ফায়ার সার্ভিস আসার আগেই নীলক্ষেতে সব পুড়ে শেষ
রাজধানীর নিউমার্কেট এলাকায় অবস্থিত নীলক্ষেত বইয়ের মার্কেটে আগুন লাগার ঘটনাকে কেন্দ্র করে অনেকের মধ্যে সন্দেহ দেখা দিয়েছে। কেউ বলছেন, চোখের সামনে আগুনের সূত্রপাত হয় কিন্তু এ আগুন নিভাতে তারা অক্ষম ছিল। পরে ফায়ার সার্ভিসকে জানালে ২০ মিনিট পর সার্ভিস ঘটনাস্থলে উপস্থিত হয়।
সাধারণ মানুষের অভিযোগ, মঙ্গলবার নীলক্ষেত বন্ধ থাকে কিন্তু রাস্তার পাশের দোকান থাকায় কিছুটা যানজট লাগতে পারে, তবে তুলনামূলক সেটি অনেক কম। ফায়ার সার্ভিস যদি সঠিক সময়ে নীলক্ষেতে অবস্থান করতে পারত তাহলে ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ কম হতো। তারা মনে করছেন এ আগুনের দৃশ্য ছিল ভয়াবহ। চোখের সামনে পুড়ে গিয়েছে অনেকের স্বপ্ন।
ব্যবসায়ীদের দাবি, সামান্য পরিমাণ আগুন দেখে আমরা ফায়ার সার্ভিসকে জানাই, ফায়ার সার্ভিসের স্টেশন কাছাকাছি থাকার পরও ২০ মিনিট দেরিতে ঘটনাস্থলে পৌঁছায়। এর মধ্যেই এ আগুন ভয়াবহ রূপ ধারণ করে ছড়িয়ে পড়ে।
ব্যবসায়ীদের দাবি, ফায়ার সার্ভিস সঠিক সময়ে আসলে তাহলে আর্থিকভাবে একটু কম ক্ষতিগ্রস্ত হতো।
ব্যবসায়ীরা বলছেন, প্রথমে আগুন ছোট ছিল এরপর ভয়াবহভাবে মার্কেটে ছড়িয়ে পড়ে। আগুনে ক্ষতিগ্রস্ত হয় প্রতিটা ব্যবসায়ী। কম করে হলেও ১০ থেকে ১৫ লাখ টাকার ক্ষতি হয়েছে বলে তাদের দাবি।
ব্যবসায়ীরা বলছে, এ ভয়াবহ আগুনের ঘটনায় নীলক্ষেতে ইসলামিয়া মার্কেটের ২৮ টা দোকান ও শাহজালাল মার্কেটের ৪১ টি দোকান মোট ৬৯ টি দোকান পুড়ে ছাই হয়ে গেছে।
এদিকে ফায়ার সার্ভিস বলছে, কিভাবে আগুনের সূত্রপাত হয় সে ব্যাপারে এখন পুরোপুরিও নিশ্চিত হওয়া যায়নি। তবে ধারণা করা হচ্ছে। বিষয়টি ফায়ার সার্ভিস নিশ্চিত না করলেও একাধিক বই ব্যবসায়ী বলছে, বিদ্যুতের তার মেরামত করতে গিয়ে শর্ট সার্কিট থেকে এ আগুন লাগে।
মার্কেটের সামনে অস্থায়ী ব্যবসায়ী ও প্রত্যক্ষদর্শীরা জানান, প্রথমে তারা আগুন ছোট মনে করে নিজেরা নেভাতে যায় পরে নিভাতে অক্ষম হয়। এরপর তারা ফায়ার সার্ভিসকে ফোন করে। ঘটনাস্থলে ফায়ার সার্ভিস আগুন লাগার ২০ মিনিট পরে এসে আগুন নিয়ন্ত্রণের চেষ্টা করে।
ফায়ার সার্ভিসের দাবি, পলাশী মোড়ে ফায়ার সার্ভিসের একটি স্টেশন ও আশেপাশে কয়েকটি স্টেশন থাকলেও যানজটের কারণে তারা সঠিক সময়ে উপস্থিত হতে পারেনি। যার কারণে এ আগুনের ভয়াবহতার শিকার হয় বই ব্যবসায়ীরা।
গতকাল মঙ্গলবার ৭ টা ৪৩ মিনিটে বইয়ের মার্কেটের দ্বিতীয় তলায় আগুন লাগে। আগুন নিয়ন্ত্রণে ফায়ার সার্ভিসের সর্বশেষ ১০টি ইউনিট কাজ করে। ফায়ার সার্ভিসের এক ঘণ্টার চেষ্টায় রাত ৮ টা ৫০ মিনিটে আগুন নিয়ন্ত্রণে আসে।
