আন্তর্জাতিক মানবপাচারকারীদের ধরতে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর কঠোর পদক্ষেপ
লিবিয়া ফেরত যাত্রীদের জিজ্ঞাসাবাদে মিলেছে অনেক তথ্য। আন্তর্জাতিক মানবপাচারকারী ধরতে মাঠে সোচ্চার হচ্ছেন আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যরা। ইতোমধ্যে তারা এ অভিযান চলমান রেখেছেন এবং তালিকা করে ত্রিমুখী অভিযানে নামবেন। সম্প্রতি একাধিক গোয়েন্দা কর্মকর্তাদের সঙ্গে কথা বলে এসব তথ্য জানা গেছে।
কর্মকর্তারা জানান, মানবপাচার প্রতিরোধে কঠোর পদক্ষেপ নিতে যাচ্ছে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী। তাদের বক্তব্য, কোনভাবে আন্তর্জাতিক মহলে বাংলাদেশের মান ক্ষুন্ন করা যাবে না। যার জন্য মানবপাচারকারীদের ধরতে তৎপর হচ্ছেন তারা।
গ্রামের দালাল থেকে শুরু করে শহরের ট্রাভেল এজেন্সির বিরুদ্ধে ত্রিমুখী অভিযানে নামছেন তারা। বিশেষ করে সিআইডি, র্যাপিড অ্যাকশন ব্যাটালিয়ন এবং ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশ একযোগে এ অভিযান পরিচালনা করবে।
গত ৩ মার্চ লিবিয়া থেকে ১১৪ জন বাংলাদেশিকে দেশে ফেরত এনে তাদের দফায় দফায় জিজ্ঞাসাবাদ করেন আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা। তাদের দেওয়া তথ্যের উপর ভিত্তি করেই এ অভিযান শুরু হচ্ছে বলে জানিয়েছেন সংশ্লিষ্ট একটি সূত্র।
আন্তর্জাতিক মানবপাচারকারীদের বিরুদ্ধে অভিযানে যাবে র্যাব:
এদিকে র্যাপিড অ্যাকশন ব্যাটালিয়ন (র্যাব) বলছে, মানবপাচার প্রতিরোধে তারা অনেক আগে থেকে কাজ করছে। বর্তমান মানবপাচারকারীদের বিরুদ্ধে বিভিন্ন অভিযান চলমান আছে। র্যাবের একটি সূত্র জানায়, লিবিয়া ফেরত বাংলাদেশিরা যে তথ্য দিয়েছেন তারই প্রেক্ষিতে গোয়েন্দা কার্যক্রম জোরদার করেছেন তারা। দ্রুত মানবপাচারকারীদের গ্রেপ্তার করে আইনের আওতায় আনা হবে। তাছাড়া যারা রঙ্গিন স্বপ্নের ফাঁদে ফেলে দেশের মানুষকে বিপদে ফেলছে এবং দেশের সুনাম নষ্ট করছে এদের কাউকে ছাড় দেওয়া হবে না বলে জানান সংস্থাটি।
সূত্র মতে, গত ২০২০ সালের ২৮ মে লিবিয়ার ত্রিপলি থেকে ১৮০ কিলোমিটার দক্ষিণের শহর মিজদাহতে ২৬ বাংলাদেশিকে গুলি করে হত্যা করে একদল মানব পাচারকারী। ওই ঘটনায় চার আফ্রিকান অভিবাসীও নিহত হন। মানবপাচারকারীদের বিরুদ্ধে পুলিশের মহাপরিদর্শক বেনজীর আহমেদের কঠোর ব্যবস্থা গ্রহণের নির্দেশনার পর মাঠ পর্যায়ে ব্যাপক তৎপরতা চালিয়ে ৫২ জনকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে।
