আগামী নির্বাচনে বিতর্কিতদের কপালে আসছে দুর্গতি
আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচনে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ প্রার্থী মনোনয়নের ক্ষেত্রে বড় ধরনের চমক দেখাতে পারে। বিশেষ করে মন্ত্রিসভার কয়েকজন সদস্য ও দলীয় সংসদ সদস্যদের মধ্যে যারা বেফাঁস কথা বলে দল ও সরকারকে বিব্রত করেছেন তাদের কপালে খড়্গ নামছে।
পাশাপাশি অনেক মন্ত্রী ও সংসদ সদস্যের বিরুদ্ধে নিজ এলাকায় দলীয় নেতা-কর্মীদের নির্যাতন, হামলা-মামলা করে হয়রানি করার অভিযোগও উঠেছে। এ সব অভিযোগের বেশিরভাগই কেন্দ্রে দলীয় নেতৃত্বের কাছে জমা পড়েছে। অনেক সংসদ সদস্য এলাকামুখী না হওয়ায় জনবিচ্ছিন্ন হয়েছে। কেউ কেউ নিয়োগ বাণিজ্য, টেন্ডার বাণিজ্য, জলমহাল, বালুমহাল নিয়ন্ত্রণ এবং সন্ত্রাসী কর্মকণ্ডের সঙ্গে জড়িয়ে দলকে সাধারণে মানুষের কাঁঠগড়ায় নিয়ে গেছেন। অনেক প্রভাবশালী সংসদ সদস্য রয়েছেন যারা নিজের ব্যক্তিগত স্বার্থকে প্রধান্য দিয়ে গ্রুপিং করেছেন, দলকে ভাগ করেছেন, নিজের পরিবারের সঙ্গে ঝামেলায় জড়িয়েছেন। যা স্থানীয় পর্যায়ে দলের অভ্যন্তরীণ সমস্যায় পরিণত হয়েছে। এরকম বেশ কয়েকজন বিতর্কিত সংসদ সদস্য ও মন্ত্রীর তালিকা কেন্দ্রীয় হাইকমাণ্ডের কাছেও আছে। আগামী সংসদ নির্বাচনে এ সব বিতর্কিত নেতারা দলীয় মনোনয়ন পাবেন না।
স্থানীয় সরকার (পৌরসভা) নির্বাচনকে ঘিরে রাজশাহী-১ আসনের সংসদ সদস্য ওমর ফারুক চৌধুরীর ‘লাঠি কাটা ও লাঠি খেলা’ নিয়ে বিতর্কিত কথায় দলের ভাবমূর্তি নষ্ট হয়েছে। তিনি বলেছিলেন, ‘প্রতিটা কেন্দ্রে আমার নির্বাচনের সময় ২০০৮ সালে বলেছিলাম- একশ, দেড়শ, দুশ' করে লাঠি কেটে রাখবেন। বলেছিলাম না? হ্যাঁ বলেছিলাম। ২০০৮ সালের কথা এটা। ওই ফর্মুলা এবার মুণ্ডুমালা পৌর নির্বাচনে নিতে হবে। যদি ভোটের দিন ব্যবহার করতে হয়, যদি ভোটের দিন ব্যবহার করার দরকার পড়ে, তাহলে ব্যবহার করবেন। নাহলে ভোটে বিজয়ী হওয়ার পর ওই লাঠিখেলা হবে মুণ্ডুমালায়।’
তিনি সম্প্রতি নিজের নির্বাচনী এলাকার একটি কলেজের মারধর করে নতুন করে বিতর্কের জন্ম দেন। দেশব্যাপী তার এই ঘটনা ব্যাপক সমালোচিত হয়। তদন্তেও এর সত্যতা পাওয়া যায়। নানা বিতর্কের জন্ম দেওয়া এই সংসদ সদস্যের বিরুদ্ধে দলের হাইকমান্ডের কাছে বিস্তর অভিযোগ জমা পড়েছে।
