তৃণমূলের কাঠগড়ায় বিএনপির কেন্দ্রীয় নেতারা!
সরকার পতনের চূড়ান্ত আন্দোলনে বিএনপির তৃণমূল নেতাকর্মীরা কোমরবেঁধে প্রস্তুতি নিলেও কেন্দ্রীয় নেতাদের মধ্যে তেমন কোনো প্রস্তুতি লক্ষ্য করা যাচ্ছে না। কেন্দ্রীয় নেতারা ব্যস্ত রুটিন ওয়ার্ক আর পদ-পদবীতে ও নিজেদের বলয় তৈরিতে। যার ফলে সরকার পতন আন্দোলন বার বার হোঁচট খাচ্ছে-এমন অভিযোগ বিএনপির মাঠ পর্যায়ের নেতাকর্মীদের।
সম্প্রতি বিএনপির কেন্দ্রীয় নেতারা সারাদেশে ইউনিয়ন পরিষদের নির্বাচিত দলীয় জনপ্রতিনিধি এবং সাবেক চেয়ারম্যানদের সঙ্গে বৈঠক করা শুরু করেছেন। যা এখনও অব্যাহত আছে। এসব বৈঠকে তৃণমূলের জনপ্রতিনিধিরা তাদের ক্ষোভ ও অসন্তোষ প্রকাশ করেছেন। কেন সরকার বিরোধী আন্দোলন চাঙ্গা করা যাচ্ছে না তার কারণও তুলে ধরেন। এজন্য তারা সরাসরি দলের কেন্দ্রীয় নেতাদের ভূমিকা নিয়েও প্রশ্ন তুলেন।
মাঠ পর্যায়ের এই জনপ্রতিনিধিদের বক্তব্য হচ্ছে তৃণমূল ঠিক আছে। অথচ কয়েকদিন পর পর কর্মসূচি ঘোষণা দিয়ে তৃণমূলে ছুটে যান কেন্দ্রীয় নেতারা। তাদের আপ্যায়নেও আমাদের বেগ পেতে হচ্ছে। তারপরও যদি আমরা দেখতে পেতাম যে সরকার পতনের আন্দোলনে কেন্দ্রীয় নেতাদের প্রস্তুতি আছে তাহলেও অন্তত কিছুটা শান্তি নিয়ে এলাকায় ফিরে যাওয়া যেত। বিশেষ করে ঢাকামহানগরের নেতারা যদি আন্দোলন সংগ্রামের জন্য প্রস্তুতি নিতো তাহলে পার্শ্ববর্তী জেলাসমূহ থেকে নেতা-কর্মীদের কর্মসূচি সফল করতে ঢাকামুখী হওয়ার প্রয়োজন পড়ে না।
তারা অভিযোগ করে বলেন, তৃণমূল নেতাকর্মীরা অতীতেও আন্দোলন করেছে। সেই আন্দোলনে প্রথম দিকে কিছুটা দিক নির্দেশনা পেলেও এক পর্যায়ে কেন্দ্রীয় কোনো নেতাকেই আমরা খুঁজে পাইনি। কেন্দ্রীয় নেতাদের কেউ কেউ গ্রেপ্তার হয়েছিলেন। আবার এমন কথাও শুনা যায় যে, কেন্দ্রীয় নেতাদের কেউ কেউ নাকি স্বেচ্ছায় ধরা দিয়ে কারাগারে গেছেন। এসব কথা আমরা বিশ্বাস করি না, বিশ্বাস করতেও চাই না। তবে পরিবার পরিজনদের কাছেও লজ্জিত হই। বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানের সঙ্গে মতবিনিময়কালে দল সমর্থিত সাবেক ও বর্তমান ইউনিয়ন পরিষদের অন্তত দশজনের অধিক নেতা এসব অভিযোগ করেছেন। মতবিনিময় সভায় উপস্থিত এমন বেশ কয়েকজনের সঙ্গে কথা বলে এসব ক্ষোভ-অসন্তোষের কথা জানা গেছে।
মতবিনিময়ে অংশ নেওয়া জনপ্রতিনিধিরা বলেছেন, চলমান আন্দোলনকে এক দফার আন্দোলনে রুপ নেবে কি না সেটা বলাও মুশকিল হয়ে দাঁড়াচ্ছে। নাকি এবারও আগ মুহূর্তে তড়িগড়ি সিদ্ধান্তে দলীয় সরকারের অধীনেই অংশগ্রহণে ঘোষণা আসতে পারে। এমন কথা বাতাসে ভেসে আসে। কেন্দ্রীয় নেতারা স্পষ্ট কিছু বলছেন না; কিন্তু কেন? অথচ নির্দলীয় সরকারের অধীনে নির্বাচন হলেই কেবলমাত্র বিএনপির জয়ী হওয়ার সম্ভাবনা থাকছে। আন্দোলন কে ঘিরে সংশয়-সন্দেহ জন্ম হয়েছে বলেও বক্তব্যে দেন তারা।
