি পরিবারের সদস্য স্যার দিনশা পেটিট'র মেয়ে। এই বিয়ে নিয়ে রতনবাইয়ের পরিবার ও পারসি সম্প্রদায় এবং মুসলিম ধর্মীয় নেতাদের মধ্যে অসন্তোষ দেখা দেয়। রতনবাই পরিবারের অমতে ইসলাম গ্রহণ করেন। এরপর তার নাম হয় মরিয়ম জিন্নাহ। এর ফলে তার পরিবার ও পারসি সম্প্রদায় তাকে ত্যাগ করে। জিন্নাহ ও রতন বাই বোম্বেতে বসবাস শুরু করেন। ১৯১৯ সালের ১৫ আগস্ট তাদের একমাত্র সন্তান দিনা জিন্নাহ জন্মগ্রহণ করেন। ১৯২৯ সালে রতনবাইয়ের মৃত্যু হয়। জিন্নাহর মেয়ে দিনা ইংল্যান্ড ও ভারতে পড়াশোনা করেছিলেন। দিনা বিয়ে করেন পারসি বংশোদ্ভূত খ্রিষ্টান নেভিল ওয়াদিয়াকে। ভিন্ন ধর্মাবলম্বীকে বিয়ে করায় জিন্নাহর সাথে তার মেয়ে দিনার সম্পর্কের অবনতি ঘটে। অথচ জিন্নাহ নিজেও ভিন্ন ধর্মাবলম্বীকে বিয়ে করেছিলেন। পিতা-কণ্যার যোগাযোগ বজায় থাকলেও দূরত্ব রয়ে যায়। জিন্নাহর মৃত্যুর পর দাফনের সময় ছাড়া দিনা আর কখনো পাকিস্তান যাননি।
জিন্নাহ'র আত্ম-অহংকারের উদাহরণ দিয়ে বোম্বে হাইকোর্টে জিন্নাহর সহকর্মী এক ব্যারিস্টার বলেছিলেন যে "নিজের প্রতি জিন্নাহর বিশ্বাস ছিল অসাধারণ"। জিন্নাহ সম্পর্কে একটি ঘটনা মনে করতে গিয়ে তিনি বলেন যে একবার বিচারক জিন্নাহকে বলেন যে “মিস্টার জিন্নাহ, মনে রাখবেন যে আপনি কোনো তৃতীয় শ্রেণীর ম্যাজিস্ট্রেটকে সম্বোধন করছেন না”। জিন্নাহর উত্তর ছিল, "মাই লর্ড, আমাকে বলার অনুমতি দিন যে আপনিও কোনো তৃতীয় শ্রেণীর উকিলকে সম্বোধন করছেন না।" এমনই জৌলুশ নিয়ে চলতেন জিন্নাহ।
ক্ষমতার দাপট, আয়ু কোনোটিই চিরস্থায়ী নয়। কিন্তু প্রকৃতির অভিশাপ, প্রকৃতির বিচার খুব ভয়ঙ্কর হয়। ১৯৪৮ সালের ১১ সেপ্টেম্বর করাচিতে নিজ বাসভবনে জিন্নাহ মারা যান। তিনি দীর্ঘদিন ধরে যক্ষা রোগে ভুগছিলেন।
জিন্নাহ চলে গেলেন, বাঙ্গালীর ইতিহাসের পাতায় হয়ে রইলেন এক কালো অধ্যায়। 'পাকিস্তান ডমিনিয়নের গভর্নর জেনারেল' জিন্নাহ হয়তো সিস্টেমের অংশ ছিলেন। তাই তাকে একা দোষ দিব না। কিন্তু 'ব্যক্তি' জিন্নাহ কি একবারও বিবেকের কাছে বাধা পাননি?? অবশ্য নাও পেতে পারেন কারন যে ব্যক্তি নিজেই সবসময় নিজের নাড়ির পরিচয়কে লুকিয়ে গেছেন, মেকি জৌলুশকে আশ্রয় করে বেঁচে ছিলেন। সেই মানুষ অন্যের মুখের ভাষার দাম নাও বুঝতে পারেন।