ইতিহাসের অন্যতম কালো দিন
পিলখানা হত্যাকাণ্ডের ১৩ বছর আজ
আজ ২৫ ফেব্রুয়ারি। বাংলাদেশের ইতিহাসে অন্যতম কালো দিন। ২০০৯ সালের এই দিনটিতে নারকীয় হত্যাযজ্ঞে মেতে উঠেছিল কিছু বিপথগামী সৈনিক। সীমান্তরক্ষী বাহিনী বর্ডার গার্ড বাংলাদেশ, বিজিবির (তৎকালীন বাংলাদেশ রাইফেলস-বিডিআর) সদর দপ্তরে তারা এক ধ্বংসলীলা চালায়। তাদের সেই উন্মত্ততার শিকার হয়ে প্রাণ হারান ৫৭ জন সেনা কর্মকর্তা, নারী ও শিশুসহ আরও ১৭ জন।
এরপর থেকে ২৫ ফেব্রুয়ারি পরিণত হয় ‘পিলখানা হত্যা দিবসে’। মর্মান্তিক সেই ঘটনার এক যুগ পূর্তি হচ্ছে আজ শুক্রবার। ১৩ বছরে পড়েছে এ কালো দিনটি।
কী ঘটেছিল সেদিন?
২০০৯ সালের ২৫ ফেব্রুয়ারি সকাল ৯টা ২৭ মিনিটে বিডিআর দরবার হলে চলমান বার্ষিক (দরবার) নির্ধারিত সভায় বিভিন্ন দাবির প্রেক্ষিতে একদল বিদ্রোহী বিডিআর সৈনিক তাদের মহাপরিচালকের বুকে আগ্নেয়াস্ত্র নিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়েন। মহাপরিচালকসহ সেনাবাহিনীর কর্মকর্তাদের হত্যা ও তাদের পরিবারকে জিম্মি করেন। পিলখানার চারটি মূল ফটকই নিজেদের নিয়ন্ত্রণে নিয়ে আশেপাশের এলাকায় গুলি ছুঁড়তে থাকেন। জন্ম নেয় ইতিহাসের এক বীভৎস ঘটনা। টানা ৩৬ ঘণ্টা পর এ বিদ্রোহের অবসান ঘটলেও ততক্ষণে বিদ্রোহী সৈনিকরা কেড়ে নেয় ৫৭ জন দক্ষ সেনা কর্মকর্তার জীবন। পিলখানা পরিণত হয় এক রক্তাক্ত প্রান্তরে। ঘটনার পর পিলখানায় আবিষ্কৃত হয় গণকবর। যেখান থেকে উদ্ধার করা হয় সেনা কর্মকর্তাদের লাশ।
নিহতদের তালিকায় ছিলেন তৎকালীন বিডিআরের মহাপরিচালক মেজর জেনারেল শাকিল। এছাড়া সামরিক কর্মকর্তা ছাড়াও বিডিআরের গুলিতে কয়েকজন বেসামরিক নাগরিকও নিহত হন। সদরদপ্তরের ভেতর এই হত্যাকাণ্ড সংঘটিত হয়। তবে বিদ্রোহীরা ভেতরে আটকে পড়া শিশু ও নারীদের বেরিয়ে যাওয়ার সুযোগ দেন।
২৫ ফেব্রুয়ারি মধ্যরাতে তাৎক্ষণিক এক ভাষণে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বিদ্রোহীদের সাধারণ ক্ষমা ঘোষণা করলে বিডিআর সদস্যদের একাংশ আত্মসমর্পণ করেন। ২৬ ফেব্রুয়ারি সকালে দেশের বিভিন্ন সীমান্ত এলাকায় অবস্থিত বিডিআর ক্যাম্পে পুনরায় উত্তেজনার খবর পাওয়া যায়। ওইদিন প্রধানমন্ত্রীর জাতির উদ্দেশে দেওয়া ভাষণে বিডিআরকে আবারও তাদের দাবি দাওয়া মেনে নেওয়ার আশ্বাস দেন। ২৬ ফেব্রুয়ারি সন্ধ্যায় বিদ্রোহী বিডিআরের সব সদস্য তাদের অস্ত্র জমা দেন এবং পুলিশ বিডিআর সদরদপ্তর নিয়ন্ত্রণে নিয়ে নেয়।
