আইভীর নির্বাচনী সভায় নেই শামীম ওসমান
কয়েকদিন পরই নারায়ণগঞ্জ সিটি করপোরেশনের (নাসিক) নির্বাচন। সেখানে আওয়ামী লীগের নৌকা প্রতীক নিয়ে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করছেন মেয়র সেলিনা হায়াৎ আইভী। নারায়ণগঞ্জ আওয়ামী লীগ দীর্ঘদিন ধরেই দুটি গ্রুপে বিভক্ত, বিশেষ করে মেয়র আইভী এবং সংসদ সদস্য শামীম ওসমান গ্রুপ।
আগামী ১৬ জানুয়ারি নারায়ণগঞ্জ সিটি করপোরেশনের নির্বাচন। দলীয়ভাবে নির্বাচনে বিএনপি না থাকলেও তাদের প্রার্থী রয়েছেন। নারায়ণগঞ্জ সিটি করপোরেশন নির্বাচনে বিএনপি নেতা অ্যাডভোকেট তৈমুর আলম খন্দকার স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবে ভোটের মাঠে রয়েছেন।
এবারের সিটি করপোরেশন নির্বাচনেও আওয়ামী লীগের বিভেদ রয়েছে চরম পর্যায়ে। দল থেকে বর্তমান মেয়র আইভীকে নৌকা প্রতীক বরাদ্দ দেওয়ায় মাঠে নেই শামীম ওসমান। সরাসরি বিরোধিতা না করলেও তিনি যে আইভীর প্রচারণায় থাকছেন না, সেটি স্পষ্ট।
সোমবার (২০ ডিসেম্বর) সকাল ১১টায় আওয়ামী লীগ সভাপতি প্রধানমন্ত্রীর রাজনৈতিক কার্যালয়ে নারায়ণগঞ্জ জেলা ও মহানগর আওয়ামী লীগের সঙ্গে দলের কেন্দ্রীয় কার্যনির্বাহী সংসদের যৌথসভা অনুষ্ঠিত হয়। প্রায় ৪ ঘণ্টা ধরে চলা এই বৈঠকে উপস্থিত হননি নারায়নগঞ্জ-৪ আসনের সংসদ সদস্য শামীম ওসমান। তবে জেলার অন্যান্য নেতাকর্মীরা ঠিকই উপস্থিত ছিলেন। এমনকি সেলিনা হায়াৎ আইভীর বিপক্ষে যারা মনোনয়ন কিনেছিলেন তারাও ছিলেন। শুধু ছিলেন না শামীম ওসমান। তবে তার অনুসারী যারা নারায়ণগঞ্জ সিটি করপোরেশন নির্বাচনে নৌকার প্রতীক চেয়ে আবেদন করেছিলেন তাদের মধ্যে মহানগর আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক অ্যাডভোকেট খোকন সাহা, জেলা আওয়ামী লীগের সাধারেণ সম্পাদক আবু হাসনাত মো. শহীদ বাদল, মহানগর আওয়ামী লীগের সহ-সভাপতি চন্দন শীল উপস্থিত ছিলেন এবং বক্তব্য রেখেছেন। এরা তিনজনই মূলত সংসদ সদস্য শামীম ওসমানের অনুসারী বলে পরিচিত।
নারায়ণগঞ্জ সিটি করপোরেশন নির্বাচনের সমন্বয়ক ও আওয়ামী লীগের প্রেসিডিয়াম সদস্য জাহাঙ্গীর কবির নানক ও নির্বাচন পরিচালনায় দলের সমন্বয়ক হিসেবে কাজ করছেন।
নারায়ানগঞ্জ সিটি করপোরেশন নির্বাচনের সমন্বয়ক জাহাঙ্গীর কবির নানক এর সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত সভায় উপস্থিত ছিলেন নারায়ণগঞ্জ সিটি কর্পোরেশন নির্বাচন পরিচালনা টিমের সদস্য সচিব ও বাংলাদেশে আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক মির্জা আজম। সভায় আরও উপস্থিত ছিলেন সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য আব্দুর রহমান, যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক আ ফ ম বাহাউদ্দিন নাছিম, সাংগঠনিক সম্পাদক আহমদ হোসেন, বিএম মোজাম্মেল হক, মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক সম্পাদক মৃণাল কান্তি দাস, দপ্তর সম্পাদক বিপ্লব বড়ুয়া, নারায়নগঞ্জ-২ আসনের সংসদ সদস্য নজরুল ইসলাম বাবু, মহিলা বিষয়ক সম্পাদক মেহের আফরোজ চুমকি, শিক্ষা বিষয়ক সম্পাদক শামসুন্নাহার চাপা, উপদপ্তর সম্পাদক সায়েম খান, কেন্দ্রীয় সদস্য আনোয়ার হোসেন, শাহাবুদ্দিন ফরাজী, এ বি এম রিয়াজুল কবির কাওসার, নারায়ণগঞ্জ জেলা ও মহানগর আওয়ামী লীগ নেতারা মেয়র প্রার্থী আইভী।