এদিকে বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বলেছেন, এই অনির্বাচিত সরকার জোর করে ক্ষমতা দখল করে জাতির সব স্বপ্নকে ভেঙে দিচ্ছে। তাদের ক্ষমতা থেকে সরাতে না পারলে বাংলাদেশের অস্তিত্বই বিপন্ন হয়ে পড়বে। তৃণমূলে আন্দোলনকে আরও ছড়িয়ে দিয়ে গণঅভ্যুত্থানের মাধ্যমে এদের পতন ঘটাতে হবে।
জনপ্রতিনিধিদের উদ্দেশ্য করে তিনি বলেন, যেহেতু আপনারা জনগণের প্রত্যক্ষ ভোটে নির্বাচিত হয়েছিলেন অথবা এখনো নির্বাচিত আছেন। সে জন্য আপনাদের একটা দায়িত্ব রয়েছে এই জনগণকে আরও বেশি করে সম্পৃক্ত করার। সেই দায়িত্ব পালন করতে আহ্বান জানান তিনি।
মতবিনিময় সভায় উপস্থিত কুমিল্লা বিভাগের একাধিক জনপ্রতিনিধি নাম প্রকাশ না করার শর্তে ঢাকাপ্রকাশ-কে বলেন, যে প্রক্রিয়ায় কর্মসূচি দেওয়া হচ্ছে সেই কর্মসূচি পালনে বিএনপির তৃণমূল পর্যায়ের নেতা-কর্মীরা নতুন করে হামলা, মামলায়, হয়রানির শিকার হচ্ছেন। কেউ কেউ কারাবরণ করছেন, অনেকে পুলিশি হয়রানি ও গ্রেপ্তার এড়াতে পালিয়ে বেড়াচ্ছেন। ব্যক্তিগত পরিচয় না থাকলে কেন্দ্রীয় পর্যায় থেকে আইনি সহায়তাটুকুও কপালে জুটে না। কেন্দ্রীয় নেতারা কিভাবে আন্দোলনের ছক আঁকছেন সেটা সম্পর্কে অবগত না থাকায় মাঠের নেতা-কর্মীদের মধ্যে হতাশা দেখা দিয়েছে। শেখ হাসিনার অধীন নির্বাচন হলে বিএনপি ভোট কেন্দ্রেও যেতে পারবে না। কিন্তু ঢাকায় ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যানের সামনে বসে কেন্দ্রীয় নেতারা বলছেন, চলমান আন্দোলনে নেতাকর্মীদের সঙ্গে সম্পৃক্ত হচ্ছেন সাধারণ মানুষ; যা আংশিক সত্য।
অবশ্য ভিন্নমতও আছে। মতবিনিময় সভায় উপস্থিত ছিলেন এমন বেশকয়েকজন সাবেক জনপ্রতিনিধি বলছেন, সরকারের সঙ্গে কোনো ধরণের আপোস করা যাবে না। এদের সরাতে ঝুঁকি নিতেই হবে। নেতা-কর্মীরা ঝুঁকি নিয়েই কর্মসূচিতে অংশ নিচ্ছেন। ভবিষ্যতেও নেবে।
বিএনপির কেন্দ্রীয় দপ্তর সূত্রে জানা গেছে, ১০টি মতবিনিময় সভা অনুষ্ঠিত হবে। ইতিমধ্যে ২৩ ফেব্রুয়ারি রংপুর বিভাগ, ২৭ ফেব্রুয়ারি খুলনা বিভাগ, ২৮ ফেব্রুয়ারি সিলেট ও খুলনা বিভাগ, ১ মার্চ বরিশাল বিভাগ, ২ মার্চ ঢাকা বিভাগ, ৫ মার্চ ফরিদপুর ও কুমিল্লা বিভাগের মতবিনিময় সভা অনুষ্ঠিত হয়েছে। ১৩ মার্চ চট্টগ্রাম বিভাগ, ১৪ মার্চ চট্টগ্রাম (আংশিক) ও রাজশাহী, ১৫ মার্চ রাজশাহী বিভাগ (আংশিক) এবং ১৬ মার্চ ময়মনসিংহ বিভাগের মতবিনিময় সভা হবে। ২০০১ সাল থেকে এ পর্যন্ত বিএনপি সমর্থক যারা ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান হয়েছেন এরকম আড়াই থেকে তিন হাজার জনপ্রতিনিধি অংশ নিচ্ছেন এসব সভায়।