লিবিয়ায় যাওয়ার পথে মৃত্যু হয় ৭ বাংলাদেশির
গত ৩০ জানুয়ারি মাদারীপুরের ৭ জনের লিবিয়া হয়ে ভূমধ্যসাগর পাড়ি দিয়ে ইটালি যাওয়ার পথে ঠান্ডায় মৃত্যু হয়। মাদারীপুর সদর উপজেলার পশ্চিম পিয়ারপুর গ্রামের ইমরান হোসেন, পিয়ারপুর গ্রামের রতন জয় তালুকদার, ঘটকচর গ্রামের সাফায়েত, মোস্তফাপুর গ্রামের জহিরুল, মাদারীপুর সদর উপজেলার বাপ্পী, সুনামগঞ্জের জামালগঞ্জ উপজেলার মামুদপুর গ্রামের সাজ্জাদ ও কিশোরগঞ্জে ভৈরব উপজেলার সাইফুল। এ ঘটনা সারাবিশ্বের গণমাধ্যমে ব্যাপকহারে প্রচার পায়।
ইউরোপের বিভিন্ন দেশ থেকে বাংলাদেশিদের ফেরত পাঠানো হচ্ছে:
বিশেষ করে ইউরোপের বিভিন্ন দেশ থেকে প্রতিনিয়িত অভিবাসন প্রত্যাশী বাংলাদেশিদের দেশে ফেরত পাঠানো হচ্ছে। এক শ্রেণির মানবপাচারকারীরা দুবাইয়ের টুরিস্ট ভিসা দিয়ে ইউরোপের বিভিন্ন দেশে পাঠানোর চেষ্টা করছে। কেউ লিবিয়া গিয়ে তাদের খপ্পরে পড়ে অমানুষিক নির্যাতনের শিকার হয়ে বন্দি জীবন কাটাচ্ছে আবার কেউ সাগর পাড়ি দিয়ে যাওয়ার সময় মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়ছে। আবার কেউ কেউ বিভিন্ন দেশে প্রবেশের সময় সে দেশের পুলিশের হাতে আটক হচ্ছে।
যেসব কারণে পুলিশের ইমিগ্রেশন বিভাগ প্রশ্নের মুখে পড়েছে:
এসব ঘটনায় একদিকে যেমন ব্রিবত হচ্ছে সরকার তেমনি প্রশ্নের মুখে পড়ছে পুলিশের ইমিগ্রেশন বিভাগ। চলমান এ অবস্থার মধ্যেই গত ৩ মার্চ লিবিয়ার জেলখানা থেকে মুক্তি পেয়ে ১১৪ জন বাংলাদেশীকে দেশে ফিরিয়ে আনা হয়। এ ১১৪ জন দুবাইয়ের টুরিস্ট ভিসা নিয়ে প্রথমে দুবাই যান। এরপর ইটালি যাওয়ার জন্য নেওয়া হয় লিবিয়ায়। আর সেখানেই তাদের অমানুষিক নির্যাতনের শিকার হতে হয়। পাচারকারীরা নির্যাতনের সেই ভিডিও স্বজনদের নিকট পাঠিয়ে আদায় করতো মুক্তিপণ। এভাবে একেক পরিবারের নিকট থেকে ১০ থেকে ১৫ লাখ করে টাকা আদায় করে তারা। পরবর্তীতে সে দেশের পুলিশ ও সেনাবাহিনীর হাতে গ্রেপ্তার হয়ে তারা জেলখানায় বন্দি ছিলেন। বিষয়টি নিয়ে বাংলাদেশ দূতাবাস, সেনাবাহিনী ও আইওএম যৌথভাবে তাদের দেশে ফিরিয়ে আনেন।
এ ঘটনায় বিব্রত সরকার। সরকারের উচ্চ মহল থেকে মানবপাচারকারীদের বিরুদ্ধে কঠোর অবস্থানে যাওয়ার নির্দেশ দেওয়া হয়। এদের দেশে আসার পর বিমানবন্দরেই তাদের নিকট থেকে নানা ধরনের তথ্য উপাত্ত সংগ্রহ করেন গোয়েন্দা সংস্থার কর্মকর্তারা। আর সেই তথ্যের ভিত্তিতে স্থানীয় দালাল থেকে শুরু করে রাজধানীর কোন কোন ট্রাভেল এজেন্সি মানবপাচারের সাথে জড়িত তাদের তালিকা করা শুরু করেছেন। তালিকা ধরেই অভিযান চালাবে সিআইডি, র্যাব এবং ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশ।