কীভাবে আগুনের সূত্রপাত হয় এমন প্রশ্নের জবাবে চারুকলা স্টেশনারি বই কর্নার এর বিক্রেতা শুভ আহমেদ বলেন, আমাদের দোকান থেকে শর্ট সার্কিটের মাধ্যমে প্রথমে আগুনের সূত্রপাত ঘটে এরপর মার্কেটের দ্বিতীয় তলায় আগুন ছড়িয়ে পড়ে।
একই মার্কেটে পাশের দোকানের বই বিক্রেতা নাইম হোসেন বলেন, ‘আমরা দেখতে পেলাম হঠাৎ বিদ্যুতের তারে দাও দাও করে আগুন এরপর দৌড় ঘটনাস্থল থেকে রাস্তার পাশে চলে যাই। ৫ থেকে ১০ মিনিটের ভিতরে পুরো মার্কেটে আগুন ছড়িয়ে পড়ে। পরে ফায়ার সার্ভিস এসে অনেক সময় কাজ করে আগুন নিয়ন্ত্রণ করে।
এদিকে বই বিক্রেতা জাহিদ আলম অভিযোগ করে বলেন, আগুন লাগার সঙ্গে সঙ্গে আমরা ফায়ার সার্ভিসকে ফোন দিয়েছিলাম। কিন্তু ফায়ার সার্ভিস ঘটনাস্থলে অনেক পরে পৌঁছায়। যদি সঠিক সময়ে ফায়ার সার্ভিস ঘটনাস্থলে উপস্থিত হতে পারত তাহলে চোখের সামনে ৬৯ টি দোকান পুড়ে ছারখার হতো না।
তপন বুক হাউজ ও মেডিকেল এন্ড স্টেশনারির বই বিক্রেতা আলভী মোস্তফা বলেন, আমাদের দোকান মালিকরা অনেক ক্ষতিগ্রস্ত হলো। দোকান না করলে হয়তো আমাদের এ মাসের বেতন বন্ধ থাকবে।
দেওয়ান বুক লাইব্রেরির কর্মচারী বেলাল বলেন, হঠাৎ দাও দাও করে আগুনে সব শেষ হয়ে গেল। কম করে হলেও দোকানের ১০ থেকে ১৫ লক্ষ টাকার বই পুড়ে গেছে।
চারুকলা বই কর্নারের স্বপন বলেন, আগুন লাগতে দেরি হলো কিন্তু পুড়তে দেরি হলো না চোখের সামনে সব পুড়ে গেল।
ইভা বুক হাউজের শক্তি বলেন, ‘বিদ্যুৎ এর তারে থেকে আগুন লাগে। তখন আমি মার্কেটের মধ্যে। তাড়াতাড়ি সবাই দৌড়ে রাস্তার পাশে চলে গেলাম। এ এক ভয়াবহ অগ্নিকাণ্ড।
ফেসবুক কর্নার ও ফ্রেন্ডস বুক কর্নারের পাটনার ব্যবসায়ী সৌরভ বলেন, এবার আগুনে শেষ হয়ে গেলাম। বাড়ি থেকে জমি বন্ধক রেখে ব্যবসা শুরু করেছি অবশেষে আগুনে পুড়ে সব ছারখার হলো।
বই ব্যবসায়ী সাইফুল ইসলাম বলেন, প্রথমে চারুকলা স্টেশনারিতে আগুন লাগে মুহূর্তের মধ্যে সমস্ত বৈদ্যুতিক তারে আগুন ছড়িয়ে পড়ে।
ফারহান বুকসের একজন বিক্রয়কর্মী বলেন, নিচতলা থেকে দোতলা একটা দোকানে ওয়েল্ডিং এর কাজ চলছিল। সেখান থেকেই আগুনের সূত্রপাত হয়। তিনি আরও বলেন, আগুন লাগার পর ফায়ার সার্ভিসের মাত্র একটা ইউনিট ঘটনাস্থলে আসে। ৫ মিনিটেই তাদের পানি শেষ হয়ে যায়। এরপর বাকি ইউনিটগুলো আসতে ২০-৩০ মিনিটের বেশি সময় লাগে। তারা যদি আরেকটু আগে আসতো তাহলে হয়তো ক্ষতির পরিমান কম হতো।
নিউ বুকস গার্ডেনের মালিকের মা জাহানারা বেগম বলেন, দুই দোকানে প্রায় ১০ থেকে ১২ লাখ টাকার বই ছিল। পরশু দিন ও ৫ লাখ টাকার বই তুলেছে। কিস্তির টাকা নিয়ে বইগুলো উঠানো হয়। আগুনে সব শেষ করে দিল আমার পোলাটার সর্বনাশ হলো।
