‘সামরিক ও স্বৈরশাসকরা সংসদকে অকার্যকর করে ফেলে’
সরকারি দলের সংসদ সদস্যরা বলেছেন, স্বৈরাচারী সরকার সংসদীয় রীতিনীতি ধ্বংস করে দিয়েছিল। জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান সংবিধান প্রণয়নের পাশাপাশি সংসদীয় কার্যক্রম শুরুর মাধ্যমে আইনের ভিত রচনা করেছিলেন। কিন্তু সামরিক ও স্বৈরশাসকরা সংসদকে অকার্যকর করে ফেলে। নির্বাচনকে বিতর্কিত করেছে। এরপর প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বে নতুন যাত্রা শুরু হয়।
রবিবার (৯ এপ্রিল) জাতীয় সংসদের সুবর্ণজয়ন্তী উপলক্ষে ১৪৭ বিধিতে উত্থাপন করা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার প্রস্তাবের উপর আলোচনায় অংশ নিয়ে এসব কথা বলেন সরকারি দলের সংসদ সদস্যরা।
প্রথমে স্পিকার ড. শিরীন শারমিন চৌধুরী ও পরে ডেপুটি স্পিকার শামসুল হক টুকু অধিবেশনে সভাপতিত্ব করেন।
আলোচনায় অংশ নিয়ে প্রবীণ সংসদ সদস্য ও আওয়ামী লীগের সভাপতিমন্ডলীর সদস্য মোশাররফ হোসেন মুক্তিযুদ্ধের প্রধান সেনাপতি মোহম্মদ আতাউল গণি ওসমানীর কঠোর সমালোচনা করেন।
তিনি বলেন, জেনারেল ওসমানী তাঁর প্রতিষ্ঠিত জাতীয় জনতা পার্টিতে যোগ দিতে তাকে (মোশাররফ হোসেন) আমন্ত্রণ জানান। ‘আমাকে টেলিফোন করে বলেন, আমি জনতা লীগ (জাতীয় জনতা পার্টি হবে) করেছি, আপনি আমার দলে থাকবেন। আমি বললাম কী বললেন? আমি তো দল করি। আমাকে জিজ্ঞেস করে, কোন দল করেন? আমি বললাম, আওয়ামী লীগ করি। তিনি আমাকে বলেন, আওয়ামী লীগ কি এখনো আছে?
মোশাররফ হোসেন বলেন, মুক্তিযুদ্ধ সম্পর্কে কিছু কথা আছে। আজকে কিছু বললাম না। বিতর্কিত হয়ে যাবে। মুক্তিযুদ্ধ মন্ত্রীকে কিছু বলেছি। এই মুক্তিযোদ্ধা, মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস বিকৃত হয়েছে। বিকৃত করেছে কে? জেনারেল ওসমানী। এটা আমি বলতে চাই।
তিনি আরও বলেন, আমি প্রশিক্ষণ নিয়ে যুদ্ধ করেছি। ভেতরে ঢুকেছি। আমি দুইবার আক্রান্ত হয়ে বেঁচে গিয়েছি। আজকে সেই কথা আর নাই বললাম।
তিনি বলেন, আমার আক্ষেপ, বঙ্গবন্ধুকে হত্যার পরে দেশে কোনো প্রতিবাদ হয়নি। আমরা অঝোরে কেঁদেছি। আমাদের হাতে কিছুই ছিল না। কিছুই করতে পারিনি। আমরা মুক্তিযোদ্ধা, আমাদের হাতিয়ার ছিল না, কিছুই ছিল না। বঙ্গবন্ধুর মৃত্যুর পরে আমরা সংগঠনকে শক্তিশালী করেছি।
