মেয়াদোত্তীর্ণ সিলিন্ডার ও মনিটরিং না থাকায় বিস্ফোরণ বাড়ছে
সারাদেশে হঠাৎ করে গ্যাসের সিলিন্ডার বিস্ফোরণের ঘটনা বেড়ে গেছে। এ দুর্ঘটনার কবলে পড়ে অনেক মানুষ বিভিন্ন ভাবে ক্ষতিগ্রস্থ হচ্ছে। গ্যাস সিলিন্ডার বিস্ফোরণে দেশে দিন দিন বাড়ছে প্রাণহানি। প্রায় প্রতিদিনই কোথাও না কোথাও সিলিন্ডার বিস্ফোরণে হতাহতের ঘটনা ঘটেই চলছে। বাসাবাড়ি, গাড়ি, এমনকি ট্রলারেও ঘটছে বিস্ফোরণ। তথ্য-উপাত্ত বলছে, সিএনজি, এলপিজি, অক্সিজেন, অ্যামোনিয়া, নাইট্রোজেন, হিলিয়ামসহ বিভিন্ন গ্যাসের মেয়াদোত্তীর্ণ সিলিন্ডারের কারণেই বেশিরভাগ দুর্ঘটনা ঘটছে।
এসব দুর্ঘটনার কারণ ও রোধ করার বিষয়ে সংশ্লিষ্টরা বলছেন, বিস্ফোরণ ঠেকাতে অবশ্যই সিলিন্ডার ব্যবহারকারীকে সচেতন হতে হবে। অন্যদিকে গ্যাস সিলিন্ডার সরবরাহকারী সংশ্লিষ্ট কোম্পানিগুলোর উচিত হবে বাজারে সরবরাহের আগে অবশ্যই সিলিন্ডারগুলো তদারকি করা। নিয়মের মধ্যে থেকে সিলিন্ডার ব্যবহার ও সরবরাহ নিশ্চিত না হলে ভবিষ্যতে এ দুর্ঘটনা আরও বাড়তে পারে।
বিস্ফোরক বিশেষজ্ঞরা বলছেন, মেয়াদোত্তীর্ণ সিলিন্ডার ব্যবহার এবং যথাযথ মনিটরিং না থাকার কারণে এ ধরনের দুর্ঘটনা বেড়েই চলছে।
বিস্ফোরক বিশেষজ্ঞদের দাবি, এসব সিলিন্ডার যে সমস্ত ট্রান্সপোর্টে সরবরাহ করা হয়, অনেক সময় সরবরাহকারীরা সিলিন্ডার গুলো অবহেলা নিয়ে নাড়াচাড়া করে, ছুড়ে ফেলে দেয়, যার কারণে সিলিন্ডার ছিদ্র বা অকেজো হয়ে পড়ে এবং সিলিন্ডারের ভাল্ব নষ্ট হয়ে যায় এ কারণে হয়তো বর্তমানে বেশি বিস্ফোরণ ঘটছে।
এদিকে অনেকে মনে করছে, মেয়াদোত্তীর্ণ গ্যাসের সিলিন্ডার বাজারে ছেড়ে দেওয়ায় হঠাৎ করে ঘটছে এ বিস্ফোরণের ঘটনা। তাদের দাবি এ বিষয়ে সরকারের নজরদারি বাড়ানো উচিত।
এদিকে একটি সূত্র জানায়, গত এক বছরে ৮৯৪ টি সিলিন্ডার বিস্ফোরণের ঘটনায় ৭৫ জন আহত হয়েছে এবং ৮ জন নিহত হয়েছে।
তথ্য মতে জানা গেছে, গত শনিবারে মুন্সীগঞ্জে একজন, এবং নরসিংদীতে একজন গাড়ির সিলিন্ডার বিস্ফোরণ হয়ে আহত হয়। তাছাড়া রবিবার একদিনে সারাদেশে গ্যাস সিলিন্ডার বিস্ফোরণের ঘটনায় ১৫ জন দগ্ধ হয়। এর মধ্যে ৩ জন সংকট পূর্ণ অবস্থায় রয়েছে এবং এ ঘটনায় ৫ জন মৃত্যুবরণ করেছে। মোট তিন দিনে সারাদেশে গ্যাসের সিলিন্ডার বিস্ফোরণ হয়ে ৫ জনের মৃত্যু হয় এবং ১৭ দগ্ধ হয়।
জানা যায়, গতকাল রবিবার দুপুরে নারায়ণগঞ্জ সদর উপজেলার ফতুল্লার আলীগঞ্জ ব্যাপারীবাড়ি এলাকায় ট্রাকচালক আবদুল বাতেন মেরামতের জন্য একটি গাড়ির সিলিন্ডার থেকে গ্যাস অপসারণ করছিলেন। সেখানে হঠাৎ অপর এক ট্রাকচালক আলম হোসেন সিগারেট জ্বালাতে গেলে আগুনের সংস্পর্শে বিকট শব্দে বিস্ফোরণ ঘটে। এতে কমপক্ষে ১০ জন দগ্ধ হন। দগ্ধদের শেখ হাসিনা জাতীয় বার্ন ও প্লাস্টিক সার্জারি ইনস্টিটিউটে ভর্তি করা হয়। এ বিস্ফোরণে দগ্ধ হয়ে জজ মিয়া (৫১) ও আলম হোসেন (৪০) নামের দুজন ব্যক্তি মৃত্যুবরণ করে।