সভায় উপস্থিত জেলা ও মহানগর আওয়ামী লীগের নেতাদের বক্তব্যে নারায়ণগঞ্জে দলের বিভেদের চিত্র স্পষ্টত ফুটে ওঠে। জেলা আওয়ামী লীগের নেতারা বলেন, নারায়ণগঞ্জ আওয়ামী লীগের দুর্গ কিন্তু আমাদের নিজেদের মধ্যে বিভেদ থাকার কারণে বিএনপি-জামায়াত সুযোগ নেয়। এবার সিটি করপোরেশন নির্বাচনে শামীম ওসমানকে সরাসরি মাঠে চান তার। যদিও নির্বাচনী আচারণ বিধির কারণে তিনি মাঠে থাকতে পারবেন না। তবে তার সমর্থন মেয়র আইভীর জন্য প্রয়োজন বলে মনে করেন জেলা ও মহানগর আওয়ামী লীগের নেতারা।
জেলা ও মহানগর আওয়ামী লীগের নেতাদের বক্তব্যের এক ফাঁকে নির্বাচন পরিচালনা কমিটির সদস্য সচিব ও আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক মির্জা আজম বলেন, 'নারায়ণগঞ্জ সব সময়ই আওয়ামী লীগের ঘাঁটি। এখানে আপনারা কেন নৌকার বিজয় নিয়ে সংশয় প্রকাশ করছেন। আপনারা ঐক্যবদ্ধ থাকলে কেউ নৌকাকে হারাতে পারবে না।'
সেলিনা হায়াৎ আইভী বলেন, 'আমি সব সময় জেলা আওয়ামী লীগের সকল সম্মেলনে উপস্থিত ছিলাম। আজকে যারা আমার সঙ্গে নৌকা চেয়েছিলেন তাদের মধ্যে ‘খোকন কাকা, বাদল ভাই, চন্দন শীল দাদা আমরা প্রত্যেকে কিন্তু এক সঙ্গে মিলে কাজ করেছি, জেলা আওয়ামী লীগের জন্য এবং নগর আওয়ামী লীগের জন্য। আমাদের মধ্যে কোন বিভাজন, কোন কিছুই ছিল না। কিন্তু হঠাৎ করেই ২০০৯ সাল এর পর থেকে আমাদের মধ্যে একটু দূরত্ব সৃষ্টি হয়। সেটা হতেই পারে, বিভিন্ন কারণে হয়েছে। কিন্তু কখনও আমি কোন দিন কারো বিপক্ষে একটি শব্দও উচ্চারণ করিনি। আমি নেত্রীর নির্দেশ অনুযায়ী আমার মতো করে নারায়ণগঞ্জ পৌরসভায় কাজ করেছি।'
তিনি আরও বলেন, '২০১১ সালে যখন সিটি কর্পোরেশন হল, তখন আমি প্রার্থী ছিলাম। তখন নেত্রীর দোয়া নিয়ে আমি প্রার্থী হয়েছি। নেত্রীর দোয়া ছিল বলে ফ্রি এবং ফেয়ার নির্বাচন হয়েছিল বলে আজকে এখানে দাঁড়িয়ে কথা বলতে পারছি। আমি দলের প্রতি কৃতজ্ঞ, কৃতজ্ঞ আমার নেত্রীর প্রতি, যে উনি আমার প্রতি আস্থা রেখেছিলেন। আমি বিজয়ী হয়েছিলাম ২০১১ সালে। তখনও অনেকে গিয়েছিলেন পক্ষে-বিপক্ষে কিন্তু আমি জয়যুক্ত যখন হয়েছি সকলে আমাকে সহযোগিতা করেছিল। আমি কখনো কোনোদিনও দলের বাইরে কোনো কর্মকাণ্ড করিনি। কাউকে হতাশ করিনি। যে কোনো ব্যক্তি যখন আমার প্রতি বিমুখ হয়েছে, আমি নীরব থেকেছি, নিজেকে গুটিয়ে রেখেছি। আমার শেষ ঠিকানা এই দল।'
নেতৃত্বের প্রতিযোগিতা দীর্ঘ এক বছর যাবৎ নারায়ণগঞ্জে চলছে। মেয়র নির্বাচনের এক বছর আগে থেকেই চলছে এই বিভেদ। এখানে কথা বার্তায় বিভেদ না হলেও ছন্দ পতন হয়েছে। কিছুটা তিক্ততা হয়েছে। এই তিক্ততা দূর করে ঐক্যবদ্ধ হওয়ার আহ্বান জানান ওই নেতা।
