সংঘাতের পথে রাজনীতি
প্রতিকূল পরিস্থিতিতেও আন্দোলনে থাকবে বিএনপি
আবারও উত্তপ্ত হয়ে উঠছে দেশের রাজনৈতিক পরিস্থিতি। রীতিমতো সংঘাতের দিকে যাচ্ছে রাজনীতি। এতদিন আওয়ামী লীগ ও বিএনপির শীর্ষ নেতারা একে অন্যের বিরুদ্ধে ঝাঁঝালো বক্তব্য দিলেও এখন সেটি রাজপথে সংঘর্ষে রূপ নিয়েছে। এরই মধ্যে ভোলা, নারায়ণগঞ্জ ও মুন্সীগঞ্জসহ দেশের বিভিন্ন এলাকায় বিএনপি নেতা-কর্মীদের সঙ্গে পুলিশ ও ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের নেতা-কর্মীদের সংঘর্ষের ঘটনা ঘটেছে। এখন পর্যন্ত ৪ জনের প্রাণহানিও হয়েছে। আহত হয়েছেন অনেকে। এসব সংঘর্ষে পুলিশ সদস্যরাও আহত হয়েছেন।
হঠাৎ করেই উত্তপ্ত হয়ে উঠা রাজনৈতিক অস্থিরতার এই পরিস্থিতিতে বিএনপি নেতারা বলছেন, দলের নেতা-কর্মীরা যাতে মাঠে নামতে না পারে সেজন্য ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ পুলিশকে ব্যবহার করে এখন নেতা-কর্মীদের গ্রেপ্তার করছে। হামলা করছে, মামলা দিচ্ছে। এতে নেতা-কর্মীদের মধ্যে আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়েছে। গ্রেপ্তারের ভয়ে অনেকে ঘরবাড়ি ছাড়া। গ্রেপ্তার এড়াতে স্থানীয় নেতা-কর্মীদের অনেকেই ঢাকায় অবস্থান করছেন। যারা এলাকায় অবস্থান করছেন তারাও রাতে বাড়িতে ঘুমাতে পারছেন না। এমনকি তৃণমূলের সক্রিয় নেতা-কর্মীদের তালিকা করে তাদের বাসায় প্রতিদিন আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যরা অভিযান চালাচ্ছে বলে অভিযোগ বিএনপি নেতা-কর্মীদের।
দলটির নীতিনির্ধারকরা মনে করছে, আন্দোলনকে সামনে রেখে চাপে রাখার কৌশল হিসেবে রাজপথে বিএনপির সক্রিয় নেতা-কর্মীদের টার্গেট করে নতুন নতুন মামলা দেওয়া হচ্ছে। গ্রেপ্তার করা হচ্ছে, হামলা করা হচ্ছে। জামিন নামঞ্জুর করে কারাগারে পাঠানো হচ্ছে। নেতা-কর্মীদের বাড়িতে বাড়িতে হামলা ও হুমকি দেওয়া হচ্ছে। পুরোনো মামলায় ‘অজ্ঞাতনামা’ আসামির স্থানে নাম ঢুকিয়ে গ্রেপ্তার দেখানো হচ্ছে। দ্রুতগতিতে দেওয়া হচ্ছে বিভিন্ন মামলার চার্জশিটও। একই গতিতে চলছে বিচার কাজও।
সংশ্লিষ্টদের মতে, বিএনপি যখন আন্দোলনের প্রস্তুতি ও দল গোছানোর কাজ শুরু করেছে ঠিক সেই মুহূর্তে সরকার পরিকল্পিতভাবে বিএনপি নেতা-কর্মীদের মামলা জালে আটকানোর কৌশল নিয়েছে। সাম্প্রতিক সংঘর্ষে কারা জড়িত তা নিশ্চিত হওয়ার আগেই নেতা-কর্মীদের নামে মামলা দেওয়া হচ্ছে। অনেক এলাকায় মামলার আগেই নেতা-কর্মীদের আটক করা হচ্ছে। যাদের নামে মামলা নেই তাদেরও আটক করে এসব মামলায় গ্রেপ্তার দেখানো হচ্ছে।
