চূড়ান্ত আন্দোলনের রূপরেখা নিয়ে সিদ্ধান্তহীনতায় বিএনপি!
চূড়ান্ত আন্দোলন নিয়ে সিন্ধান্ত নিতে পারছে না বিএনপি। সরকার হটাতে চূড়ান্ত আন্দোলন করতে হবে এই বিষয়টি নিশ্চিত হলেও সেই আন্দোলন কতদিনের হবে, কবে আন্দোলন শুরু করতে হবে সেসব নিয়ে সিদ্ধান্ত নিতে পারছেনা দলটি।
সূত্র জানায়, সম্প্রতি দলের স্থায়ী কমিটির বৈঠকে চূড়ান্ত আন্দোলনের কর্মসূচির খসড়া নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা হয়েছে। ঈদুল আজহার পর চূড়ান্ত ধাপে ঢাকা অভিমুখে কর্মসূচির পক্ষে মত দেন নেতারা। সেক্ষেত্রে ঢাকা ঘেরাও, ঢাকামুখী রোডমার্চ, ঢাকায় অবস্থান কর্মসূচি দেওয়া যেতে পারে বলে জানান তারা। তবে সরকারবিরোধী সমমনা দলসহ বিভিন্ন পর্যায় থেকে নতুন কর্মসূচি হিসাবে ঢাকা থেকে বিভাগ অভিমুখে রোডমার্চের প্রস্তাব দিলেও তাতে আগ্রহ দেখায়নি দলটির নীতিনির্ধারকরা।
জানা যায়, নতুন কর্মসূচি নিয়ে ফের রাজপথে নামছে বিএনপি। সেক্ষেত্রে আগামী ২০ মে ৬৪ জেলাতেই একযোগে কর্মসূচি পালন করার নীতিগত সিদ্ধান্ত নিয়েছে দলটির হাইকমান্ড। শুরুর দিকে প্রতি শনিবার এ কর্মসূচি পালন করা হবে। আগামীকাল শনিবার (১৩ মে) ঢাকায় এক বিক্ষোভ সমাবেশ থেকে নতুন এ কর্মসূচির ঘোষণা আসতে পারে।
বিএনপি স্থায়ী কমিটির সদস্য গয়েশ্বর চন্দ্র রায় ঢাকাপ্রকাশ-কে বলেন, আন্দোলন সফল করার জন্য যা প্রয়োজনীয়, যে কর্মসূচি প্রয়োজন সেটাই দেওয়া হবে। কারণ, আন্দোলন না করলে কেউ আমাদের পাশে আসবে না। আন্দোলন-গণঅভ্যুত্থান কখনো দিন-তারিখ ঠিক করে হয় না। আন্দোলন মাঠে গড়ালে জনগণই এর পরিণতি ঠিক করে দেবে। সুতরাং সফল আন্দোলনের জন্য দিন, মাস, মৌসুম এগুলো কোনো বিষয় নয়।
খোঁজ নিয়ে জানা যায়, সরকার হটানোর লক্ষ্যে নতুন কর্মসূচিগুলো হবে যুগপৎ। তবে আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচন সামনে রেখে এই ধাপের আন্দোলন আর কত দিন চলবে, বা চূড়ান্ত আন্দোলনের মোক্ষম সময়টি কখন সে জায়গায় এখনো স্থির সিদ্ধান্তে পৌঁছাতে পারেননি দলটির হাইকমান্ড। তবে এই মুহূর্তে বিএনপির নীতিনির্ধারকদের লক্ষ্য ধীরে ধীরে কর্মসূচির ধার বাড়ানো। যাতে কেন্দ্র থেকে মাঠের কর্মী-সমর্থক পর্যন্ত আন্দোলনের একটি ঢেউ তৈরি হয়। বিশেষ করে, গত নভেম্বর-ডিসেম্বরে সারা দেশে বিভাগীয় সমাবেশগুলোকে কেন্দ্র করে নেতা-কর্মীদের মধ্যে যে ত্যাগী মনোভাব প্রদর্শিত হয়েছিল, আবার সে রকম আন্দোলনমুখী পরিবেশ সৃষ্টি করতে চান বিএনপির নীতিনির্ধারকেরা।
