নির্মূল কমিটির আন্তর্জাতিক ওয়েবিনার
‘সর্বস্তরে বাংলা প্রচলনের পাশাপাশি সাম্প্রদায়িকতার মূল উৎপাটন করতে হবে’
শহীদ দিবস ও আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস উপলক্ষে ‘একাত্তরের ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটি’ সোমবার (২১শে ফেব্রুয়ারি) দুপুর ২টায় ‘আমাদের ভাষা আন্দোলন সাম্প্রদায়িক দ্বিজাতিতত্ত্বের মৃত্যুবার্তা’ শীর্ষক এক আন্তর্জাতিক ওয়েবিনার অনুষ্ঠিত হয়।
ওয়েবিনারে সভাপতিত্ব করেন একাত্তরের ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটির সভাপতি লেখক-সাংবাদিক শাহরিয়ার কবির।
সম্মানিত আলোচক ছিলেন মুক্তিযুদ্ধে শহীদ ভাষাসৈনিক ধীরেন্দ্রনাথ দত্তের পৌত্রী মানবাধিকার নেত্রী আরমা দত্ত এমপি, নির্মূল কমিটির সহসভাপতি শহীদজায়া শ্যামলী নাসরিন চৌধুরী, কলাম লেখক মমতাজ লতিফ, রাজশাহী মহানগরের ভারপ্রাপ্ত সভাপতি অধ্যাপক সুজিত সরকার, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের নৃবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক ড. আলা উদ্দিন, প্রজন্ম ’৭১-এর সভাপতি শহীদসন্তান আসিফ মুনীর তন্ময়, শহীদ সুরকার আলতাফ মাহমুদের কন্যা শহীদসন্তান শাওন মাহমুদ, সুইডেনে অবস্থানকারী নির্মূল কমিটির কেন্দ্রীয় নেতা সাংবাদিক সাব্বির খান এবং নির্মূল কমিটির সাধারণ সম্পাদক মানবাধিকার নেতা কাজী মুকুল।
শাহরিয়ার কবির বলেন, ‘এই উপমহাদেশে ১৮৬৭ সালে উত্তর ভারতের হিন্দি-উর্দু বিরোধ জন্ম দিয়েছিল সাম্প্রদায়িক দ্বিজাতিতত্ত্বের। ১৯৪৮-এর বাংলা-উর্দু বিরোধের নিষ্পত্তি ঘটেছে এই সাম্প্রদায়িক দ্বিজাতিতত্ত্বের সমাধি রচনার মাধ্যমে। পাকিস্তানে সাম্প্রদায়িক অপশক্তির অভিব্যক্তি ছিল রাজনৈতিক ইসলাম। পাকিস্তানের ২৪ বছরের উপনিবেশসুলভ শাসনামলে দেখেছি- ইসলামের নামে জাতিগত নিপীড়ন, শোষণ, হত্যা ও সন্ত্রাস সহ যাবতীয় মানবতাবিরোধী অপরাধ এমনকি গণহত্যা ও যুদ্ধাপরাধকেও কীভাবে জায়েজ করা হয়েছে। দুর্ভাগ্যের বিষয় হচ্ছে ১৯৭১-এ মুক্তিযুদ্ধে পরাজয় ঘটলেও স্বাধীন বাংলাদেশে পরাজিত রাজনৈতিক ইসলাম আবার ব্রাম স্টোকারের পিশাচ কাহিনী ড্রাকুলার মতো কবর থেকে উঠে এসেছে। রক্তপানের জন্য বেছে নিয়েছে ধর্মনিরপেক্ষ, অসাম্প্রদায়িক মানবতার বোধকে। বাঙালিত্বের যে অসাম্প্রদায়িক চেতনাকে ১৯৪৮-এ ভয় পেয়েছিলেন জিন্নাহ ও লিয়াকত আলী, ১৯৭১-এ ভয় পেয়েছেন, ইয়াহিয়া ও গোলাম আযমরা- সেই চেতনার আলোই বধ করবে ধর্মের রাজনৈতিক ব্যবহারকারী সাম্প্রদায়িক অপশক্তিকে।’