একইদিনে, বেলা ১১ টার সময় রাজধানীর বারিধারার একটি বাসায় জমে থাকা গ্যাস বিস্ফোরণে ২ জন দগ্ধ হয়। দগ্ধ হওয়া আশিক সাদেক ও জিসান দুজনই কানাডা প্রবাসী। পরে ফায়ার সার্ভিসের সদস্যরা ঘটনাস্থলে গিয়ে আগুন নিভান। দগ্ধদের স্থানীয় হাসপাতালে প্রাথমিক চিকিৎসা দিয়ে শেখ হাসিনা জাতীয় বার্ন ইনস্টিটিউটে পাঠানো হয়।
ঐদিনেই, ময়মনসিংহের ভালুকায় একটি তালাবদ্ধ বসতঘরে গ্যাসের সিলিন্ডার বিস্ফোরণে আগুনে পুড়ে ৩ শিশু ভাই-বোনের ভয়াবহ মৃত্যুর ঘটনা ঘটে।
জানা যায়, তাদের বাবা-মা পোশাক কারখানার কর্মী। তারা সন্ধ্যার পর তিন শিশুকে ভাড়া বাসায় রেখে বাইরে তালা দিয়ে বের হয়েছিলেন। মা-বাবা আসার আগেই রাত সাড়ে ৯টার দিকে বিস্ফোরণ ঘটলে মুহূর্তেই আগুন টিনের ঘরে ছড়িয়ে পড়ে। পরে এলাকাবাসীর সহযোগিতায় দুই ঘণ্টার চেষ্টায় আগুন নিয়ন্ত্রণে আনেন ফায়ার সার্ভিসের কর্মীরা। আগুন নেভানোর পর তিন শিশুর পুড়ে যাওয়া দেহ উদ্ধার করা হয়।
এদিকে, শনিবার (১৯ ফেব্রুয়ারি) সন্ধ্যার দিকে রাজধানীর বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বিএসএমএমইউ) অক্সিজেন সিলিন্ডার লিকেজ হয়ে আগুনের ঘটনা ঘটেছে। তবে এতে কোনো হতাহতের ঘটনা ঘটেনি।
তবে এসব ঘটনার কারণে অনেকে মনে করছেন হঠাৎ করে গ্যাস সিলিন্ডার বিস্ফোরণ বেড়ে গিয়েছে। তাদের দাবি, গ্যাসের দাম বেড়ে যাওয়ায় হয়তো মেয়াদোত্তীর্ণ সিলিন্ডার বাজারে ছাড়া হয়েছে যার কারণে এটা ঘটছে।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অপরাধ বিশেষজ্ঞ তৌহিদুল হক বলেন, গ্যাসের সিলিন্ডার বিস্ফোরণের সঙ্গে দাম বাড়ার কোন সম্পর্ক নেই বলে আমি মনে করি। কারণ সিলিন্ডার বিস্ফোরণ একটা বিষয় আর দাম বেড়ে যাওয়া আরেকটি বিষয়। তবে সাধারণ মানুষের উদ্দেশ্যে বলতে চাই যারা গ্যাসের সিলিন্ডার ব্যবহার করেন তাদেরকে অবশ্যই সতর্কতার সাথে ব্যবহার করতে হবে তাহলে এ ধরনের ঘটনা হয়তো কমে আসবে।
এ সম্পর্কে জানতে চাইলে ফায়ার সার্ভিস অ্যান্ড সিভিল ডিফেন্সের মিডিয়া ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা মো. শাহজাহান শিকদার বলেন, সারাদেশে প্রতিদিন গ্যাসের সিলিন্ডার বিস্ফোরিত হয়ে অনেক মানুষ অগ্নিদগ্ধ হচ্ছে। আমরা ঘটনার পর্যবেক্ষণ করে দেখছি সচেতনতার অভাবে এসব ঘটনা বেড়ে যাচ্ছে। তিনি বলেন, অনেক মানুষ গ্যাসের সিলিন্ডার ব্যবহার করতে পারে না আমরা বিভিন্ন ভাবে তাদের সহযোগিতা করে যাচ্ছি। আমরা সাধারন মানুষকে এ বিষয়ে সতর্ক থাকার আহবান করছি।