ভোলায় পুলিশ ও বিএনপি নেতা-কর্মীদের মধ্যে সংঘর্ষের ঘটনায় দুটি মামলায় আসামি করা হয়েছে প্রায় ৪০০ জনকে। মামলার খবর সর্বত্র ছড়িয়ে পড়লে গ্রেপ্তার আতঙ্কে বরিশাল শেবাচিম হাসপাতালে ভর্তিরত চিকিৎসাধীন বিএনপির ১৬ নেতা-কর্মী হাসপাতাল থেকে পালিয়ে যান। এ ছাড়া পুলিশ-বিএনপি সংঘর্ষের ঘটনায় পুলিশ ও নিহত যুবদল কর্মী শাওনের বড় ভাইয়ের পৃথক পৃথক দুটি মামলায় নারায়ণগঞ্জ জেলা ও মহানগর বিএনপি ও অঙ্গসংগঠনের নেতা-কর্মীদের মধ্যে মামলা ও গ্রেপ্তার আতঙ্ক বিরাজ করছে। তাই অধিকাংশ নেতা-কর্মী এলাকা ছেড়ে চলে গেছেন বলে জানা গেছে।
অবশ্য ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের নেতারা বিএনপির এসব অভিযোগ মানতে নারাজ। তারা বলছেন, কারও বিরুদ্ধে সুনির্দিষ্ট অভিযোগ বা মামলা থাকলে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী তাকে গ্রেপ্তার করতেই পারে। আর আইন অনুযায়ী মামলার বিচারকাজ চলছে। এখানে সরকারের কোনো হস্তক্ষেপ বা বিএনপিকে চাপে রাখার কৌশল নেই। যদিও আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের সম্প্রতি হুঁশিয়ারি দিয়ে বলেছেন, আন্দোলনের নামে কেউ জ্বালাও-পোড়াও করলে ছাড় দেওয়া হবে না।
জানতে চাইলে বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য ড. খন্দকার মোশাররফ হোসেন ঢাকাপ্রকাশ-কে বলেন, সরকার একটা উদ্দেশ্য নিয়ে এসব ঘটনা ঘটাচ্ছে। নানা ব্যর্থতা আড়াল করা ও বিএনপিকে চাপে রাখার কৌশল হিসেবে সহিংসতাকে উসকে দিয়েছে। বিএনপির নেতা-কর্মীদের নামে মামলা এবং তাদের গ্রেপ্তার করার মধ্য দিয়ে সরকারের উদ্দেশ্য স্পষ্ট হয়ে যাচ্ছে।
বিএনপির স্থায়ী কমিটির আরেক সদস্য গয়েশ্বর চন্দ্র রায় ঢাকাপ্রকাশ-কে বলেন, চলমান সরকারবিরোধী আন্দোলনকে সামনে রেখে বিএনপিকে চাপে রাখার কৌশল হিসেবে সরকার ব্যাপক ধরপাকড় শুরু করেছে। দেশব্যাপী প্রতিদিনই বিএনপি এবং এর অঙ্গ ও সহযোগী সংগঠনসহ বিরোধীদলীয় নেতা-কর্মীদের গ্রেপ্তার করা হচ্ছে, নতুন নতুন মামলা দায়ের করা হচ্ছে। অজ্ঞাত মামলায় কোনো কারণ ছাড়াই পুলিশ আমাদের অসংখ্য নেতা-কর্মীকে গ্রেপ্তার করছে। সক্রিয় নেতাদের টার্গেট করে নতুন নতুন মামলা দেওয়া হচ্ছে। রাজনৈতিক কোনো কর্মসূচিতে অংশগ্রহণ না থাকলেও নতুন মামলা থেকে রেহাই পাচ্ছেন না বিএনপির নেতা-কর্মীরা। মামলার জালে জড়িয়ে অনেক নেতা-কর্মীই বাড়ি ছাড়া।