কিছুটা ভিন্নমতও আছে। কতিপয় কিছু জায়গা ছাড়া সারাদেশেই মাঠপর্যায়ে নেতা-কর্মীরা এবার তড়িঘড়ি করে আন্দোলনে যেতে অপ্রস্তুত। তৃণমূল নেতা-কর্মীদের ভাষ্য, আন্দোলনের ঘাটতি রাজধানী ঢাকায় এবং আন্দোলনের সূতিকাগার ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে। এই দুই জায়গায় আন্দোলন দানা না বাঁধলে সে আন্দোলন বেশি দূর যাবে না। ফলে ঘটা করে বিভাগে বিভাগে রোডমার্চ না করে নীতিনির্ধারকদের এ দুটি জায়গায় দৃষ্টি দরকার।
সংশ্লিষ্ট নেতাকর্মীরা মনে করছেন, ক্ষমতার বাইরে যাওয়ার পর গত ১৫ বছরে রাজধানীতে শক্তিশালী আন্দোলন গড়ে তুলতে পারেনি বিএনপির হাইকমান্ড। বারবার কমিটি বদল করলেও দলটি সাংগঠনিক দুর্বলতা কাঠিয়ে উঠতে পারছে না। ২০১৪ সালে সারাদেশের সব জেলা ও মহানগর আন্দোলনকারী বিএনপি নেতাকর্মীর দখলে থাকলেও ঢাকায় ছিল ভিন্ন চিত্র। দলের কেন্দ্রীয়, মহানগর, থানা ও ওয়ার্ডের নেতাকর্মীর কেউ রাজপথ বা পাড়া-মহল্লায় পিকেটিং করেনি। সারাদেশ থেকে বিচ্ছিন্ন থাকলেও ঢাকায় আন্দোলন না জমায় সরকারকে দাবি আদায়ে বাধ্য করা যায়নি।
দলটির মাঠ পর্যায়ের নেতাদের অভিযোগ, এবারও আন্দোলনে প্রায় একই চিত্র দেখা গেছে। ঢাকার বাইরের বিভাগীয় সমাবেশগুলোতে ব্যাপক অংশগ্রহণ ছিল। স্ব-স্ব মহানগরের নেতাকর্মী ও সাধারণ মানুষ কর্মসূচিতে অংশ নিয়ে সফল করেছে। তবে রাজধানীতে দলের সাংগঠনিক দুর্বলতার কারণে তা আশানুরূপ হয়নি। আগামী দিনে সরকার পতনের এক দফা আন্দোলনে রাজপথে ঢাকার নেতাকর্মী ও সাধারণ মানুষের অংশগ্রহণ বাড়ানোই দলটির জন্য এক বড় পরীক্ষা বলে জানান নেতারা।
বিএনপিসহ যুগপৎ আন্দোলনে যুক্ত বিভিন্ন দল ও জোটের শীর্ষস্থানীয় একাধিক নেতার সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, কর্মসূচির এই পর্বে শুরুটা হবে বিক্ষোভ, মানববন্ধন, অবস্থান কর্মসূচি বা সারা দেশে বড় সমাবেশ দিয়ে। এরপর এক বিভাগ থেকে অন্য বিভাগে রোডমার্চ; এ ধরনের কর্মসূচির কথা ভাবা হচ্ছে। কর্মসূচি ধারাবাহিকভাবে কিছুদিন টেনে নেওয়া হবে। এরপর চূড়ান্ত পর্যায়ে রাজধানী ঢাকায় অবস্থান কর্মসূচির ঘোষণা থাকবে।