আইন, বিচার ও সংসদ বিষয়ক মন্ত্রী আনিসুল হক বলেন, একটি রাষ্ট্রের তিনটি স্তম্ভ থাকে-নির্বাহী বিভাগ, আইন সভা এবং বিচার বিভাগ। জাতীয় সংসদ সেই আইন সভা। এই সংসদ জনগণের নির্বাচিত প্রতিনিধিদের দ্বারা গঠিত। বঙ্গবন্ধু আমাদের শুধু স্বাধীনতা দেননি। স্বাধীনতার ১০ মাস ১৩ দিনের মধ্যে আমাদেরকে একটি সংবিধান দিয়েছিলেন। এই সংবিধানে তিনি জাতীয় সংসদকে বাংলাদেশের গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা ও উন্নয়নের প্রাণকেন্দ্র হিসেবে রেখেছেন। তিনি এই সংসদের মাধ্যমে ৩ বছর ৭ মাস ৫ দিন শুধু আইন প্রণয়ন করেই এই দেশের আইনের ভিত স্থাপন করে দেননি, সংসদের অধিবেশনের মাধ্যমে তিনি সংসদের রীতিনীতি, সংসদীয় প্র্যাকটিস এবং সংসদের মর্যাদা স্থাপন করে দিয়ে গেছেন। কিন্তু ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট বঙ্গবন্ধুকে হত্যা করার পর আমরা দেখেছি সেই সংসদের অবজ্ঞা, অশ্রদ্ধা এবং অকার্যকর করার জন্য স্বৈরাচার সরকার যত রকম পদক্ষেপ নেওয়া প্রয়োজন তাই নিয়েছে। এই সংসদেই ইনডেমনিটি অধ্যাদেশ পাস হয়েছে। আবার এই সংসদেই প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বে এই ইনডেমনিটি অধ্যাদেশ বাতিল হয়েছে। স্বৈরাচারী সরকার সংসদীয় রীতিনীতি ধ্বংস করে দিয়েছে।
তিনি আরও বলেন, শেখ হাসিনার নেতৃত্বে আন্দোলনের মাধ্যমে আমরা আবার সংসদীয় গণতন্ত্র ফিরে পেয়েছি। তিনি এই সংসদীয় গণতন্ত্রকে প্রাতিষ্ঠানিক রূপ দিয়েছেন। সংসদীয় কমিটি গুলোকে কার্যকর করেছেন। এতে সংসদের নিকট সরকারের দায়বদ্ধতা ও জবাবদিহিতা নিশ্চিত হয়েছে।
কৃষিমন্ত্রী ড.আব্দুর রাজ্জাক বলেন, এই সংসদ আমাদের সকল কর্মকাণ্ডের কেন্দ্রবিন্দু। এই সংসদকে বলা হয় ‘হাউস অব দ্য ন্যাশন’ অর্থাৎ সমগ্র জাতির ঠিকানা এই সংসদ। এই সংসদকে কার্যকর করতে জাতির পিতা তার জীবনের সর্বস্ব দিয়ে গেছেন। বঙ্গবন্ধু পাকিস্তানের জন্য ছিলেন বিপজ্জনক, আর আমাদের জন্য ছিলেন আশির্বাদ। ভবিষ্যৎ প্রজন্মকে মুক্তিযুদ্ধ ও গণতান্ত্রিক চেতনায় উজ্জীবিত করতে তিনি সকলের প্রতি আহ্বান জানান।
স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান বলেন, গণতন্ত্র রক্ষা ও গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা অব্যাহত রাখতে বঙ্গবন্ধু ও তার পরিবার সবসময় কাজ করে গেছেন। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বে বর্তমান সরকার দেশের সকল কার্যক্রম জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের পরিকল্পনা অনুযায়ী বাস্তবায়ন করছে। অথচ স্বাধীনতাবিরোধী চক্র বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠার পর থেকে ষড়যন্ত্র করে যাচ্ছে। গণতান্ত্রিক ধারা অব্যাহত রাখতে সকলকে ঐক্যবদ্ধ থাকতে হবে।
বেসামরিক বিমান পরিবহন ও পর্যটন প্রতিমন্ত্রী মো. মাহবুব আলী বলেন, জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান এ দেশের মানুষের আশা আকাঙ্ক্ষা ও স্বপ্ন বাস্তবায়নের লক্ষে সংসদীয় গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। তিনি স্বল্পতম সময়ের মধ্যে জাতিকে পৃথিবীর শ্রেষ্ঠতম সংবিধান উপহার দিয়েছিলেন।