আরমা দত্ত এমপি বলেন, ‘৭১-এ ভাষার উপর ভিত্তি করে যে জাতিরাষ্ট্র গঠিত হয়েছে তা পৃথিবীতে অনন্য। শহীদ ধীরেন্দ্রনাথ দত্ত বাংলা ভাষার জন্য তৎকালীন পাকিস্তানের সংসদে দাঁড়িয়ে একা যে অসামান্য লড়াই চালিয়েছিলেন তা তিনি শুধুমাত্র মাতৃভাষা ও বাঙালি জাতির আত্মমর্যাদা ও আত্মপরিচয়ের চিহ্নকে রক্ষা করার জন্য, তা খ্যাতির জন্য নয়। আমরা যেন ধীরেন্দ্রনাথ দত্তের সেই স্বপ্ন ও প্রত্যাশাকে জাগরুক রাখতে পারি।’
মানবাধিকারনেত্রী আরমা দত্ত এমপি মুক্তিযুদ্ধে শহীদ ভাষা আন্দোলনের পুরোগামী নেতা ধীরেন্দ্রনাথ দত্তের স্মৃতিচারণ করে তরুণ প্রজন্মকে ভাষা আন্দোলন ও মুক্তিযুদ্ধের চেতনা হৃদয়ে ধারণ করার আহ্বন জানিয়ে বলেন, ‘আজকের দিনে শুধুমাত্র ফুল দিয়ে ছবি তুলে ভাষাশহীদদের শ্রদ্ধা জানানোর যে অসুস্থ প্রতিযোগিতা চলছে সেখান থেকে তরুণদের নিবৃত হতে হবে।’
শহীদজায়া শ্যামলী নাসরিন চৌধুরী বলেন, ‘ভাষা আন্দোলনের বীর শহীদদের আত্মদানের কারণে শুধু ভাষার অধিকার ফিরে পেয়েছি তাই নয়, প্রকৃতপক্ষে আমরা ফিরে পেয়েছি একটি জাতি রাষ্ট্র হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হওয়ার গৌরব এবং মর্যাদা। তাদের ঋণ অপরিশোধ্য। দ্বিজাতিতত্ত্বের প্রবক্তা মুসলিম লীগের নেতা মোহাম্মদ আলী জিন্নাহ পাকিস্তান আন্দোলনের সময় বলেছিলেন, হিন্দু ও মুসলমান সম্পূর্ণ স্বতন্ত্র ধর্ম, দর্শন, সামাজিক সংস্কার ও সাহিত্য থেকে উদ্ভূত। এমনকি হিন্দু ও মুসলমানগণ সম্পূর্ণ স্বতন্ত্র ইতিহাসের ধারা থেকে তাদের অনুপ্রেরণা লাভ করে থাকেন। প্রতিক্রিয়াশীল নেতা খাজা নাজিমুদ্দিন ঘোষণা করেছিলেন, আমাদের সংগ্রাম ভারত সরকারের বিরুদ্ধে নয়, হিন্দুদের বিরুদ্ধে। তাদের এই ভাবাদর্শের পরিণাম দেশবাসী দেখেছে। দেশভাগের ফলে পাকিস্তান ও ভারতে হিন্দু মুসলিম দাঙ্গা চরম রূপ ধারণ করেছিল। জীবন বাঁচাতে পৃথিবীর বৃহত্তম দেশান্তর তখন সংঘটিত হয়। ব্রিটিশদের বিভাজন ও শাসন নীতির ফলে সৃষ্টি এই ভয়াবহতায় প্রায় দেড় কোটি লোক বাস্তুচ্যুত হন।’