তিনি আরও বলেন, সরকারের কর্মকাণ্ড দেখে মনে হচ্ছে তারা আবারও একতরফা একটি নির্বাচন করার পাঁয়তারা শুরু করেছে। কিন্তু এবারের প্রেক্ষাপট ২০১৪ ও ২০১৮ সালের মতো নয়। এবার একতরফা নির্বাচনের স্বপ্ন তাদের পূরণ হবে না।
বিএনপির সিনিয়র যুগ্ম মহাসচিব রুহুল কবির রিজভী ঢাকাপ্রকাশ-কে বলেন, সরকার রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে বিএনপির সক্রিয় নেতাদের টার্গেট করে নতুন নতুন মামলা দিচ্ছে। নেতা-কর্মীদের মাঝে ভীতি সৃষ্টির লক্ষ্যে জনগণ থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে তারা আবারও দেশে একটি একদলীয় নির্বাচন করার পাঁয়তারা করছে। মামলা-হামলা করে ক্ষমতাকে দীর্ঘায়িত করা যাবে না। জনগণ এবার তাদের ভোটাধিকার রক্ষায় কোনো ছাড় দেবে না।
তিনি আরও বলেন, সরকার বিএনপির আন্দোলনকে প্রশ্নবিদ্ধ রাখতেই এসব ষড়যন্ত্র করছে। প্রতিকূল পরিস্থিতিতেও আন্দোলন চালিয়ে যাবে বিএনপি।
এদিকে মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বলেছেন, বিএনপির চলমান আন্দোলনে ভীত হয়ে দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চল পর্যন্ত পুলিশ বিএনপিসহ বিরোধীদলীয় নেতা-কর্মীদের ব্যক্তিগত তথ্য সংগ্রহ করার নামে হয়রানি করছে এবং দেশে বিরাজমান ভয়ের পরিস্থিতিকে আরও আতঙ্কগ্রস্ত করে তুলছে।
তিনি বলেন, বিএনপি এবং অঙ্গসংগঠনগুলোর কমিটির তালিকা সংগ্রহ করছে পুলিশ। এ ধরনের কর্মকাণ্ড বাংলাদেশ সংবিধান ফৌজদারী কার্যবিধি পুলিশ আইন বা পুলিশবিধি কিংবা অন্য কোনো আইন দ্বারা কোনোভাবেই সমর্থনযোগ্য নয়। পুলিশের এ ধরনের কার্যক্রম একদিকে যেমন নাগরিকের গোপনীয়তার অধিকার ক্ষুণ্ন করছে তেমনি নাগরিকের আইনি অধিকার ভোগ করা এবং তার ব্যক্তি স্বাধীনতার উপর নগ্ন হস্তক্ষেপ বলে প্রতীয়মান হয়, যা সংবিধানের ৩১, ৩২ এবং ৪৩ অনুচ্ছেদের সুস্পষ্ট লঙ্ঘন।
মির্জা ফখরুল আরও বলেন, নেতা-কর্মীদের পেশা, সন্তান-সম্পত্তির বিবরণসহ ১৪ গোষ্ঠীর যাবতীয় বিষয়ে পুলিশের তথ্য সংগ্রহ দেশে বিরাজমান আতঙ্কের পরিস্থিতিকে ভয়াবহ করে তুলছে। বিএনপি এই অবস্থার অবসান চায়। আমরা পুলিশ কর্তৃপক্ষকে আহ্বান জানাচ্ছি, এভাবে সাধারণ নাগরিক, রাজনৈতিক কর্মীদের হয়রানি বন্ধ করে দেশে গণতান্ত্রিক পরিবেশ সৃষ্টি করে সাংবিধানিক দায়িত্ব পালন করবেন।
এনএইচবি/এসজি