তবে এই পর্বটি কখন, সেটি নিয়ে নীতিনির্ধারকেরা নানা হিসাব-নিকাশে দোটানায় রয়েছেন। ২০২৩ সালের ডিসেম্বর বা ২০২৪ সালের জানুয়ারি মাসের শুরুর দিকে দ্বাদশ জাতীয় নির্বাচন হবে। সময় আছে আট মাসেরও কম। আবহাওয়ার হিসাবে, মধ্য জুন থেকে জুলাই মাস বর্ষার মৌসুম। জুন মাসের শেষ দিকে আছে ঈদুল আজহা। ফলে বর্ষা ও ঈদের ছুটিছাটায় কেটে যাবে এই দুই মাস। এরপর আগস্ট মাস। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের শাহাদতের মাস আগস্টজুড়ে থাকবে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের শোকের কর্মসূচি। বরাবরই এই সময়টাকে, অর্থাৎ আগস্ট মাসকে এড়াতে চায় বিএনপি। এরপরে সময় থাকে সেপ্টেম্বর-অক্টোবর—মাত্র দুই মাস। হিসাব অনুযায়ী, নভেম্বরেই তফসিল ঘোষণা করতে হয়।
গণতন্ত্র মঞ্চের একটি দল বাংলাদেশের ওয়ার্কার্স পার্টির সাধারণ সম্পাদক সাইফুল হক ঢাকাপ্রকাশ-কে বলেন, আন্দোলনের যে উত্তাপ তৈরি হয়েছিল, সেটা স্তিমিত হয়ে গেছে। নতুন কর্মসূচির মধ্য দিয়ে খেলাটা আবার গরম করা, আন্দোলনের আবহাওয়াটা তৈরি করা। সেই চেষ্টা সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার পাবে।
এদিকে বর্তমান সরকার ও নির্বাচন কমিশনের অধীনে কোনো নির্বাচনে না যাওয়ার সিদ্ধান্ত বিএনপিসহ সমমনা রাজনৈতিক দলগুলোর। অভিন্ন দাবিতে ডিসেম্বর থেকে সরকারের বিরুদ্ধে যুগপৎ আন্দোলনও করছেন তারা। কিন্তু আসন্ন পাঁচ সিটি করপোরেশন নির্বাচনে কাউন্সিলর পদে বিএনপির অন্তত দুইশ নেতাকর্মী ভোটে অংশ নেওয়ায় অনেকটা বিব্রত সমমনা দলগুলো। নেতারা মনে করছেন, দলীয় প্রতীক না থাকলেও গুরুত্বপূর্ণ পদে থাকা নেতারা নির্বাচনে অংশগ্রহণ করলে রাজনৈতিক দিক থেকে বিভ্রান্তির জায়গা তৈরি করবে। এটা সরকারি দলকে কিছু বাড়তি সুবিধাও দেবে। কেন্দ্রের সিদ্ধান্তের বাইরে গিয়ে যারা ভোটের মাঠে রয়েছেন, তাদের ব্যাপারে বিএনপির কঠোর সিদ্ধান্ত নিতে হবে। না হলে সরকারবিরোধী আন্দোলনে নেতিবাচক প্রভাব পড়ার আশঙ্কা করছেন যুগপৎ আন্দোলনে থাকা দলগুলোর নেতারা।
১২ দলীয় জোটের অন্যতম শরিক বাংলাদেশ এলডিপির মহাসচিব শাহাদাত হোসেন সেলিম ঢাকাপ্রকাশ-কে বলেন, ভোটে না গিয়ে বরং ভোটকে অকার্যকর করা বা নিরুৎসাহিত করা, ভোটের প্রতি মানুষের যে অনীহা, তাদের (বিএনপির স্থানীয় নেতাদের) সেটার প্রতি একাত্মতা ঘোষণা করা দরকার। কারণ, এখন তো নির্বাচনে ভোটই কাস্টিং হয় ১২ থেকে ১৪ শতাংশ। এ ভোটটাকে অবশ্যই বর্জন করা উচিত। আমরা আশা করব, তারা প্রত্যেকে দলের সিদ্ধান্তের প্রতি শ্রদ্ধা প্রদর্শন করবেন এবং কেউই ভোটে অংশগ্রহণ করবেন না।