২০১১ সালে সেলিনা হায়াৎ আইভী প্রথম নারায়ণগঞ্জ সিটি কর্পোরেশনের মেয়র নির্বাচিত হন। সেই বছর সেলিনা হায়াৎ আইভীর বিপক্ষে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করে হেরে যান শামীম ওসমান। তখন থেকেই মূলত বিভেদের শুরু। কখনো প্রকাশ্যে কখনো টিভি টক শোতে বসে দুজন দুজনকে দেখে নেওয়ার হুমকিও দিয়েছেন। এবার যখন নারায়াণগঞ্জ সিটি করপোরেশন নির্বাচনের তফসিল ঘোষণা হয়েছে তখন থেকেই আবার বিরোধের বিষয়টি সামনে আসে। নৌকার টিকিট পেতে শামীম ওসমানের অনুসারিদের মনোনয়ন ফরম তোলান।
সোমবারের সভায় দলীয় ফোরামে অধিকাংশ নেতাই বলেন, নারায়ণগঞ্জে চরম বিভেদ সৃষ্টি হয়েছে। কেন্দ্রীয় নেতাদের উদ্দেশে বলেন আপনারা আজকে আমাদের ঐক্য করে দেন আমরা নৌকাকে বিজয়ী করব ইনশাআল্লাহ। পরে পরিস্থিতি বুঝে নির্বাচন পরিচালনা কমিটির সমন্বয়ক অ্যাডভোকেট জাহাঙ্গীর কবির নানক দলীয় প্রধান ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে ভিডিও কল এর মাধ্যমে যুক্ত করে উপস্থিত নেতাকর্মীদের নেত্রীর নির্দেশ পৌছে দেন। ভিডিও কল এ আওয়ামী লীগ সভাপতি ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেন, ‘নেতা-কর্মী একসঙ্গে কাজ করতে হবে। এখানে কোনো ভেদাভেদ চাই না। সবাই এক হয়ে কাজ করতে হবে, নৌকাকে জেতাতে হবে। একটাই কথা, নৌকাকে জেতাতে হবে। হয়তো কারও পছন্দ আছে কারও পছন্দ নাই এরকম থাকতে পারে; কিন্তু একজনই তো নমিনেশন পাবেন। কাজেই আমরা একজনকে দিয়েছি, সবাইকে নৌকার পক্ষ কাজ করতে হবে। নৌকাকে জেতাতে হবে।’ নেতা-কর্মীদের একসঙ্গে কাজ করতে হবে। এখানে কোনো ভেদাভেদ চাই না। সবাইকে এক হয়ে কাজ করতে হবে, নৌকাকে জেতাতে হবে। একটাই কথা, নৌকাকে জেতাতে হবে। হয়তো কারও পছন্দ আছে কারও পছন্দ নেই এরকম থাকতে পারে; কিন্তু একজনই তো নমিনেশন পাবেন। কাজেই আমরা একজনকে দিয়েছি, সবাই নৌকার পক্ষ কাজ করতে হবে। নৌকাকে জেতাতে হবে।’
পরে উপস্থিত নেতাকর্মীরা নেত্রীকে নৌকা নৌকা স্লোগান দিয়ে বিজয় উল্লাস করেন।
এবার নারায়নগঞ্জ সিটি করপোরেশন নির্বাচনে মোট ৬জন প্রার্থী প্রতিদ্বন্দ্বিতা করছেন। সোমবার (২০ ডিসেম্বর) দুপুরে জেলা প্রশাসকের কার্যালয় প্রাঙ্গণে বৈধ প্রার্থীদের নাম ঘোষণা করেন জেলা নির্বাচন কর্মকর্তা মতিয়ুর রহমান। তিনি জানান, মনোনয়নপত্র যাচাই-বাছাই শেষে বৈধ প্রার্থীরা হলেন- আওয়ামী লীগের সেলিনা হায়াৎ আইভী, বাংলাদেশ কল্যাণ পার্টির যুগ্ম মহাসচিব রাশেদ ফেরদৌস, ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশের মাসুম বিল্লাহ্, বাংলাদেশ খেলাফত আন্দোলনের জসিম উদ্দিন, বাংলাদেশ খেলাফত মজলিশের এবিএম সিরাজুল মামুন। তা ছাড়া বিএনপি অংশ না নেওয়ায় জেলা বিএনপির আহ্বায়ক তৈমুর আলম খন্দকার স্বতন্ত্র প্রার্থীর ব্যানারে ভোটের লড়াইয়ে থাকছেন। এবার মেয়র পদে আটজন, সংরক্ষিত কাউন্সিলর পদে ৩৬ জন এবং সাধারণ কাউন্সিলর পদে ১৬৬ জন মনোনয়নপত্র জমা দিয়েছিলেন। কাউন্সিলরদের মনোনপত্র এখনও চূড়ান্ত হয়নি।
এসএম/এসএ/এমএমএ/