যা বলছেন আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যরা:
জানতে চাইলে ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশের উপ-পুলিশ কমিশনার মশিউর রহমান বলেন, পাচারকারীদের বিরুদ্ধে তালিকা ধরে আমরা কাজ শুরু করেছি। রাজধানী জুড়েই ট্রাভেল এজেন্সিদের কঠোর নজরদারীতে রাখা হচ্ছে। তিনি বলেন, প্রাপ্ত তথ্যের ভিত্তিতে মানবপাচারকারী প্রতিষ্ঠানগুলোর বিরুদ্ধে অভিযান পরিচালনা করা হবে।
সিআইডির অতিরিক্ত পুলিশ সুপার আজাদ রহমান বলেন, মানবপাচারকারীদের বিরুদ্ধে বরাবরই সিআইডির শক্ত অবস্থান। এর আগে আমরা মানবপাচারকারীর অনেক বড় বড় সিন্ডিকেটের সদস্যদের গ্রেপ্তার করেছি। বর্তমান সময়ের প্রেক্ষিতে সিআইডি আবারো নজরদারী শুরু করেছে। তিনি বলেন, ইতোমধ্যে মানবপাচারে জড়িত ট্রাভেল এজেন্সির তালিকাও তৈরী করা শুরু করেছি। নজরদারীর মধ্যেই যে কোন সময় আমরা বড় সিন্ডিকেটকে আইনের আওতায় আনতে পারবো।
ইমিগ্রেশন বিভাগের ডিআইজি মনিরুল ইসলাম বলেন, লিবিয়া থেকে ফেরত আসাদের জিজ্ঞাসাবাদে পাওয়া তথ্য নিয়ে মাঠে কাজ করছেন আইনশৃঙ্খলা বাহিনী। মানবপাচারকারীরা কোনভাবে যেন ছাড় না পাই তার ব্যবস্থা করা হচ্ছে। গ্রামের দালাল থেকে শুরু করে শহর পর্যন্ত যারা জড়িত তাদের প্রত্যেককেই আইনের আওতায় আনতে কাজ করা হচ্ছে। তিনি বলেন, টুরিস্ট ভিসায় দেশের বাইরে যাওয়া, ফিরে না এসে সেখানে অবৈধভাবে থেকে যাওয়া এটি খুবই দুঃখজনক ঘটনা। এক শ্রেণির ট্রাভেল এজেন্সির কারসাজিতে পড়ে একদিকে যেমন নিঃস্ব হচ্ছে সাধারন পরিবার অন্যদিকে বিদেশে এভাবে গিয়ে তারা জেল হাজতে থাকছে। দেশের ভাবমূর্তিও ক্ষুন্ন করছে। তিনি বলেন, অনেক সময় তারা মৃত্যুর কোলেও ঢলে পড়েছে। সম্প্রতি এ ধরনের ঘটনা বেড়ে যাওয়া ও অবৈধভাবে দেশের বাইরে থেকে বাংলাদেশী ফেরত আসার ঘটনায় ইমিগ্রেশন কর্তৃপক্ষ আরো কঠোর সিদ্ধান্ত নিতে যাচ্ছে।
এক প্রশ্নের জবাবে উর্ধ্বতন এ কর্মকর্তা বলেন, এটি মানবপাচারের সামিল এ বিষয়ে কোন সন্দেহ নাই। ট্যুরিষ্ট ভিসার ক্ষেত্রে লোকজন বিমানবন্দরে ইমিগ্রেশন পুলিশ কিছু বললেই তারা হয়রানির অভিযোগ করেন। এ অভিযোগ থেকে মুক্তি পেতে ইমিগ্রেশন পুলিশ আরও কঠোর হবে। পাশাপাশি যে সকল পুলিশ কর্মকর্তার বিরুদ্ধে অনৈতিকতার অভিযোগ আসবে তাদের বিরুদ্ধেও ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