কিছুটা বিরতি দিয়ে ফের মাঠে নামছে বিএনপি। বিএনপি ও অঙ্গ-সংগঠনের নেতাকর্মীরা আন্দোলনের প্রস্তুতি নিতে শুরু করেছেন। তবে বাধা হয়ে দাঁড়াচ্ছে পুরোনো মামলা। গত কয়েক দিনে একাধিক মামলায় আদালত জামিন না দেওয়ায় সারাদেশে পাঁচ শতাধিক নেতাকর্মীকে কারাগারে যেতে হয়েছে। তারা এতদিন উচ্চ আদালতের জামিনে ছিলেন। বিষয়টি বিএনপি মেনে নিতে পারছে না। ফলে কেন্দ্রীয় নেতারাও উদ্বগ্নি হয়ে পড়েছেন।
যুগপৎ আন্দোলনের যৌথ ঘোষণাপত্রের ঘোষণা আপাতত হচ্ছে না। গণতন্ত্র মঞ্চ থেকে গণঅধিকার পরিষদের বেরিয়ে যাওয়ার পেছনে সরকারের ইন্ধন রয়েছে বলে অন্যান্য শরিকরা সন্দেহ করলেও বিএনপির নীতিনির্ধারকরা সে রকম ভাবছেন না। তারা বলেন, গণতন্ত্র মঞ্চের সঙ্গে গণঅধিকার পরিষদের মনোমালিন্যের কারণে এটি হয়েছে। এর পেছনে বিএনপির কোনো ভূমিকা নেই। কারণ গণতন্ত্র মঞ্চ একটি আলাদা জোট। তবে জোট থেকে বেরিয়ে গেলেও যুগপৎ আন্দোলনে থাকবে গণঅধিকার পরিষদ।
দলের বেশিরভাগ নেতাকর্মী চান না বলেই গণতন্ত্র মঞ্চ থেকে বেরিয়ে গেছেন বলে দাবি করেছেন গণঅধিকার পরিষদের সদস্য সচিব ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রীয় ছাত্র সংসদের (ডাকসু) সাবেক ভিপি নুরুল হক নূর। তিনি বলেন, গণআন্দোলন গড়ে তোলার কাজটাকেই আমরা এখন বেশি গুরুত্ব দিচ্ছি। গণতন্ত্র মঞ্চে থেকে এটা সম্ভব নয়। আমরা ছয়টি দলের মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকতে চাই না। আরও বৃহত্তর পরিসরে কাজ করতে চাই। সেই কাজ করার সুযোগও আমাদের রয়েছে।
নূর আরও বলেন, আমরা মনে করি গণতন্ত্র মঞ্চে থাকায় আমাদের পরিধি ছোট হয়ে আসছিল। কাজ করার ক্ষমতাও সীমিত হয়ে আসছিল। নিজেদের কাজের পরিধি বাড়াতেই, কিংবা বলা যেতে পারে আরও বৃহত্তর পরিসরে কাজ করার লক্ষ্য নিয়েই আমরা গণতন্ত্র মঞ্চ ছেড়েছি।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক বিএনপির একজন দায়িত্বশীল ভাইস চেয়ারম্যান ঢাকাপ্রকাশ-কে বলেন, যতদিন পযন্ত জেলা বিএনপির নেতৃত্ব থেকে পুরোপুরিভাবে কেন্দ্রীয় নেতাদের অপসারণ করা না যাবে ততদিন পর্যন্ত জেলা পযায়ে আন্দোলন তার চূড়ান্ত সফলতায় পৌছাবে না। কারণ জেলার নেতাদের রাজনীতে জেলায় নেতাকর্মীদের সময় দিতে হয়; কিন্তু আমাদের দলের অধিকাংশ কেন্দ্রীয় নেতারা যারা ঢাকায় অবস্থান করছেন স্বপরিবারে তারাই আবার অধিকাংশ জেলা বিএনপির কমিটির নেতৃত্বে পদ আকড়ে আছেন। ফলে আন্দোলন কর্মসূচি বাস্তবায়ন সংশ্লিষ্ট নেতারা ঘরে ফিরতে আসা-যাওয়ার মধ্যেই সীমাবদ্ধ হয়ে যাচ্ছে।
আরইউ/এএস