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে বুয়েটের বিস্ফোরক বিশেষজ্ঞ প্রফেসার মোঃ আশিকুর রহমান ঢাকাপ্রকাশ-কে বলেন, গত ৭২ ঘণ্টায় গ্যাসের সিলিন্ডার বিস্ফোরণ হয়ে আহত বা নিহত যে ঘটনাটি ঘটেছে সেটা হয়তো কাকতালীয় হতে পারে। তবে এমন ঘটনা প্রতিদিনই কমবেশি আমাদের দেশে ঘটে। গ্যাসের সিলিন্ডার বিস্ফোরণ হওয়ার কয়েকটি কারণ আছে, সেগুলো হলো সিলিন্ডারের মেয়াদ না থাকা, মনিটরিং না হওয়া এবং সিলিন্ডারের ভিতরে অতিরিক্ত গ্যাসের চাপ প্রয়োগ করার কারণে সিলিন্ডার বিস্ফোরণ হয়। তাছাড়া অনেকে ব্যবহার সঠিক মতো জানেনা। আমি মনে করি জেনে বুঝে গ্যাসের সিলিন্ডার ব্যবহার করলে বিস্ফোরণের সংখ্যা কমে আসবে।
তিনি বলেন, আমাদের দেশের সিলিন্ডার মনিটরিং এর অভাব রয়েছে। বিশেষ করে মনিটরিংয়ের দিকে গুরুত্ব দিতে হবে এবং মেয়াদোত্তীর্ণ সিলিন্ডার সরিয়ে ফেলতে হবে। এবং মনে রাখতে হবে গ্যাসের সিলিন্ডারের মধ্যে যাতে কোনভাবে হাইপ্রেশার না হয়।
প্রফেসর আরো বলেন, সিলিন্ডারের মান এবং মেয়াদ কর্তৃপক্ষকে বা সরকারী ভাবে মনিটর করা দরকার। অনেকে গ্যাসের সিলিন্ডার দীর্ঘদিন ব্যবহার করতে থাকে দীর্ঘদিন সিলিন্ডার ব্যবহার করলে বিস্ফোরণের সম্ভাবনা থাকে। এ বিষয়ে সতর্ক হতে হবে। অনেক সময় গাড়ির সিলিন্ডার বিস্ফোরণ হয় এর কারণ হলো একটি সিলিন্ডার গাড়িতে অনেকদিন ধরে ব্যবহার করা হয়। এক ধরনের ডিভাইস অনেক দিন ধরে অপারেট করতে থাকলে মেকানিক্যাল ডিভাইস যে কোনো কারনে ধাক্কা লেগে একটা ভাল্ব নষ্ট হয়ে যেতে পারে এবং দুর্ঘটনার কবলে পড়তে হতে পারে। এজন্য অবশ্যই সতর্ক থাকতে হবে।
তিনি বলেন, আমাদের দেশের ব্যবহারকারীরাও অনেক সময় জানেন না কিভাবে গ্যাস সিলিন্ডার ব্যবহার করতে হয়। তারা সেগুলোর রক্ষণাবেক্ষণ বোঝেন না। বাসায় কিভাবে রাখতে হবে, কোথায় রাখা যাবে সেগুলো অনেকে চিন্তা করেন না। এসব বিষয় সবাইকে সচেতন হতে হবে। আমরা দেখেছি অতীতের গ্যাস সিলিন্ডারের সাথে একটা সেফটি ভাল্ব থাকতো, আসলেই গ্যাস সিলিন্ডার বিস্ফোরণ হওয়ার কথা না, যদি সেফটিটা সঠিক মত কাজ করে।
তিনি বলেন, আমার পরামর্শ হচ্ছে মেয়াদোত্তীর্ণ সিলিন্ডার ও ঝুঁকিপূর্ণ অথবা সন্দেহজনক সিলিন্ডার ব্যবহার থেকে দূরে থাকলে এবং জনসচেতনতা বৃদ্ধি পেলে এ ধরনের বিস্ফোরণ কমে আসবে।
তিনি বলেন, তাছাড়া আমরা দেখেছি, যে সমস্ত ট্রান্সপোর্টে গ্যাসের সিলিন্ডার সরবরাহ করা হয় সেগুলো মাটিতে ছুড়ে ফেলা হয় যার কারণে সিলিন্ডারের ভাল্ব এবং বোর্ডের উপরে প্রচন্ড ক্ষতি হয় এ কারণে হয়তো বেশি বিস্ফোরণ হচ্ছে তবে নিয়মিত মনিটরিং করলে এ ঘটনা কমে আসবে।
কেএম/এএস