সাবেক মন্ত্রী মোস্তাফিজুর রহমান বলেন, বঙ্গবন্ধু দেশ স্বাধীন করে দেশের মানুষকে নিয়ে যে স্বপ্ন দেখেছিলেন, আজকে তার কন্যা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বঙ্গবন্ধুর স্বপ্নের দেশ গঠনে কাজ করছেন। বাংলাদেশকে তিনি এমন এক জায়গায় নিয়ে গেছেন যে, বাংলাদেশকে এখন বিশ্বের অনেক দেশ অনুকরণ করে।
সাবেক প্রতিমন্ত্রী মেহের আফরোজ চুমকি বলেন, আজকে বাংলাদেশ যে পর্যায়ে চলে গেছে, জনগণের কাছে ভোট চাওয়ার প্রয়োজন আছে বলে মনে করি না। তারপরও কেন চাইতে হয়? চাইতে হয় সেই কারণে, বঙ্গবন্ধুকে হত্যার পর একটা বিরাট প্রজন্ম ভুল তথ্য নিয়ে এই বাংলাদেশে বেড়ে উঠেছিল। তারা বঙ্গবন্ধুর ইতিহাস জানত না, এই দেশের কোনো ইতিহাসই সঠিকভাবে জানত না, যার কারণে এই প্রজন্ম আরও সমস্যার সৃষ্টি করছে।
তিনি আরও বলেন, আমাদের ভাবতে অবাক লাগে, স্বাধীনতা দিবসে স্বাধীনতাকে কটাক্ষ করে একটি ছোট শিশুকে ১০ টাকা দিয়ে মিথ্যা তথ্য দিতে দ্বিধা করেনি। শিশুশ্রম সবার দৃষ্টিগোচর হয়েছে।
ষড়যন্ত্র ও হুমকি দেওয়া হচ্ছে অভিযোগ করে সংসদ সদস্য শামীম ওসমান বলেন, আর ৭৫ সাল হবে না পরিষ্কারভাবে বলতে চাই, এবার প্রধানমন্ত্রীর কথাও শুনব না। আমরা যারা সংসদ সদস্য আছি, আওয়ামী লীগের নেতা-কর্মীরা আছি, বাংলাদেশ ও নেত্রীকে বাঁচানোর জন্য এবং মাথা উচু করে দাঁড় করানোর জন্য মাথায় কাফনের কাপড় পড়ে মৃত্যুর
সঙ্গে অ্যাপোয়েনমেন্ট নিয়ে রাস্তায় নামব।
বঙ্গবন্ধুর অবদানকে স্মরণ করে ওয়াসিকা আয়শা খান বলেন, বাংলাদেশ অনেক আগেই উন্নত দেশে পরিণত হতো যদি বঙ্গবন্ধু বেঁচে থাকতেন। কারণ, তার ৪৪ মাসের শাসনামলে ৭০টির বেশি অর্থনৈতিক চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়েছিল। কিন্তু তাকে হত্যার মধ্য দিয়ে জাতিকে পিছিয়ে দেওয়া হয়।
আলোচনায় আরও অংশ নেন গৃহায়ণ ও গণপূর্ত প্রতিমন্ত্রী শরীফ আহমেদ, স্থানীয় সরকার, পল্লী উন্নয়ন ও সমবায় প্রতিমন্ত্রী স্বপন ভট্টাচার্য, হুইপ ইকবালুর রহিম, আওয়ামী লীগের সদস্য সেলিম আলতাফ জর্জ, কাজী কেরামত আলী, সাইমুম সারওয়ার কমল, ডা. সামিল উদ্দিন আহমেদ শিমুল, গাজী মোহাম্মদ শাহনেওয়াজ, আবুল কালাম মো. আহসানুল হক চৌধুরী, তাহজীব আলম সিদ্দিকী, জাকিয়া তাবাসসুম, খান আহমেদ শুভ, শাহদাব আকবর, কাজী কানিজ ফাতেমা, বি এম কবিরুল হক, বেগম জাকিয়া পারভিন খানম, বেগম ফেরদৌসী ইসলাম ও বেগম মনিরা সুলতানা।
এনএইচবি/এমএমএ/