ঢাকা বিভাগের বেশকয়েক জনপ্রতিনিধিরা ঢাকাপ্রকাশ-কে বলেন, কেন্দ্রীয় নেতাদের মুখে ঈদ, শীত, রোজার পর আন্দোলন বক্তব্যে বিএনপিকে হাস্যকর রাজনৈতিক দলে পরিণত করছে। দল পুনর্গঠনে পছন্দ এবং আত্নীয়-স্বজনদের দিয়ে কমিটি করছেন কেন্দ্রীয় নেতারা। আর তারেক রহমানকে ভুল বুঝানোর মাধ্যমে দলের ত্যাগী নেতাকর্মীদের গুরুত্ব দেওয়া হচ্ছে না। তাই অনেকে দলীয় কর্মকাণ্ড থেকে নিজেদের গুটিয়ে নিয়েছে, অনেকে গুটিয়ে নিতে বাধ্য হচ্ছেন। তারা আরও বলেন, নতুন করে কমিটি গঠনে যাদের দায়িত্ব দেওয়া হচ্ছে; তারা তো আন্দোলনে কোন ভূমিকা পালন করতে পারছেন না। অথচ সভা সমাবেশ-আলোচনা সভায় আওয়াজ উঠে আন্দোলনের। প্রতিটি প্রোগ্রামে একই মুখ, একই বক্তা; বক্তব্যে কোনো ভেরিয়েশন নাই। এছাড়াও দলের পদে আসতে যদি কেন্দ্রীয় নেতাদের সন্তুষ্ট করা লাগে তাহলে এক সময়ে মুখ থুবড়ে পড়তে পারে তৃণমূল নেতা-কর্মীরা। কিসের ভিত্তিতে পদ দেওয়া হয় সে বিষয়ে দলের ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান ও মহাসচিব এর কাছে জানতে চান জনপ্রতিনিধিরা।
১০ মার্চ বিকেলে নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক বিএনপির একজন ভাইস চেয়ারম্যান ঢাকাপ্রকাশ-কে বলেন, দলকে সংগঠিত করতে কেন্দ্র থেকে নির্দেশনা দেওয়া হচ্ছে। কিন্তু কর্মীদের আত্মবিশ্বাস বাড়ানোর উদ্যোগ নেওয়া হয় না। নিকট অতীতেও আমরা যেমনভাবে কর্মীদের খোঁজ-খবর রাখতাম এখন সেভাবে রাখতে পারছি না। সত্য বলতে রাজনীতিবিদদের থেকে যদি পেশাজীবীরা দলের সিদ্ধান্ত নেওয়ায় ভূমিকা রাখেন তখন যা হওয়ার তাই হচ্ছে।
তিনি বলেন, বিএনপি এতো বড় একটি রাজনৈতিক দল। কিন্তু ছাত্রদল থেকে গড়ে উঠা নেতৃত্ব থেকে শুধুমাত্র সালাহ উদ্দিন আহমেদকে নীতিনির্ধারণী পর্যায়ে রাখা হয়েছে। তাও তিনি আবার দেশের বাইরে রয়েছেন আইনী জটিলতায়। আন্দোলনকে সামনে রেখে আমাদের উচিত তৃণমূলকে সম্মান করা। আমরা ব্যর্থ হয়েছি, তৃণমূল ব্যর্থ হয়নি। তৃণমূল দলের প্রাণ, সেই তৃণমূলকে নিয়ে সব জায়গাতেই বৈষম্য। কোনো সভা হলে কারা বক্তব্য দিতে পারবেন, কারা পারবেন না তা নিয়েও তালিকা করা হয়। বিরুদ্ধে কথা বলতে পারেন শঙ্কায় তালিকায় অনেকের নামও থাকে না।
খুলনা বিভাগের জনপ্রতিনিধিরা আক্ষেপ করে বলেছেন, কমিটিতে মাই ম্যান ও অনুসারী ছাড়া কারও ভাগ্যে কিছু জোটে না। এ অবস্থা থেকে উত্তরণে বিভিন্ন আসনের সাবেক এমপি ও কেন্দ্রীয় নেতাদের দৌরাত্ম্য থামাতে হবে। দলের মধ্যে বিভেদ ভুলে এবারও যদি পরিবর্তন না আসে তাহলে অস্তিত্ব সঙ্কটে পড়তে হবে। এই মুহূর্তে আন্দোলনমুখী কমিটি দরকার। কাজের লোক দরকার বেশি। কিন্তু বতর্মানে প্রতি ইউনিটেই নিজের অনুসারীকে প্রাধান্য দিতে গিয়ে ত্যাগী ও যোগ্যদের বাদ দেওয়া হচ্ছে।
এনএইচবি/এএস