এ ঘটনায় হতবাক হয়ে যায় সারাদেশের মানুষ। মাত্র ৩৬ ঘণ্টার এ হত্যাযজ্ঞে ৫৭ জন মেধাবী সেনা কর্মকর্তা, একজন সৈনিক, দুইজন সেনা কর্মকর্তার স্ত্রী, ৯ জন বিডিআর সদস্য এবং আরও পাঁচ জন বেসামরিক ব্যক্তি নিহত হন।
মামলা ও বিচারকার্য
পিলখানা ট্র্যাজেডির এই ঘটনায় ওই বছরের ২৮ ফেব্রুয়ারি লালবাগ থানায় হত্যা ও বিস্ফোরক আইনে দু’টি মামলা করেন তৎকালীন পুলিশ পরিদর্শক নবজ্যোতি খিসা। এছাড়া বিজিবির নিজস্ব আইনে ৫৭টি মামলার বিচার শেষে সারাদেশে ৫ হাজার ৯২৬ জনের বিভিন্ন মেয়াদে সাজা হয়েছে।
২০১০ সালের ১২ জুলাই পিলখানা হত্যা মামলায় ৮২৪ জনকে আসামি করে চার্জশিট দেয় পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগ (সিআইডি)। পরে সম্পূরক চার্জশিটে আরও ২৬ জনকে আসামি করা হয়। পিলখানা হত্যা মামলার ২৩৩ কার্যদিবসে ৬৫৪ জন সাক্ষী আদালতে তাদের বক্তব্য উপস্থাপন করেন।
বিডিআর বিদ্রোহের ঘটনার ৪ বছর ৮ মাস পর ২০১৩ সালের ৫ নভেম্বর দুপুর সাড়ে ১২টার দিকে লালবাগে অবস্থিত আলিয়া মাদ্রাসা মাঠে স্থাপিত বিশেষ আদালতে এ হত্যা মামলার রায় দেন ঢাকার তৃতীয় অতিরিক্ত মহানগর দায়রা জজ মো. আখতারুজ্জামান। রায়ে ৮৫০ জন আসামির মধ্যে ১৫২ জনকে মৃত্যুদণ্ড, ১৬১ জনকে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড এবং ২৭১ জনকে খালাস দেওয়া হয়। ২ থেকে ২০ বছর পর্যন্ত বিভিন্ন মেয়াদে সাজা দেওয়া হয় ২৬৬ জনকে।
২০১৭ সালের ২৭শে নভেম্বর হাইকোর্টে আপিলের রায়ে ১৩৯ জনের মৃত্যুদণ্ডের রায় বহাল রাখা হয়। আট জনের মৃত্যুদণ্ডের সাজা কমিয়ে যাবজ্জীবন ও চার জনকে খালাস দেওয়া হয়। নিম্ন আদালতে যাবজ্জীবন কারাদণ্ডের আদেশ পাওয়া ১৬০ জনের মধ্যে ১৪৬ জনের সাজা বহাল রাখা হয়। হাইকোর্টে আপিল চলার সময়ে কারাগারে থাকা অবস্থায় দু’জনের মৃত্যু হয়। খালাস পান ১২ আসামি।
এ ঘটনায় বিস্ফোরক আইনের মামলাটি ঢাকা মহানগর দায়রা জজ আদালতে এখনো বিচারাধীন। মামলাটির আসামি রয়েছেন ৮৩৪ জন। তার মধ্যে ২৪ জন এরই মধ্যে মারা গেছেন। পলাতক রয়েছেন ২০ জন।
বিডিআর পুনর্গঠন ও বিজিবি গঠন