এ ছাড়াও একাধিক বইয়ের দোকানের মালিকের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, দেশের সবচেয়ে পুরনো বইয়ের দোকান এটি। মঙ্গলবার ছুটির দিন থাকায় ভেতরে কেউ ছিলনা। ভেতরে থাকলে হয়তোবা দোকানের কর্মচারীরা মারাও যেত।
দেখা যায়, গতকাল রাতে নীলক্ষেত বই মার্কেটের আগুন নিয়ন্ত্রণে ফায়ার সার্ভিসের ১০টি ইউনিট ও ৯৬ ফায়ার কর্মী কাজ করেছে। এ ছাড়াও নিউমার্কেট থানার পুলিশ, র্যাব ও স্কাউট কর্মীরা আগুন নিয়ন্ত্রণে কাজ করেছে।
ঘটনাস্থল পরিদর্শনের সময় কথা হয় নীলক্ষেত থানার এ এস আই জিয়ার সঙ্গে। তিনি বলেন, বই ব্যবসায়ীরা এক একজন এক এক রকমের কথা বলছেন। আমরা তদন্ত করছি। এবং ব্যবসায়ীদের সঙ্গে কথা বলেছি তারা বলছে, শর্ট সার্কিট থেকে আগুনের সূত্রপাত হয় এরপর মার্কেটের সব জায়গায় ছড়িয়ে যায়।
এদিকে নীলক্ষেত বইয়ের মার্কেটের আগুন লাগার সার্বিক বিষয়ে জানতে চাইলে ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্সের মিডিয়া সেলের ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা মো. শাহজাহান শিকদার বলেন, এখনও আগুনের ক্ষতিগ্রস্তের পরিমাণ জানা যায়নি এবং কোনো হতাহতের খবর ও নিশ্চিত হওয়া যায়নি। যথাযথ সময়ে ফায়ার সার্ভিস ঘটনাস্থলে পৌঁছে আগুন নিয়ন্ত্রণে আনে।
এদিকে ফায়ার সার্ভিসের একটি সূত্র জানায়, আগুন লাগার খবর পেয়ে তারা সঙ্গে সঙ্গে ঘটনাস্থলে পৌঁছায়। পরে জানতে পারে আগুন লাগার ১০ মিনিট পরে স্থানীয় লোকজন ফায়ার সার্ভিসকে খবর দেয়। এ বিষয়টি নিয়ে তদন্ত করছে ফায়ার সার্ভিস, তদন্ত শেষে তারা আরও ভালোভাবে বলতে পারবে বলে জানান।
নীলক্ষেত বই মার্কেটে কীভাবে আগুনের ঘটনা ঘটেছে জানতে চাইলে ফায়ার সার্ভিসের পরিচালক (অপারেশন এন্ড মেইনটেনেন্স) লেফটেন্যান্ট কর্নেল জিল্লুর রহমান জানান, গতকাল বই মার্কেটে আগুন লাগার খবর পেয়ে ফায়ার সার্ভিসের তিনটা ইউনিট ঘটনাস্থলে উপস্থিত হয়।
বই ব্যবসায়ীদের অভিযোগ ফায়ার সার্ভিস একটু দেরিতে অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা স্থলে উপস্থিত হয় এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ফায়ার সার্ভিস বিভিন্ন দুর্যোগ মোকাবেলায় প্রস্তুত থাকে। এ ঘটনাটি ও ফায়ার সার্ভিস যথেষ্ট গুরুত্বের সঙ্গে আমলে নিয়ে ঘটনাস্থলে উপস্থিত হয়েছে, তবে হয়তো রাস্তায় যানজট থাকার কারণে এমনটি হয়েছে।
তিনি আরও জানান, আগুনে দ্বিতীয় তলার দোকান গুলো ক্ষতিগ্রস্ত হলেও নিচতলা তেমন কোন ক্ষতিগ্রস্ত হয়নি। দ্বিতীয় তলায় মার্কেটটির কোনো একটি দোকানে কেউ ইলেকট্রিক লাইন অন করে চলে গিয়েছিল। সেখান থেকে আগুনের সূত্রপাত হয়েছে বলে ধারণা করা হচ্ছে। তারপরও বিষয়টি নিয়ে তদন্ত চলছে তদন্ত শেষ হলে বিস্তারিত বলা যাবে।
কেএম/এমএমএ/এএস