ইউরোপে বাংলাদেশের মান ক্ষুন্ন হচ্ছে সেইসঙ্গে মৃত্যুর মুখে পড়তে হচ্ছে অনেকের:
ইউরোপ যাওয়ার এ প্রবণতা বিশ্বে বাংলাদেশের ভাবমূর্তি ক্ষুন্ন করছে আখ্যা দিয়ে পুলিশ সদর দপ্তরের পুলিশ সুপার (এআইজি) আলমগীর হোসেন শিমুল বলেন, এক শ্রেণির দালাল ও ট্রাভেল এজেন্সির প্রতারণার কারণে এই বিষয়টা হচ্ছে। তারা ইউরোপের স্বপ্ন দেখিয়ে আমাদের দেশের তরুণ যুবকদের প্রভাবিত করে। পরবর্তীতে তাদের ফাঁদে পা দিয়ে ঝুঁকিপূর্ণ যাত্রা করে। এতে করে কেউ কেউ মৃত্যুর মুখেও পতিত হচ্ছে।
তিনি বলেন, এখানে ইমিগ্রেশন পুলিশেরও অনেক সময় দ্বায় নিতে হয়। কিন্তু দেখা যাচ্ছে ইমিগ্রেশন পুলিশ যদি যেতে না দেয় তাহলে অভিযোগ করে আবার যেতে দিলে বলে টাকা খায়। এ অবস্থায় তারাও দ্বিধাদ্বন্দের মধ্যে থাকে। তবে এটি নিয়ে আরো ব্যাপকভাবে কাজ করতে হবে। ঝুঁকিপূর্ণ যাত্রা নিয়ে একদিকে সরকারকে কাজ করতে হবে অন্যদিকে এর কুফল নিয়ে গণমাধ্যমে বার বার সংবাদ প্রকাশ হলে জনগণের মধ্যে সচেতনতা আসবে। তিনি বলেন, পুলিশ সদরদপ্তর থেকে ইতোমধ্যে এ ব্যাপারে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিতে নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে।
জানতে চাইলে র্যাপিড অ্যাকশন ব্যাটালিয়নের আইন ও গণমাধ্যম শাখার পরিচালক খন্দকার আল মঈন বলেন, র্যাব আন্তর্জাতিক মানবপাচার প্রতিরোধে কাজ করে যাচ্ছে। লিবিয়া ফেরত বাংলাদেশীরা যে তথ্য দিয়েছে সেগুলো মাথায় রেখে আমাদের গোয়েন্দা নজরদারি তৎপর রয়েছে। দ্রুত সময়ের মধ্যে মানবপাচারকারীদের গ্রেপ্তার করে আইনের আওতায় আনা হবে।
র্যাব-৩-এর একজন উর্ধ্বতন কর্মকর্তা জানান, মানব পাচারকারী চক্ররা ভিন্ন ভিন্ন কৌশলে কাজ করছে। ইতিমধ্যে আমরা অনেক পাচারকারীদের আইনের আওতায় এনেছি। মানব পাচারকারীদের বিরুদ্ধে আমাদের অভিযান চলমান রয়েছে। তবে সাধারণ মানুষ সচেতন না হলে এসব অপরাধ থেকে পুরোপুরি রক্ষা পাওয়া কঠিন।
জানতে চাইলে র্যাব-১ এর অধিনায়ক লেফটেন্যান্ট কর্নেল আব্দুল্লাহ আল মোমেন বলেন, এ পর্যন্ত র্যাব আন্তর্জাতিক মানবপাচারকারী চক্রের বিদেশি নাগরিকসহ অসংখ্য মানবপাচারকারী চক্রের সদস্যকে গ্রেপ্তার করে আইনের আওতায় আনতে সক্ষম হয়েছে। রাজধানীসহ বেশ কিছু এলাকায় মানব পাচারকারী চক্রের আমরা তথ্য পেয়েছি সেগুলো নিয়ে কাজ করছি। সম্প্রতি বেশ কয়েকটি চক্র কে আমরা আইনের আওতায় এনেছি এবং এ ধরনের অপরাধ দমনে আমাদের অভিযান চলমান রয়েছে।
কেএম/এএস