জামালপুর সরিষাবাড়ির সংসদ সদস্য তথ্য ও সম্প্রচার প্রতিমন্ত্রী ডা. মুরাদ হাসান বিএনপিকে সমালোচনা করতে গিয়ে অশালিন ভাষায় কথা বলে ফেঁসে যান। এ জন্য তাকে মন্ত্রীত্ব হারাতে হয়েছে। আগামী নির্বাচনে তার বিষয়ে কঠিন সিদ্ধান্ত আসতে পারে।
সংরক্ষিত আসনের সংসদ সদস্য তামান্না নুসরাত বুবলী বিএ পরীক্ষায় জালিয়াতি করায় ফেঁসে যান। তার বিষয়ে গণমাধ্যমে ব্যাপক সংবাদ পরিবেশিত হয়। পরবর্তীতে এ নিয়ে দলের ভেতরও তুমুল সমালোচনা হয়।
সাবেক ছাত্রনেতা বরিশাল-৪ আসনের সংসদ সদস্য পংকজ নাথের বিরুদ্ধে বিভিন্ন অভিযোগ ওঠার কারণে ইতোমধ্যে তাকে দলের সব পদ থেকে অব্যাহতি দেওয়া হয়েছে।
ফেনী-২ আসনের সংসদ সদস্য নিজাম উদ্দিন হাজারীকে নিয়েও এলাকায় নানা বিতর্ক আছে। নোয়াখালী-৪ আসনের সংসদ সদস্য মোহাম্মদ একরামুল করিম চৌধুরী দলের সাধারণ সম্পাদক এবং সড়ক পরিবহন ও সেতু মন্ত্রী ওবায়দুল কাদের ও তার পরিবারকে নিয়ে বিতর্কিত মন্তব্য করে শুধু চাপেই পড়েননি, তাকে নোয়াখালী জেলা আওয়ামী লীগের আহ্বায়ক কমিটির সদস্য পদ থেকে অব্যাহতি দেওয়া হয়েছে।
সাবেক প্রভাবশালী মন্ত্রী ফরিদপুর-৪ আসনের সংসদ সদস্য খন্দকার মোশারফ হোসেন এখন অনেকটাই লাইম লাইটের বাইরে। তার বিরুদ্ধে নিজের ভাইকে দিয়ে ফরিদপুরের রাজনীতিসহ সবকিছিুর নিয়ন্ত্রণ নেওয়া ,টেন্ডারবাজী, চাঁদাবাজীসহ এমন কোনো অভিযোগ নেই যা সাবেক এই মন্ত্রীর বিরুদ্ধে নেই। স্থানীয় আওয়ামী লীগের ত্যাগী নেতা-কর্মীদের কোণোঠাসা করে দলকে কুক্ষিগত করে রাখারও অভিযোগ উঠে তার বিরুদ্ধে। তার ছত্রচ্ছায়ায় ফরিদরপুরে হাইব্রিড আওয়ামী লীগাররা চাঁদাবাজি থেকে শুরু করে দখলসহ সব অপরাধ কর্মকাণ্ডে যুক্ত ছিলেন। এ সব কারণে দলীয় হাইকমান্ড তাকে সবকিছু থেকে বাদ দিয়েছে। মোশাররফ হোসেন এখন কোথাও কোনো আলোচনাতে নেই।
টাঙ্গাইল-২ (গোপালপুর-ভুঞাপুর) আসনের সংসদ-সদস্য তানভীর হাসান ছোট মনিরের বিরুদ্ধে সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড ও জোরপূর্বক জমি দখলের অভিযোগ উঠেছে। তিনি কাঁচাধান কেটেও দেশব্যাপী বিতর্কিত হয়েছিলেন। স্থানীয় আওয়ামী লীগের সঙ্গে তার একটা দূরত্ব তৈরি হয়েছে। মানুষ ভয়ে কিছু বলতে না পারলেও দলীয় হাইকমান্ডের কাছে তার বিরুদ্ধে অভিযোগের পাহাড় জমা পড়েছে। টাঙ্গাইল পৌরসভার ১৫ নম্বর ওয়ার্ডের আশেকপুর মৌজার বাসিন্দা শাহানুর ইসলাম ১২ মার্চ ঢাকা রিপোর্টার্স ইউনিটিতে (ডিআরইউ) সংবাদ সম্মেলন করে সন্ত্রাসী হামলা ও দখলের অভিযোগ করেন।