অধ্যাপক ড. আলাউদ্দিন বলেন, ‘ভাষা আন্দোলনের অসাম্প্রদায়িক চেতনা একদিকে জাতিগত বৈষম্য ও ধর্মকেন্দ্রিক চিন্তাভাবনার উপর এক ধরনের চপেটাঘাত, অন্যদিকে অসাম্প্রদায়িক চেতনার মধ্য দিয়ে বাঙালি সকল প্রকার বৈষম্যের বিরুদ্ধে সংগ্রাম করার জন্য ঐক্যবদ্ধ হতে উদ্ভুদ্ধ হয়; যার ফলশ্রুতিতে পরবর্তীতে শরীফ শিক্ষা কমিশন, যুক্তফ্রন্ট নির্বাচন, ছয় দফা আন্দোলন, গণঅভ্যুত্থান, সত্তরের নির্বাচন, এবং অবশেষে একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধে বাঙালি চূড়ান্ত বিজয় অর্জন করে। এই ভাষা আন্দোলনের ঐতিহাসিক তাৎপর্য এখানে যে, এই আন্দোলনের মাধ্যমে পৃথিবীর কাছে একটি সত্য প্রতিষ্ঠিত হয়েছে যে, সাধারণ মানুষ যদি কোন অভিন্ন সূত্রে ঐক্যবদ্ধ হয়, তাহলে যে কোনো পরাশক্তিকে প্রতিহত করা, তথা সর্বাত্মক আন্দোলনের মাধ্যমে চূড়ান্ত বিজয় অর্জন করা সম্ভব।’
শহীদসন্তান শাওন মাহমুদ বলেন, ‘ভাষা রক্ষার লড়াইয়ে তৈরী হয়েছিল অসাম্প্রদায়িক ছাত্র সংগঠন, যুব সংগঠন, রাজনৈতিক দল। এ সময়ে জাতীয় ছাত্র সংগঠন হিসেবে তৈরী হয়েছিল পূর্ব পাকিস্তান ছাত্র ইউনিয়ন। দেশব্যাপী বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে তার শাখার বিস্তার ঘটায় তরুণ-তরুণীদের মধ্যে ধীরে ধীরে অসাম্প্রদায়িক চেতনার ছড়িয়ে গিয়েছিল। এমনকি বিভিন্ন সংগঠন তাদের সাম্প্রদায়িক নাম বাদ দিয়ে অসাম্প্রদায়িক মতাদর্শে, সংগঠনের নামে পরিবর্তন এনেছিল। সকলে নিজের ধর্ম, রাজনৈতিক মতাদর্শকে তুলে রেখে একসাথে পথ হাঁটবার সেতু বন্ধনে আবদ্ধ হয়ে উঠেছিল আপনাআপনি। হিন্দু, মুসলিম, বৌদ্ধ, খ্রিষ্টানসহ ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠীর দৃঢ় সম্মিলনে এক স্বাধীন ভূমির স্বপ্ন সূচিত হয়েছিল। দল, মত, ধর্ম, শ্রেণী নির্বিশেষে আমরা সবাই বাঙালির ভাবনায় পথ হয়েছিল প্রসারিত। আমরা এই অনন্য, অসাধারণ অর্জনটিকে উগ্রবাদের কলূষিত বিষ প্রয়োগের মাধ্যমে খুব ধীরে ধীরে হত্যা করেছি। এর থেকে আমাদের দ্রুত উত্তরণ করতে হবে।’
নির্মূল কমিটির সাধারণ সম্পাদক মানবাধিকার নেতা কাজী মুকুল সর্বস্তরে বাংলা প্রচলনের দাবি পুনর্ব্যক্ত করে বলেন, ‘আমাদের সমাজ ও রাজনীতিতে মৌলবাদ ও সাম্প্রদায়িকতা যেভাবে আবার মাথাচাড়া দিচ্ছে- তরুণ প্রজন্মকে এর অশুভ প্রভাব থেকে দূরে রাখতে হলে অসাম্প্রদায়িক মানবিকতার চর্চা অব্যাহত রাখতে হবে।’
এপি/