পিলখানায় এই বিদ্রোহের ঘটনায় বিডিআরের সাংগঠনিক কাঠামো ভেঙে যায়। শুরু হয় বিডিআর পুনর্গঠনের কাজ। বিডিআরের নাম, পোশাক, লোগো ও সাংগঠনিক কাঠামো পরিবর্তন করা হয়। বিডিআরের নাম পরিবর্তন করে রাখা হয় বর্ডার গার্ড বাংলাদেশ (বিজিবি)। পরিবর্তন করা হয় বিদ্রোহের আইন।
এদিনে দিনব্যাপী বিশেষ কর্মসূচি পালন করবে বিজিবি
পিলখানায় বিডিআর বিদ্রোহের ঘটনায় সরকারিভাবে এ দিনটিকে ‘পিলখানা হত্যা দিবস’ হিসেবে পালন করা হয়। এ দিবসটির স্মরণে এক দিনব্যাপী বিশেষ কর্মসূচি পালন করবে বিজিবি। পিলখানা হত্যাকাণ্ডে শহিদদের স্মরণে আগামীকাল শুক্রবার (২৫ ফেব্রুয়ারি) শাহাদৎবার্ষিকী পালিত হবে।
২০০৯ সালে বিডিআর (বর্তমান বিজিবি) সদরদপ্তর পিলখানায় সংঘটিত বর্বরোচিত হত্যাকাণ্ডে শহিদদের স্মরণে আয়োজন করা হবে বিশেষ দোয়া ও মিলাদ মাহফিলের। বিজিবির জনসংযোগ কর্মকর্তা মো. শরিফুল ইসলাম এসব তথ্য নিশ্চিত করেছেন।
মো. শরিফুল ইসলাম বলেন, এ দিন শহিদ ব্যক্তিবর্গের রুহের মাগফেরাতের উদ্দেশে পিলখানাস্থ বর্ডার গার্ড বাংলাদেশ (বিজিবি) সদরদপ্তরসহ সব রিজিয়ন, প্রতিষ্ঠান, সেক্টর ও ইউনিটের ব্যবস্থাপনায় খতমে কোরআন, বিজিবির সব মসজিদ এবং বিওপি পর্যায়ে শহিদদের রুহের মাগফেরাত কামনা করে দোয়া ও মিলাদ মাহফিলের আয়োজন করা হয়েছে।
তিনি আরও বলেন, এদিন সকাল ৯টার দিকে বনানী সামরিক কবরস্থানে রাষ্ট্রপতির ও প্রধানমন্ত্রীর প্রতিনিধি, স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী, ৩ বাহিনীর প্রধান (সম্মিলিতভাবে), স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের জননিরাপত্তা বিভাগের সিনিয়র সচিব ও বিজিবি মহাপরিচালক (একত্রে) শহিদদের স্মৃতিস্তম্ভে পুষ্পস্তবক অর্পণ করবেন।
এ ছাড়া দিবসটি পালনে বিজিবির সব স্থাপনায় বিজিবি পতাকা অর্ধনমিত থাকবে এবং বিজিবির সব সদস্য কালো ব্যাজ পরিধান করবে। বিজিবির সব সেক্টর ও ব্যাটালিয়ন পর্যায়ে বিশেষ দরবার অনুষ্ঠিত হবে।
বিজিবি জানায়, দোয়া ও মিলাদ মাহফিলে বিজিবি কেন্দ্রীয় মসজিদে বিজিবি মহাপরিচালক মেজর জেনারেল মো. সাফিনুল ইসলাম, স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের আমন্ত্রিত অতিথিরা, শহিদ ব্যক্তিবর্গের নিকটাত্মীয়, পিলখানায় কর্মরত সব অফিসার, জুনিয়র কর্মকর্তা, অন্যান্য পদবীর সৈনিক ও বেসামরিক কর্মচারীরা স্বাস্থ্যবিধি অনুসরণপূর্বক সামাজিক দূরত্ব বজায় রেখে অংশগ্রহণ করবেন।
কেএম/আরএ/এমএমএ/