বরগুনার সংসদ সদস্য শওকত হাচানুর রহমান রিমনের বিরুদ্ধেও জমি দখলের অভিযোগ উঠেছে। স্থানীয় এক বৃদ্ধ তার জমি দখলমুক্ত করে দেওয়ার দাবিতে ১০ মার্চ বরগুনা জেলা প্রশাসক কার্যালয়ের সামনে জায়নামাজ বিছিয়ে অনশন করেন।
সংসদ সদস্যদের বাইরে সাম্প্রতিক সময়ে নানা বেফাঁস কথা বলে দল ও সরকারকে বিব্রত করেছেন একাধিক মন্ত্রী ও প্রতিমন্ত্রী। এদের মধ্যে পররাষ্ট্রমন্ত্রী ড. এ কে আব্দুল মোমেন কিছুদিন আগে নিজের নির্বাচনী এলাকা সিলেটে সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাব দিতে গিয়ে বলেছিলেন, ‘বাংলাদেশ শ্রীলঙ্কা হয়ে যাবে, একটি পক্ষ প্যানিক ছড়ানোর জন্য এমন কথা বলছে। বাস্তবে এর কোনো ভিত্তি নেই। বৈশ্বিক মন্দায় অন্যান্য দেশের তুলনায় বাংলাদেশের মানুষ বেহেশতে আছে’। তার এই বক্তব্য সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে তুমুল সমালোচনার ঝড় তুলে। এর বাইরে গোপালগঞ্জে গিয়ে তিনি আরেকদফা বিতর্কিত বক্তব্য দিয়ে সমালোচিত হন। আগামী নির্বাচনে তিনি বাদের খাতায় চলে যেতে পারেন।
স্থানীয় সরকার, পল্লী উন্নয়ন ও সমবায় মন্ত্রী মো. তাজুল ইসলাম এক অনুষ্ঠানে বলেছেন, ‘গ্রামগঞ্জের কোনো মানুষ না খেয়ে নেই। প্রত্যেকটি মানুষ খেতে পারছে। প্রত্যেক মানুষের গায়ে জামা-কাপড় রয়েছে। গ্রামের প্রায় সব রাস্তাঘাট পাকা হয়ে গেছে। প্রত্যেক গ্রামে প্রাইমারি স্কুল করা হয়েছে, ঘর না থাকলে ঘর করে দেওয়া হচ্ছে।’ তার এই বক্তব্যও তীব্র সমালোচনার মুখে পড়ে।
পরিকল্পনামন্ত্রী এম এ মান্নান গত ১০ আগস্ট সুনামগঞ্জে এক অনুষ্ঠানে বলেছেন, ‘কিছু মানুষ আছে আমাদের পছন্দ করে না। তারা বলছে, জিনিসপত্রের দাম বেড়েছে, মানুষ মরে যাবে। তবে আমরা অস্বীকার করব না। জিনিসপত্রের দাম কিছুটা বেড়েছে এটা সত্যি। কিন্তু জিনিসপত্রের দাম বাড়ায় এখনো কেউ মারা যায়নি, আশা করি মরবেও না।’
একইভাবে দেশের সার্বিক চিত্র নিয়ে কথা বলতে গিয়ে মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ মন্ত্রী শ ম রেজাউল করিম বলেছিলেন, ‘মানুষ চাইলে তিন বেলা মাংস খেতে পারে।’ তার এই বক্তব্য সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ব্যাপক ট্রল হতে থাকে। গত ১৫ আগস্ট জাতীয় শোক দিবসে কুড়িগ্রামে এক আলোচনায় বক্তব্য দিতে গিয়ে বেফাঁস কথা বলেন। তার বক্তব্য নিয়ে আওয়ামী লীগের ভেতরে বাইরে তীব্র সমালোচনা হয়।
হেভিওয়েট সংসদ সদস্য ও সাবেক মন্ত্রী শাজাহান খানকে দুর্নীতিবাজ আখ্যায়িত করে বিতর্কের জন্ম দেন ফরিদপুর-৪ আসনের সংসদ সদস্য মজিবুর রহমান নিক্সন চৌধুরী। তিনি বলেছেন, ‘আমার বিরুদ্ধে মাদারীপুরে বিক্ষোভ মিছিল করেছে আওয়ামী লীগ নয় বরং সেখানকার সংসদ সদস্য শাজাহান খানের পকেট কমিটির লোক। আমার লোকেরা কোনো বিক্ষোভ করবে না। কারণ আন্দোলন করলে উনি (শাজাহান খান) ঢাকায় ঢুকতে পারবেন না। আমি বরং উনার বিচার চাইবো। কারণ শাজাহান খান একজন দুর্নীতিবাজ।’
জানা যায়, আওয়ামী লীগের কমপক্ষে ১৪ জন সংসদ-সদস্যের বিরুদ্ধে দুর্নীতির অভিযোগ তদন্ত করছে দুর্নীতি দমন কমিশন। তাদের মধ্যে রয়েছেন হাজী সেলিম, মোয়াজ্জেম হোসেন রতন, সামশুল হক চৌধুরী, ওমর ফারুক চৌধুরী, মাহফুজুর রহমান মিতা প্রমুখ। আওয়ামী লীগের হাইকমান্ডের সিদ্ধান্ত, দুদকের অভিযোগ নিষ্পত্তি না হওয়া পর্যন্ত এ সব এমপির কাউকেই আগামী নির্বাচনে দলীয় মনোনয়ন দেওয়া হবে না। দলীয় মনোনয়ন পেতে তাদের দুদক থেকে নিষ্কৃতি লাভ করতে হবে।
বিতর্কিতদের বিষয়ে আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের বলেছেন, দোষ করে গুটিকয়েক, দুর্নাম হয় সরকারের, দুর্নাম হয় গোটা পার্টির। এটা আমরা হতে দেব না। যারা যেখানে অপকর্ম করছেন সব খবর নেত্রীর কাছে আছে। সবার এসিআর আছে, সময়মতো টের পাবেন। কেউ কেউ টের পাচ্ছেন। বাকিরা সামনে পাবেন।
তিনি আরও বলেন, নির্বাচিত জনপ্রতিনিধি হয়ে জমিদারি করবেন, শেখ হাসিনা সেটা কোনো দিনও ক্ষমা করবেন না। জনপ্রতিনিধির জমিদারি মানসিকতা নিয়ে শেখ হাসিনার দলে থাকতে পারে না, বঙ্গবন্ধুর দলে থাকতে পারে না।’
উল্লেখ্য, একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে নিরষ্কুশ বিজয় অর্জন করার পর জোটের শরীকদের নিজের পায়ে দাঁড়ানোর সুযোগ করে দিতে এককভাবে সরকার গঠন করে আওয়ামী লীগ। সরকার গঠনের পর থেকে মন্ত্রিসভার সদস্য থেকে শুরু করে সংসদ সদস্যদের অনেকে সময়ে সময়ে বেফাঁস বক্তব্য দিয়েছেন। যার দায় সরাসরি দল ও সরকারের উপর পড়েছে।
এনএইচবি/আরএ/